মতামত ও বিশ্লেষণ

জাতীয় বাজেট ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী : আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সুনিশ্চিতকরণের প্রস্তাবনা – খোকন সুইটেন মুরমু

আদিবাসী পরিচিতি সংকট, আদিবাসী জনসংখ্যার সঠিক হিসাবে গরমিল ও বাজেট নিরুপনে জটিলতা
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশে দীর্ঘকাল থেকে আর্থ-সামাজিক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও অনেকে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেন এবং নানা বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এ আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহকে বিভিন্নভাবে পরিচিত করেছেন, যেমন ‘উপজাতি’, ‘ট্রাইবাল’, ‘ইনডিজিনাস পিপলস’ ও ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ইত্যাদি। রাষ্ট্র সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ২৩(ক) উপধারার মাধ্যমে এ জাতিসত্তাসমূহকে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ হিসেবে সংবিধানে উল্লেখ করেছেন । দেশের মূলস্রোতের আরোপিত সাম্প্রদায়িক এ প্রত্যয়গুলোর উর্দ্ধে থেকে রাষ্ট্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের চিরন্তন অভিব্যক্তিকে উপলব্ধি করে এ জাতিসত্তাসমূহকে ‘আদিবাসী’ হিসেবেই পরিচয় দিবেন, এটা আদিবাসীদের দাবি। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ বঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত ও অনগ্রসর অংশের মধ্যে অন্যতম। সরকারি পরিসংখ্যান মতেও, বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রায় অর্ধেক দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। তাদের মাথাপিছু আয়ও অনেক কম। আইডিপিএ, প্রশিকা ও সমুন্বয় কর্তৃক গবেষণা ‘দি বাজেট ম্যাকিং প্রসেস’ এর মধ্যেও প্রান্তিক কৃষকদের বাজেট প্রণয়নের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল উভয় অঞ্চলের আদিবাসীদের সিংহভাগ জীবিকা এখনও সনাতন জুম চাষ ও কৃষি নির্ভরশীল। সমতলের আদিবাসীদের দুই-তৃতীয়াংশ বর্তমানে ভূমিহীন। তার ওপর আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে বিরোধ সর্বত্র। সমতলের আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী ভূমি সমস্যার কারণে আজ প্রান্তিক জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। তাই প্রান্তিক কৃষকদের সাথে আদিবাসী কৃষকদেরকেও জাতীয় বাজেটের আওতায় আনা উচিত।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৫ কোটি ৫৮ লাখ । আদিবাসী জনসংখ্যা ১৫,৮৬,২৩২ জন । আদিবাসী জনগণ, এ হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১.১০ ভাগ। ২০১১ সালের আদমশুমারীতে ১৭ লক্ষ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পরিসংখ্যান পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের দাবি, বাংলাদেশে ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ বাংলাদেশে বসবাস করেন । বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাথে সরকারি পরিসংখ্যানে জনসংখ্যা নিরুপনের বিস্তর এ ব্যবধান, সত্যি ভাবার বিষয়। সমতল এবং পাহাড়ের আদিবাসীদের নিয়ে কর্মরত মানবাধিকার সংগঠন ‘কাপেং ফাউন্ডেশন’ সহ বিভিন্ন আদিবাসী জাতিসত্তার নেতৃবৃন্দ ও তাদের নেটওর্য়াকসমূহের মতে, বাংলাদেশে ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতিসত্তার কমপক্ষে ৩০ লক্ষ লোকের বসবাস রয়েছে । আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আদমশুমারীর আগে সরকারি কর্মকর্তারা কর্মীদের সঠিক নির্দেশনা প্রদান করেন না বিধায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী খানা জরিপ থেকে বঞ্চিত হন। সেই সাথে কর্মকতা ও কর্মীদের আদিবাসী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণেও খানা জরিপে আদিবাসীদের সঠিক চিত্র ফুটে উঠে না। যেমন- ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০-এ মাত্র ২৭টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সেখানে উল্লেখিত ‘উসুই’ জনগোষ্ঠী ত্রিপুরা জাতির অন্তর্ভুত এবং ‘মং’ নামে কোন জনগোষ্ঠী নেই। উল্লেখ্য, এই আইনে কমপক্ষে আরো ২৭টির অধিক আদিবাসী জাতির নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আদিবাসী জনসংখ্যার সঠিক তথ্যের সার্বজনীনতা না থাকার কারণে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা এখনও নির্দিষ্ট হয়নি। ফলশ্রুতিতে জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের বরাদ্দও হয়ত সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক ও পৃথক পরিসংখ্যান এবং ভৌগলিক মানচিত্রায়নের অভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দে বৈষম্য

অনেক ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সরকার বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। এ যাবত পাঁচবার আদমশুমারি হওয়া সত্ত্বেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক ও পৃথক পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। পৃথক পরিসংখ্যান না কারণে আদিবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন, মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায় না। আদিবাসী সংখ্যার সঠিক ও পৃথক পরিসংখ্যান না থাকায় সঠিকভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাজেট প্রণয়নে সরকার ব্যাহত হচ্ছে। জাতীয় বাজেটে সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দের চিত্র দেখলে বুঝা যায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রে নাগরিক সুযোগ সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমতা এবং আদিবাসীদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা গেলেই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ও সমতল আদিবাসীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা’ প্রকল্পের বাজেট নিরীক্ষণ করলে বাজেট বৈষম্যের বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর বাজেট জনসংখ্যার বিচারে বরাবরই অপ্রতুল
প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ছে। বিগত ২০১০-১১ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটসমূহে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আদিবাসীদের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ রাখা হয়। ২০১৫ ও ২০১৬ সালের বাজেটে স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)’ এর বরাদ্দ সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক ক্ষমতায়ও এর আওতায় আলাদাভাবে রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন বরাদ্দ এবং তা বাস্তবায়ন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিগত ৭ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাজেট সারণীতে পর্যায়ক্রমে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, বাজেট বৃদ্ধির হার কতটুকু মন্থর। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে (‘ঘ’ খন্ডের ৯নং ধারায়) “সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের লক্ষ্যে অধিক সংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করিবেন। এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরী করার লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করিবেন এবং সরকার এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করিবেন” বলে উল্লেখ রয়েছে।
২০১৫-২০১৬ সালের অর্থ বছরে ৭৭৯ কোটি টাকা এবং ২০১৬-২০১৭ সালের অর্থবছরে ৮৪০ কোটি বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গত ২০১৫-২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়েনি ৭৭৯ কোটি টাকায় স্থবির ছিল। বাজেটের আকার বাড়ছে প্রতি বছর কিন্তু ২০১৬-১৭ বাজেটে বিগত বছরের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৭.৮৩ শতাংশ বেড়েছে। পক্ষান্তরে, জাতীয় বাজেটের বৃদ্ধির হার ছিল ১৫.৪২ শতাংশ। সহজে অনুমেয় যে, মূল বাজেটে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য সরাসরি বরাদ্দ পাওয়া কঠিন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নের জন্য ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ এর বাজেট বাঙালি ও আদিবাসী জনসংখ্যার বিচারে বরাবরই অপ্রতুল। পার্বত্য চট্টগ্রামের সব বাসিন্দা আদিবাসী ও বাঙালিদের জন্য উন্নয়নমূলক বরাদ্দ মূলত সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয়। সুতরাং বরাদ্দকৃত সকল অর্থ শুধু আদিবাসীদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্যে ব্যবহৃত হয়না। অধিকন্তু উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া উন্নয়নের ফলে পার্বত্যাঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপকারের পরিবর্তে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্স ইত্যাদি কমিটির জন্য কোন পৃথক বাজেট বরাদ্দ করা হয় না। উল্লেখ্য যে, স্বতন্ত্র বাজেট বরাদ্দের অভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির কোন অফিস ও জনবল নেই। ফলে কমিটির পক্ষে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণের কাজ চালিয়ে নেয়া কঠিন। অন্যদিকে ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা হলেও কমিশনের বাজেট বরাদ্দের অভাবের কারণে কমিশনের কাজ চালিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তহবিল না থাকায় কমিশনের পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করা যাচ্ছে না (বর্তমানে মাত্র দুইজন স্টাফ রয়েছে) এবং রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় শাখা অফিস স্থাপন করা যাচ্ছে না। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্স গঠিত হলেও পুনর্বাসনের জন্য কোন বরাদ্দ প্রদান করা হয়নি। অর্থের টাস্ক ফোর্স যেমন অর্থব অবস্থায় পড়ে আছে, তেমনি ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ অচলাবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে।

সমতল আদিবাসীদের জন্য সরকারি বরাদ্দ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের Development Assistance for Special Area (except CHT) বা “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)” শীর্ষক কর্মসূচি সংক্রান্ত তথ্যানুযায়ী উল্লেখকৃত যে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে বাস্তবায়নাধীন “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)” শীর্ষক কর্মসূচির কার্যক্রম ১৯৯৬-৯৭ সালে ৫ কোটি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে শুরু করা হয়েছে যা আজও চলমান। দেশের বিভিন্ন জেলার সমতল ভূমিতে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য। কর্মসূচিটি শুরু থেকে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কর্মসূচির অনুকূলে বিগত ২০১০-১১ হতে ২০১৬-১৭ বিগত ৭টি অর্থ বছরে মোট ১১৬.০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এই কর্মসূচীর উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মসূচির মাধ্যমে সমতলের আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।
চিত্র ২: সমতলের আদিবাসীদের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ, ২০১০-১৭ (কোটি টাকায়)

সমতলের আদিবাসীদের জন্যে বিগত ৭ বছরের ৬১ টি জেলার পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ মোটেই সঙ্গত নয়। সরকারি পরিসংখ্যানের মতে, হিসাব কষলে বিগত ২ টি অর্থ বছরে ১ জন আদিবাসীর জন্য গড়ে বাজেট হয় ১০০ টাকা। অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত এক আদিবাসীর পক্ষে এ অসামঞ্জস্য বাজেট নিয়ে কতটুকু উন্নয়ন সম্ভব? ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ২০ কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)” বরাদ্দ ছিল। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরেও বরাদ্দ বছরে স্থবির থাকে ২০ কোটি টাকায়। ২০১০-১১ হতে ২০১৫-১৬ সালের মধ্যে ৪০০টি প্রকল্পে ৪,৫৬২.২৭ লক্ষ টাকা ২৭০ টি উপজেলায় ১,০৬,০৫০ জন উপকারভোগীর মধ্যে বন্টন করা হয়েছে । সমতলের প্রায় ২০ লক্ষাধিক আদিবাসীদের জন্য মাত্র ২০ কোটি টাকা বার্ষিক বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত কম। আবার এই বন্টন প্রক্রিয়ার মধ্যেও রয়েছে প্রশাসনিক মধ্যস্বত্বভোগী জটিলতা। জাতীয় বাজেট প্রতি বছর বৃদ্ধি পেলেও সমতলের আদিবাসীদের বাজেটে বরাদ্দ বাড়েনি।
আদিবাসীদের জন্য জাতীয় বাজেটে পৃথক ও বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন
সমতলের আদিবাসীদের জন্য ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা’ তহবিল হতে যেখানে ২৮টি জেলার ৪১ টি উপজেলায় আদিবাসীদের সহায়তা প্রদান করা হতো এখন সেখানে আরও ৬১টি জেলার ২৭০টি আদিবাসী অধ্যুষিত উপজেলা সংযুক্ত হয়েছে। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ আদিবাসী জনসংখ্যার সমানুপাতিক হারে বাড়েনি। প্রকল্পের আওতায় আবার প্রতি বছর সব উপজেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে একসাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ প্রদান করা হয় না। বেশিরভাগ উপজেলার আদিবাসীরা তাই এ সহায়তা থেকে বঞ্চিত থাকেন। প্রকল্পের আওতায় সংশ্লিষ্ট উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে এ সহায়তা প্রদান করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে এবং উপজেলার বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় কয়েকজন আদিবাসী প্রতিনিধিসহ একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে এ অর্থ বন্টনের কাজ করা হয়। সমতলের আদিবাসী জনগণও খুব ভালোভাবে এ অর্থ বরাদ্দের সুষ্ঠু বন্টন প্রক্রিয়া সর্ম্পকে অবগত নয়। আবার বিভিন্ন জায়গায় এ অর্থ বন্টনের স্বচ্ছতা নিয়েও আছে নানান প্রশ্ন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চুক্তি অনুসারে স্থানীয় সরকারের বাজেট বৃদ্ধি ও পার্বত্য ভূমি কমিশনে জনবল নিয়োগের জন্য বিশেষ বরাদ্দ সময়ের দাবি। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী শিশুদের জন্য সরকারের গৃহীত নিজ মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচী জোরদারের জন্য বাজেট বৃদ্ধি ও সেই সাথে নিজ নিজ ভাষা পড়ানোর জন্য আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগের জন্যও বাজেটে বরাদ্দ প্রয়োজন। জাতীয় বাজেটে পৃথকভাবে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ না দেওয়া পর্যন্ত এ বন্টন প্রকৃয়ায় সুষ্ঠ জবাবদিহীতা ও স্বচ্ছতা আনা সম্ভব নয়। আদিবাসী জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটছে না। তাই জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহীতা সুনিশ্চিতের জন্যই আদিবাসীদের জন্য জাতীয় বাজেটে পৃথক ও বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও আদিবাসী জনগণ

জাতীয় বাজেটে শুধু বাংলাদেশের উন্নয়নশীল নাগরিকের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের রূপকার এমন নয়। সাংবিধানিকভাবে প্রতিটি নাগরিকের অধিকারের প্রতিফলিত রূপ জাতীয় বাজেট। প্রতিটি নাগরিকের, পিছিয়ে পড়া ও অবহেলিত মানুষের এবং অনুন্নত জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত উন্নয়নের জন্যে সংবিধানের ১৯ (১) অনুচ্ছেদে সুষম জাতীয় উন্নয়ন এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ সুতরাং জাতীয় বাজেটের স্থানীয় সরকারের বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে পিছিয়ে পড়া ও আদিবাসী জনগণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অতন্ত্য পরিতাপের বিষয়, ২০১৫-১৬ (সংশোধিত) ও ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সরকার সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচীর আওতায় বিগত ৩ অর্থ বছরে ১৬০টি উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের ৪০০টি বৃহৎ আকারের আয়বর্ধনমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। সমতলের সহজ সরল আদিবাসীরা আমলাতন্ত্রের জটিলতার মধ্যে কতটুকু এই উপকার ভোগ করতে পেরেছে, তা খুব সহজেই অনুমেয়। কারণ বন্টনের মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগীরা ফায়দা নিয়ে থাকেন।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বা (এসডিজি ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা) সূচক নির্ধারণে আদিবাসীদের প্রান্তিকতার শীর্ষে দেখানো হলেও তারা সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকির রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যেমন ভিজিএফ, ভিজিডি, কাবিখা, কাবিটা ইত্যাদিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সাধারণত অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। সাধারণ আদিবাসী মানুষ এ সেবা থেকে সবসময় বঞ্চিত থেকেছেন। অনগ্রসর আদিবাসী জনগোষ্ঠী এজন্য চরম দ্রারিদ্র সীমার দিকে ধাবিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত তাঁর গবেষণা পুস্তিকা ‘বাংলাদেশের কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ মধ্যে লিখেছেন, ‘প্রান্তিকতার যত মাত্রা জানা আছে তার সবটাই আমাদের দেশের আদিবাসী মানুষের জন্য পূর্ণমাত্রায় প্রযোজ্য। আদিবাসী মানুষের জমি ও বন দখলে বিভিন্ন রূপের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেশ রীতিতে পরিণত হয়েছে। আর এসবে সরকার-রাষ্ট্র কখনও প্রভাবক কখনও নির্বিকার। আদিবাসী মানুষের আর্থিক উন্নয়নের জন্যে তাই প্রয়োজন সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ। বাংলাদেশ সরকার ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১৫-১৬ হতে ২০১৯-২০) ১৪ নং অনুচ্ছেদ এ ‘সামাজিক সুরক্ষা, সামাজিক কল্যাণ ও সামাজিক অন্তর্ভূক্তি’ অংশে ‘সামাজিকভাবে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সেবা’র জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কৌশলগত এ প্রক্রিয়ায় ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক মূলধারার সামাজিক বৈষ্টনীর মূলধারায় নিয়ে আসতে একটি কার্যকর নালিশ ও অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা’ তৈরির প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে । ২০১৬-১৭ সংশোধিত বাজেট থেকেই সরকার এ প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটাবেন এটাই আদিবাসী জনগণের প্রত্যাশা।

বাজেট বরাদ্দে সরকারের নীতি ও চুক্তির বাস্তব প্রতিফলন প্রয়োজন

সংবিধানের ২৩ (ক) অনুচ্ছেদ মতে রাষ্ট্র আদিবাসীদের কাছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহন করিবেন’ সংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরম্পরা টিকিয়ে রাখতে এবং বিকাশ ঘটাতে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। বাস্তবে, বাংলাদেশের দ্রারিদ্র নিরসন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) মধ্যেও আদিবাসীদের অংশগ্রহন খুবই যৎসামান্য। উন্নয়ন কৌশলের মধ্যে আদিবাসীদেরকে সেভাবে আদিবাসীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে বাজেটে রুমা উপজেলায় বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ মঞ্জুরী থেকে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের জন্য পাঁচতলা অফিস-কাম-কম্যুনিটি হল নির্মানের জন্য বরাদ্দ ছিল যার পরিমাণ ৩ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা। হালুয়াঘাট, দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমীর জন্য সব মিলিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি টাকা। এই ক্ষুদ্র বাজেট দিয়ে দেশে অবস্থারত ৩০ লক্ষ্য আদিবাসী জনগণের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। আদিবাসী জনগণের আশা, আগামী বাজেটে গত অর্থবছরের চেয়ে আদিবাসীদের জন্য উন্নয়নের খাতগুলিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বাজেট আরো বৃদ্ধি করবেন।

বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কিত বেশকিছু রাষ্ট্রীয় নীতি বা আইন যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ ইত্যাদি রয়েছে। এ নীতিসমূহের প্রকৃত বাস্তবায়নের জন্যও এ বাজেটে অপ্রতুল। সরকারের ৫ম ও ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য যথাযথ উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে বলে উল্লেখ করলেও তা জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। সরকার ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অনুচ্ছেদ-১৪ তে, নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর জন্যে উন্নয়ন কৌশলের কথা বলেছেন। প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন জাতিসংঘের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, ভূমি অধিকার, নৃতাত্বিক জনগণের ক্ষমতায়ন, শিক্ষা-ভাষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য এই সমস্ত নীতি-চুক্তির ও আগামী কর্ম-কৌশলের তেমন কোন রূপরেখা কিন্তু আজও জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। আদিবাসীদের মধ্যে নিরঙ্কুশ দারিদ্র ও চরম দারিদ্রের হার যথাক্রমে ৬৫ শতাংশ ও ৪৪ শতাংশ। চরম দারিদ্র আদিবাসীদের কাজ খুঁজে পাবার সামর্থ্যও তাই কম, যা তাদের অবস্থাকে আরও করুণ করে তোলো। আগামী বাজেটে সরকারের তাই আদিবাসী জনগণের চরম দারিদ্রতার কথা ভেবে বাজেট প্রণয়ন করবেন, আশা রাখছি।

নির্বাচনী অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন জরুরী প্রয়োজন

‘আদিবাসী মানুষ-পাহাড়-সমতল নির্বিশেষে নিরন্তর বঞ্চিত। পার্বত্য হোক আর সমতল হোক-আদিবাসী মানুষ হিসাবে উন্নয়নের কোন মানদন্ডেই ভাল নেই। জমি-জলা-জঙ্গল-এ আদিবাসী মানুষের মালিকানা বা অভিগম্যতা নেই (সামাজিক, প্রথাগত, ঐতিহ্যগত, গোষ্ঠীগত, ব্যক্তিগত)- এ মানদন্ডে আদিবাসী মানুষের হয়েছে আধোগতি। আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থানীয় উদ্যেগ, স্থানীয়-শাসন-কোন কিছুতেই তাদের এখন মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। ১৯৯৭ সালে (০২ ডিসেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার প্রায় ২০ বছর পরেও এখনও পর্যন্ত পার্বত্য আদিবাসী মানুষের মধ্যে বঞ্চনা-বৈষম্য হ্রাসকারী জনকল্যাণকারী কোন স্থায়ী উন্নয়নের সুলক্ষণ প্রতিভাত হয়নি।’ আর্থিক বাজেটের মধ্যেও সরকারের প্রতিশ্রুতি শুধু প্রতিশ্রুতি হিসেবেই আছে।
আওয়ামীলীগ ৯ম জাতীয় সংসদ (২০০৮) নির্বাচনী ইশতেহারের ১৮.১ দফায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে ‘আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকার সনাতনি অধিকারের সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করবে।’ ১৮.২ দফায় প্রতিশ্রুতি দেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।’ ৯ম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর ১০ম সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন জোট পুনরায় সরকার গঠন করলেও সেসব প্রতিশ্রুতি এখনো শুধু কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। আওয়ামীলীগের ‘দিন বদলের সনদে’ ১০ম জাতীয় সংসদ (২০১৪) নির্বাচনী ইশতেহারে ২২.১ ও ২২.২ বিগত ২০০৮; ১৮.১ ও ১৮.২ অনুচ্ছেদ দু’টি সামান্য পরিবর্তন হয়েছে, প্রতিশ্রুতি প্রায় একই আছে। দিন বদলের সনদ আদিবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তনের সহায়ক হয়নি।
উত্তরের আদিবাসীদের জীবিকা মূলত কৃষি নির্ভর। সেজন্যেই ভূমি সমস্যার সমাধান আশু জরুরী। সরকারের উচিত হবে সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্যে যতক্ষন পৃথক ভূমি কমিশন গঠন না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে ও পৃথক পার্বত্য ভূমি কমিশনে সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্যে পৃথক সেল গঠন করা। পৃথক ভূমি কমিশনের সেই সেল এর দায়িত্ব সমতল আদিবাসীদের জন্যে হলে তাদের সমস্যা অনেকাংশেই লাঘব হবে। বর্তমান সরকার নৃ-গোষ্ঠী সন্তানদের শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত করা, পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা, তিন পার্বত্য জেলার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রাখা, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রানি সম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ, তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ সহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের বিকাশে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিশ্রুতিগুলির দিকে বর্তমান জোট সরকারের নজর দেওয়া উচিত।

মন্ত্রণালয় ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ

আদিবাসীদের উন্নয়ন ও অধিকার সংক্রান্ত যে সকল প্রতিশ্রুতি, চুক্তি ও নীতি রয়েছে সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের তরফ থেকে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন রয়েছে। এর সাথে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনমান উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ রাখাও জরুরি। অন্যথায়, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা অনগ্রসরতা থেকে মুক্তি পাবে না। তবে কম হোক বেশি হোক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থাকার কারণে সেখানকার অধিবাসীদের উন্নয়নে বাজেটে যে বরাদ্দ হয় সেটাতে আদিবাসীদের একধরনের কর্তৃত্ব বা প্রাধান্য থাকার সুযোগ আছে।
কিন্তু সমতলের আদিবাসীদের জন্য কোন মন্ত্রণালয় না থাকার কারণে এখানে সেই সুযোগটিও নেই। সমতলের আদিবাসীদেরকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় কিছু টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। এ বরাদ্দে আদিবাসীদের প্রকৃতপক্ষে কোনো অংশগ্রহণ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশাধিকার সমতলের আদিবাসীদের জন্য সহজ নয়। সেই ভাবনায়, কিছু সময় পর্যন্ত সমতলের আদিবাসীদের বিষয়টিও পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত করার দাবি সমতলের আদিবাসীদের। যেখানে একজন যুগ্ম-সচিব মর্যাদার কর্মকর্তা বা সম-মর্যাদার একজন এ বিষয়টি দেখভাল করবেন, যাকে আদিবাসীদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের অধিকার সুনিশ্চিতকরণের প্রস্তাবনাসমূহ
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের চাহিদা অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দকরণ। তাহলে তারা দেশের মূলস্রোতের জনগণের সাথে সামনে অগ্রসর হতে পারবে। নিজেরাই তখন ক্রমান্বয়ে অনগ্রসরতা কাটিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। ২০১৫ সালে ঢাকায় ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস’ যৌথভাবে ‘জাতীয় বাজেটে আদিবাসী জীবনের প্রতিফলন’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর, অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত-নির্যাতিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকরণের ক্ষেত্রে যেসব সুপারিশমালা দেওয়া ছিল তারই আলোকে কিছু প্রস্তাবণা আদিবাসী অধিকার সুনিশ্চিতকরণের জন্য বিবেচ্য হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি-

• সকল মন্ত্রণালয়ের/বিভাগের বাজেটে আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে এবং বরাদ্দের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আদিবাসীদের সম্পৃক্ত করতে হবে, সে বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য খাতভিত্তিক ও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে;

• জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের জন্য পৃথক অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করতে হবে। এবং বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসী বিষয়ে বিবরণী থাকতে হবে। সেই সাথে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করে বাজেট বরাদ্দ আদিবাসীদের সংখ্যার ভিত্তিতে বৃদ্ধি করতে হবে;

• পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহের বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের জন্য পৃথক বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম সামগ্রিক উন্নয়ন বাজেট প্রণয়নসহ যাবতীয় উন্নয়ন বরাদ্দ ও সকল উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান করার প্রক্রিয়া কার্যকর করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে;

• বাজেট বরাদ্দ সাধারণত হয় মন্ত্রণালয়ভিত্তিক। সমতলের আদিবাসীদের বিষয়টি দেখার জন্য যেহেতু কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নেই, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই থোক বরাদ্দ পরিচালনার জন্য সমতলের আদিবাসীদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি বা বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীর বাস সমতলে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সঠিকভাবে বাজেট বরাদ্দ করতে হবে;

• আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমীগুলোতে আদিবাসী সংস্কৃতি উন্নয়নে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু নাচ-গান নয়, গবেষণার দিকে মনযোগী হতে হবে এবং এ খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমীগুলোতে আদিবাসী সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে;

• সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও সামাজিক ক্ষমতায়নের বাজেট খাতে আদিবাসী উপকারভোগী যাতে নিশ্চিত হয়, তার জন্য এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।

• উচ্চ শিক্ষা ও কারিগরী শিক্ষায় বৃত্তিসহ আদিবাসী নারী ও তরুণদের আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। আদিবাসী শিশুদের জন্যে গৃহীত নিজ মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা সুষ্ঠভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।

তথ্যসূত্র:
১. বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, সংহতি (২০১৬), আদিবাসী শিক্ষা, ভূমি ও জীবনের অধিকার।
২. KAPAEENG Foundation. 2016. Human Rights Report 2016 on Indigenous Peoples in Bangladesh.

৩. বারাকাত, আবুল। বাংলাদেশের কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি। ২০১৬। মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা।
৪. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পরিকল্পনা কমিশন। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। ২০১৬। বাংলাদেশ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি), বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
৫. সঞ্জীব দ্রং, জাতীয় বাজেটে আদিবাসী জীবনের প্রতিফলন, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, ঢাকা ২০১৫।
৬. ভট্টাচার্য, দেবপ্রিয়, আহমেদ, সাইদ। ২০০৬। বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) মূল প্রতিপাদ্য ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
৭ . IDPA, PROSHIKA, SHAMUNNAY. 2002. The Budget-Making Process. The University Press Ltd.
৮. Barakat, Abul. 2016. Political Economy of Unpeopling of Indigenous Peoples; The Case of Bangladesh. Muktobuddhi PROKASANA..

খোকন সুইটেন মুরমু, কাপেং ফাউন্ডেশন। ই-মেইল: [email protected]
২৪ মে ২০১৭। নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
‘জন-বাজেট সংসদ ২০১৭’ সভায় ‘অর্ন্তভুক্তি বাজেট বিষয়ক অধিবেশন’ এর আদিবাসী বাজেট প্রস্তাবনার প্রবন্ধ হিসেবে উপস্থাপিত।

Back to top button