জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামে বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার নিশ্চিতের আহ্বান টনি চিরানের

আইপিনিউজ আন্তর্জাতিক ডেস্ক,নিউইয়র্ক: জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ২৪তম স্থায়ী ফোরাম (UNPFII)-এর অধিবেশনে বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের প্রতিনিধি টনি চিরান ২৫ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে একটি বক্তব্য প্রদান করেছেন। জাতিসংঘের ফোরামের ছয়টি ম্যান্ডেটেড ক্ষেত্র-অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকার নিয়ে আলোচনার সময় তিনি বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
টনি চিরান তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। তবে তিনি বলেন, আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার ও উন্নয়নমূলক ছয়টি ক্ষেত্রেই বাস্তব অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর এবং অনেকক্ষেত্রে অবরুদ্ধ। বরং সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসীদের প্রতি সহিংসতা, জমি দখল ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে।
তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন ১৫ জানুয়ারি ২০২৫-এর এক মর্মান্তিক ঘটনার কথা। সেদিন “Students for Sovereignty” নামক একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী ঢাকায় আদিবাসীবিষয়ক পাঠ্যবই থেকে আদিবাসী বিষয়বস্তু অপসারণের প্রতিবাদ জানানো আদিবাসী শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এতে ২০ জন আদিবাসী গুরুতর আহত হন। এই সহিংসতার ঘটনায় এখনো পর্যন্ত বিচার হয়নি, বরং অভিযুক্তদের অনেকেই ছাড়া পেয়ে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, রাঙামাটি সদর ও খাগড়াছড়ি শহরে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় তিনজন আদিবাসী নিহত হন এবং অন্তত ২০ জন আহত হন। এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর কাঠামোগত নিপীড়নের অংশ, যা আদিবাসীদের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
টনি চিরান তাঁর বক্তব্যে বিশেষভাবে আদিবাসী জনগণের ভূমি অধিকার ও জবরদখল ইস্যু তুলে ধরেন। তিনি জানান, আদিবাসীদের পূর্বপুরুষের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে উন্নয়নের নামে—যেমন, এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন, ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্প, রাবার শিল্প ও সেনা ক্যাম্প নির্মাণ। তিনি টাঙ্গাইল, শেরপুর, গাজীপুর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ সমতল এলাকার সম্প্রদায়গুলোর উচ্ছেদের হুমকির কথা তুলে ধরেন। সিলেট অঞ্চলে চা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে খাসি ও গারোদের জমি দখলের অভিযোগও তিনি উত্থাপন করেন।
টনি চিরান আরো বলেন, যারা এইসব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন, সেই আদিবাসী মানবাধিকার কর্মীদেরই রাষ্ট্র বারবার অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করছে। মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার ও হয়রানি যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে আদিবাসী নারী ও কিশোরীরা ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২৪ সালে অন্তত ২৫টির বেশি ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা রেকর্ড হয়েছে, যার বেশিরভাগই ভূমি দখল-সংক্রান্ত বিরোধের সাথে সম্পর্কিত।
তিনি আরো বলেন, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি এখনো পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়নি, যা সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দৃষ্টান্ত। এছাড়াও, সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রতিশ্রুত পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের উদ্যোগও আজও অধরা রয়ে গেছে।
বক্তব্যের শেষ অংশে টনি চিরান জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামের কাছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই আদিবাসীদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন, জমি দখল এবং তাদের সম্মতি ব্যতিরেকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ করতে হবে। তিনি সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও আদিবাসী অধিকার আইন কার্যকর করার দাবি জানান। একই সঙ্গে তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে আদিবাসীদের বাস্তব পরিস্থিতি সরেজমিনে মূল্যায়ন করার আহ্বান জানান। পাশাপাশি, আদিবাসী অধিকার রক্ষার জন্য একটি সুসংহত কাঠামো ও স্থায়ী মেকানিজম গঠনের প্রস্তাব দেন।