টংক আন্দোলনের কিংবদন্তি কুমুদিনী হাজং- সোহেল হাজং
টংক আন্দোলনের সংগ্রামী নেত্রী কুমুদিনী হাজং। ব্রিটিশ আমলে গারো পাহাড়ের পাদদেশ নেত্রকোনার সীমান্তে তাঁর জন্ম, সেখানেই বেড়ে ওঠা এবং পরবর্তীতে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া। ইতিহাসে হাজং বিদ্রোহের কথা জানতে হলে কুমুদিনী হাজংয়ের নাম আসবেই। টংক আন্দোলনের একমাত্র কালের সাক্ষী হয়ে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার ঐতিহাসিক বহেরাতলী গ্রামেবয়োবৃদ্ধ অবস্থায় দিনযাপন করছেন কমরেড কুমুদিনী হাজং। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শক্তি ছিলেন। এ নেত্রী আমাদের অহংকার।
বাংলা একাডেমি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যে সাতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ-২০১৯ প্রদান করেছে তার মধ্যে কুমুদিনী হাজং একজন। এটি একটি ভালো খবর। সমাজসেবা কাজে অবদানের জন্য তিনি এ ফেলোশিপটি পেয়েছেন। আমরা আরো আগেই রাষ্ট্র থেকে এই জীবন্ত কিংবদন্তির জন্য কোন সম্মানের প্রত্যাশা করেছিলাম। যদিও এর আগে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া থেকে তিনি কিছু পুরস্কার ও সম্মানী পদক পেয়েছেন যার মধ্যে রয়েছে-অনন্যা শীর্ষদশ (২০০৩), ড. আহমদ শরীফ স্মারক (২০০৫), কমরেড মনি সিংহ স্মৃতি পদক (২০০৭), সিধু-কানহু-ফুলমণি পদক (২০১০), জলসিঁড়ি (২০১৪), হাজং জাতীয় পুরস্কার (২০১৮) ইত্যাদি। টংক আন্দোলন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় এ হাজং নারীর অবদান কোন অংশে কম নয়। কিন্তু আমরা তাকে সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। টংক আন্দোলনের এ সৈনিককে স্বাধীন দেশে আমরা দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্ত করতে পারিনি কখনোই। অন্যের সাহায্যে পাওয়াটিন শেডের একটি ছোট ঘরে নেত্রকোনার বহেরাতলী গ্রামে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে কোনরকমে দিন কাটাচ্ছেন কুমুদিনী হাজং। গত কয়েক বছর আগেও যখন আমি তার সঙ্গে দেখা করি তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন তার বসতবাড়ির জায়গাটুকু এখনো তার নিজের নামে লিখে নিতে পারেনি। ১৯৫০ সালে টংক প্রথা বিলুপ্তির পর হাজংদের ওপর অন্য মাত্রায় অত্যাচার চলে আসে। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে হাজার হাজার হাজংপরিবার এদেশ হতে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেসময় অন্যান্যদের মতো কুমুদিনী হাজংয়ের পরিবারকেও ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। দাঙ্গা শেষ হলে কুমুদিনী হাজং ও তার পরিবার নিজের জায়গায় ফেরত এসে দেখে তার চার আড়া জমি সেটেলারদের দ্বারা দখল হয়ে গেছে। চেষ্টা করেও তিনি নিজের জমি আর ফেরত পাননি। তারপর জঙ্গল পরিস্কার করে এখন বহেরাতলী গ্রামের যে টিলাতে বসতি গড়েছেন সে জমিও নাকি বনবিভাগের আওতায় খাস জমি। ভিটেতে ফলের গাছ লাগালেও সে ফল পেরে খেতে বনবিভাগ থেকে নিষেধাজ্ঞার শিকার হতে হয়েছে তাকে। এখানেও কয়েক যুগ পার হলো। কত খাস জমি তো গরিব মানুষকে বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। কুমুদিনী হাজং কেন এটা পাওয়ার অধিকার রাখে না! টংক আন্দোলনের এ নেত্রী ব্রিটিশ ও জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হলেও এখন স্বাধীন বাংলাদেশে একজন আদিবাসী হিসেবেতারনিজের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বিষয়টি বড় কষ্টের।
হাজংদের সংগ্রামী ইতিহাসে ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি একটি স্মরণীয় দিন। সেসময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে টংক বিরোধী আন্দোলন খুবই প্রকট আকার ধারণ করেছিল। হাজংমাতা রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে নেত্রকোনার প্রতিটি অঞ্চলে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। নেত্রকোনার বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল্স বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসের দিনগুলোতে পরিকল্পিতভাবে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল্স সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে প্রতিবাদী হাজং কৃষকদের খুঁজতে শুরু করে। সে লক্ষ্যেই ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০ টার সময় বিরিশিরি থেকে চার মাইল উত্তরে বহেরাতলী নামক গ্রামে তারা তল্লাশি চালায়। লক্ষ্য ছিল কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও লংকেশ্বরের বড় তিন ভাইসহ যারা টংক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের ধরে নিয়ে আসা। কিন্তু এদিনে এ গ্রামের বিদ্রোহী হাজং কৃষক নর-নারীরা প্রতিবেশিদের টংক বিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে পাশের গ্রামে অবস্থান করছিল। বহেরাতলী গ্রামে কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজং বা কোন পুরুষ সদস্যকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত পুলিশ বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে বিরিশিরি ক্যাম্পের দিকে রওনা হয়। সেসময় কুমুদিনী সদ্য বিবাহিতা, বয়স ছিল মাত্র ১২ কিংবা ১৩ বছর। আজ ২০২০ সালে এসে তার বয়স হবে ৯০ এর কাছাকাছি।
সেদিন কুমদিনীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে মহীয়সী নারী নেত্রী রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে শতাধিক হাজং নারী-পুরুষ সশস্ত্র বাহিনীর পথরোধ করেন। এতোবড় সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে হাজং কৃষকরা কিভাবে লড়াই করবে! এই ভেবে হাজং সদস্য কেউ কেউ পিছপা হতে চাইলেও রাশিমণি হাজং একটুও দমে যাননি। তিনি সামনের সারিতে গিয়ে কুমুদিনী হাজংকে বাঁচাতে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সে সময় তিনি বজ্রকণ্ঠে বলেন- ‘ময় তিমাদ, এগরা তিমাদ হুয়ে ময়, তিমাদলা মান রুক্ষা কুরিব, না-তে মুরিব, তুরা তুমলা নীতি নিয়া বুইয়া থাক।’ হাজং ভাষায় বলা এ কথার অর্থ হচ্ছে-‘আমি নারী, নারী হয়ে আমি আরেক নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করবো, মরতে হয় মরব। তোমরা তোমাদের নীতি নিয়ে বসে থাক।’এটা বলার সাথে সাথে দলের অন্য সদস্যরাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পুলিশ বাহিনী এসময় নৃশংসভাবে তাদের ওপর গুলি চালায়। যুদ্ধের একপর্যায়ে পেছন থেকে আসা গুলির আঘাতে রাশিমণি হাজং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পেছনে পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাশিমণিকে ধরতে গেলে তাকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাকি আদিবাসী সদস্যরা তখন পুলিশদের মেরে ঘায়েল করা শুরু করলে অবশেষে তারা কুমুদিনীকে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে হাজং কৃষক শহিদদের পাশাপাশিআরো দুজন ব্রিটিশ পুলিশের নিহতের খবর পাওয়া যায়। এভাবেই সেদিন রক্ষা পায় কুমুদিনী হাজং কিন্তু বহেরাতলির মাটিতে সেদিন রক্ত গঙ্গায় মিশে যায় আদিবাসী নেত্রী রাশিমণি হাজংয়ের তাজা প্রাণ।
ঐ ঐতিহাসিক ঘটনাটি কুমুদিনী হাজংকে টংক আন্দোলনে অংশগ্রহণে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। ফলে স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও লংকেশ্বরের তিনভাইয়ের মতো কুমুদিনী হাজং টংক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ৩১ জানুয়ারি ঘটনার পর কুমুদিনীর পরিবার ও অন্যান্য হাজং নেতারা সরকারের দেয়া হত্যা মামলার আসামী হয়। তখন অনেক দিন কুমুদিনী, তার স্বামী, কুমুদিনীর ভাসুর ওঅনেক হাজং নেতাদের পালিয়ে থাকতে হয়েছে। তার স্বামী ও ভাসুরদের বিনাদোষে প্রায় একবছর হাজতে থাকতে হয়েছিল। কুমুদিনী তখন আত্মগোপনে ছিলেন। এভাবে কুমুদিনী নিজেকে আন্দোলনে জড়িয়ে তার স্বামীর সাথে টংক প্রথার বিরুদ্ধে গারো পাহাড় অঞ্চলের হাজংগ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা চালিয়েছেন। অবশেষে তারা টংক প্রথা নির্মূল করতে পেরেছেন। কিন্তু ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামে আবারো হাজংসহ অন্যান্য আদিবাসীদের চরম অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল।
কুমুদিনী ও তার স্বামী লংকেশ্বর হাজংয়ের পরিবার আগে থেকেই মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত ছিল। কুমুদিনীর বাবা অতিথ চন্দ্র রায় (হাজং) ও তার পূর্ব পুরুষরা ঐতিহাসিক ‘হাতিখেদা বিদ্রোহে’ যুক্ত ছিলেন। জমিদাররা জোড় করে বন্য হাতি ধরার কাজে একসময় হাজংদের নিয়োজিত করতো। এতে অনেক হাজংদের হাতির আক্রমণে জীবন দিতে হয়েছে। ১৭৭০ সাল থেকে জমিদাররা হাজংদের ওপর এ কাজটি চাপিয়ে দিয়ে আসলে হাজংরা এর বিদ্রোহ করা শুরু করে। সেই বিদ্রোহের নাম ‘হাতিখেদা বিদ্রোহ’। হাজংদের জোড়ালো প্রতিবাদে হাতি খেদা প্রথার বিলুপ্তি ঘটলে জমিদারদেরআরেকটি নিকৃষ্ট প্রথা, টংক প্রথা হাজংদের শ্রম কেড়ে নিতে শুরু করে। জমিদারদের এ অন্যায় প্রথা আদিবাসীদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
টংক আন্দোলনের সময় ধরা হয় ১৯৪৬-১৯৫০ সাল। কিন্তু হাজং জনগোষ্ঠী এর অনেক আগে থেকেই টংকের কুফল সহ্য করে আসছিল এবং প্রতিবাদের শক্ত দানা তাদের মনে বাসা বাঁধতেছিল। টংক আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে কৃষক আন্দোলন। টংক মানে ধান কড়ারি খাজনা। টংক প্রথার শর্তানুসারে জমিতে ফসল হোক বা না হোক চুক্তি অনুযায়ী টংকের ধান জমির মালিককে দিতেই হতো। ফলে দেখা যায়, কোন বছর যদি জমিতে ফসল না হয় বা খরা, প্রাকৃতিক দূর্যোগে শস্য নষ্ট হয়ে যায় তবুও কৃষককে তার নির্ধারিত খাজনা পরিশোধ করতে হতো। হাজংরা এ অন্যায় নীতির বিরুদ্ধেও আন্দোলন গড়ে তোলে। হাজংনেতা ললিত সরকার, রামনাথ হাজং, পরেশ হাজং, বিপিন হাজং ও মঙ্গল হাজংসহ অনেক হাজং নারী এ আন্দোলনে এগিয়ে আসে। তাদের মধ্যে রাশিমণি হাজং, সুরূপা হাজং, ভদ্রমণি হাজং, অশ্বমণি হাজং, বিপুলা হাজং, সমাপতি হাজং, মালতি হাজং, যাদুমণি হাজং ও কুমুদিনী হাজং এরকমআরো অনেক নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে। সুসং জমিদারদের ভাগ্নে কমরেড মণি সিংহ এ আন্দোনের অন্যতম প্রধান নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন। ১৯৫০ সালে জমিদার প্রথার বিলুপ্তি সাধন পর্যন্ত তাদের এ টংক আন্দোলন অব্যাহত ছিল।
নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে নির্মিত টংক শহীদ স্মৃতিসৌধে অনেক হাজং কৃষকদেরনাম লেখা আছে। এ আন্দোলনের প্রাণ শক্তিই ছিল মূলত আদিবাসী হাজং কৃষকগণ। কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজংকে তে-ভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি, ময়মনসিংহ ১৯৯৬ সালের ২৫ অক্টোবর সংবর্ধনা দেয়। কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজং মারা যান ২০০০ সালে। কুমুদিনীর তিন ছেলে ও দুই মেয়ে থাকলেও তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। নিজেদের সংসার নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আজ বয়সের ভারে একেবারেই নুয়ে পড়েছেন কুমুদিনী হাজং।কয়েক বছর আগেও কেউ তার সাথে দেখা করতে গেলে তাদেরটংক আন্দোলনের গল্প শোনাতেন কুমুদিনী। ৩১ জানুয়ারির ভয়াবহ ঘটনার কথা এবং রাশিমণি হাজংয়ের অসামান্য কৃতিত্বের কথা বলতেন।তিনি অতীতের সংগ্রামী দিনের কথা মনে করে শোনানোর চেষ্টা করতেন। জানুয়ারির ৩১ তারিখ আসলে তার হৃদয় আন্দোলিত হতো। ঘরে বসে থাকেন না। এদিনে কষ্টকরে হলেও বহেরতলীর সেই ঐতিহাসিক হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধে উপস্থিত হন। রাশিমণির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত রাশিমণি মেলায় অংশ নেন। একমাত্র কালের সাক্ষী হিসেবে হাজংমাতা রাশিমণি মেলার উদ্বোধক হিসেবে তার বিকল্প নেই। কিন্তু আর কতদিন! দারিদ্র্য, অযত্নে ও বয়সের ভারে ধীরে ধীরে এখনতার চিন্তাশক্তিও দুর্বল হয়ে আসছে। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আগের মতো আর চলতে, বলতে পারেন না, মনে করতে পারেন না অতীতের কোন কিছু। এভাবেই কি হারিয়ে যাবে একজন সংগ্রামী চেতনার গল্প! আমরা তার সুস্থ জীবন ও আরো দীর্ঘায়ু জীবন কামনা করি। সে সঙ্গে তাঁর বাসস্থানের স্থায়ী সমাধান চাই।
লেখক- সোহেল হাজং
আদিবাসী অধিকার কর্মী ও কেন্দ্রীয় সদস্য
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।