জুন পর্যন্ত ২৪ জন আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকারঃ হত্যা ৩, ধর্ষণ ১০, অপহরণ ৩
বিশেষ প্রতিবেদন, ৩১ জুলাই, ফাল্গুনী ত্রিপুরাঃ আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুদের প্রতি সহিংসতার মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের শুরুতে বিভিন্ন বয়সের আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা বা হত্যার চেষ্টা, পাচারের চেষ্টা, শারীরিক লাঞ্চনার শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা কাপেং ফাউন্ডেশনের অনুসন্ধানী তথ্য মতে, ২০১৬ জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত মোট ২৪ জন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু বিভিন্ন ধরণের শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২৪ টি ঘটনার মধ্যে ১৪টি সমতল অঞ্চলে, বাকী ১০টি পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হয়েছে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৮ জন নারী ও কন্যা শিশু শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ১৮ জন ঘটনার শিকার নারী ও কন্যা শিশু সমতল থেকে। বাকী ১০ জন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে। সংগঠনটির তথ্য মোতাবেক ৬ টি ধর্ষণের চেষ্টা, ৫টি শারীরিক লাঞ্চনা, ৬টি ধর্ষণ, ৪টি দলবদ্ধ ধর্ষণ, ৩টি ধর্ষণের পর হত্যা, ১টি শারীরিক ও যৌন নির্যাতন এবং ৩টি অপহরণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, নির্যাতনের শিকার আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুদের বয়স ৩ থেকে ২৪ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এর মধ্যে ১৬টি ঘটনার মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রায় মোট ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলেও পুলিশ অধিকাংশ নির্যাতনকারীদের গ্রেপ্তার করেনি। আবার গ্রেপ্তার করলেও কয়েকদিনের মধ্যে আসামীরা জামিন নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়ছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে বলে সচেতন মহল অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে ৫৪টির অধিক জাতিগোষ্ঠীর ৩০ লক্ষ আদিবাসীর বসবাস রয়েছে যাদের অর্ধেক অংশ নারী। আদিবাসী নারী সমাজের উপর যুগ যুগ ধরে পারিবারিক, সামাজিক, সামপ্রদায়িক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়ন চলে আসছে। বাংলাদেশের আদিবাসীরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হওয়ায় আদিবাসী নারীরা আরো বেশি প্রান্তিকতার শিকার। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে বা নীতি নির্ধারণের পর্যায়ে প্রান্তিক ও সুবিধা বঞ্চিতদের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় সরকারী উন্নয়ন কর্মসূচীগুলোতে আদিবাসী নারীরা অগ্রাধিকার পান না। আদিবাসী নারী নেত্রীরা অভিযোগ করেছেন, জাতীয় পর্যায়ে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবেলার অনেক পরিকল্পনা ও আইন থাকলেও তা আদিবাসী নারী বান্ধব নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভূমি বিরোধ ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের কারণে সংখ্যালঘু আদিবাসী নারীরা সহিংসতার শিকার এবং অধিকাংশ ঘটনাই অ-আদিবাসী দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। কাপেং ফাউন্ডেশন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতার মূল কারণ হিসেবে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া, অপরাধীদের বিচার না হওয়া, দীর্ঘায়িত ও অসহযোগিতামূলক আইনী ব্যবস্থাকে দায়ী করেছে।
আদিবাসী নারীদের উপর দিন দিন নির্যাতন বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রাখি দাশ পুরকায়স্থ বলেন, দেশব্যাপী নারীদের উপর নির্যাতন চলছে। তাছাড়া সমাজের মূল্যবোধেরও চরম অবক্ষয় হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে নারীর উপর সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নির্যাতনের ধরণ ও ব্যাপ্তি এখন পাল্টে যাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশও এখন নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এতে করে আদিবাসীরা যেখানে অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছে সেখানে আদিবাসী নারীরা শুধু নারী হিসেবে নয়, প্রথমত আদিবাসী হিসেবে, দ্বিতীয়ত আদিবাসী নারী হিসেবে নির্যাতন ও প্রান্তিকতার শিকার হচ্ছে।
বিচার না পাওয়ার কারণ হিসেবে কাপেং ফাউন্ডেশনের পল্লব চাকমা প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আইনের ধারাসমূহ যথাযথ কার্যকর না হওয়া, বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয় না থাকা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের যুগ্ম আহ্বায়ক চৈতালি ত্রিপুরা বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ, বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি, নারী পুরুষের সমানাধিকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্তকরণ, সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে আদিবাসী নারী কর্মকর্তা নিয়োগ হলে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার মাত্রা কিছুটা কমবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।