গত সাত মাসে সর্বমোট ৪৮৯ জন আদিবাসী মানবাধিকার লংঘনের শিকার
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি — কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন

আইপিনিউজ ডেস্ক: ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে আশা ছিল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু, কাপেং ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ মানবাধিকার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত সময়ে ভূমি দখল, মিথ্যা মামলা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন, মানবাধিকার কর্মীদের ওপর হামলা ও গ্রেফতার- এসব ঘটনা উদ্বেগজনক বৃদ্ধি ঘটেছে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
নারীর উপর সহিংসতা: এই সময়ে আদিবাসী নারীর উপর মোট ২৪টি সহিংস ঘটনার খবর নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ২১টি পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং ৩টি সমতলে ঘটেছে। ৪ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২ জন ধর্ষণের পর হত্যা, ৭ জন যৌন হয়রানির শিকার, ৫ জনকে ধর্ষণ চেষ্টা, ১ জনকে শ্লীলতাহানি এবং ৩ জনকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। এ ঘটনায় অন্তত ৬টি মামলা হয়েছে এবং ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ভূমি বেদখলের ঘটনা: ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই সময়কালে পার্বত্য চট্টগ্রামে একাধিক ভূমি দখলের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো রাঙামাটির বরকল উপজেলায় আদিবাসীদের নিজস্ব জমি দখল করে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের চেষ্টা। একই সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী ৩৯টি জুম ও ফলচাষি পরিবারের মোট ১৩০ একর জমি দখলের চেষ্টা চালায়। এছাড়া, নিরাপত্তা বাহিনী একটি বৌদ্ধ বিহারের জমি দখলের চেষ্টা করে এবং সেখানে থাকা প্রায় ৩০০টি গাছ কেটে ফেলে। পাশাপাশি, বেসরকারি কোম্পানিগুলোর দ্বারাও আদিবাসীদের জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে, যা সামগ্রিকভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক টিকে থাকার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘন: ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সময়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘনের মোট ৩২টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ১৭০ জন। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩২টি এবং সমতলে ২টি ঘটনা ঘটেছে। লঙ্ঘনের ধরনগুলোর মধ্যে ছিল নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা পণ্য বিক্রি বাধাগ্রস্ত করা, নির্বিচার গ্রেফতার, মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার, ভূমি দখলকারীদের দ্বারা মারধর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, বিজিবি কর্তৃক আটক ও হয়রানি, নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা বাড়ি তল্লাশি, ভাঙচুর ও হুমকি, আটক অবস্থায় মৃত্যু, গুলিবর্ষণ, বাঙালি বসতিস্থাপনকারীদের হামলা, সংঘাতজনিত কারণে ২৮ জনের বাস্তুচ্যুতি এবং ৩০ জন শিশুকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে রূপান্তর করা। এসব ঘটনা শুধু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনই নয়, বরং ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিরাপত্তার জন্য গভীর হুমকি সৃষ্টি করেছে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি: বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ দীর্ঘদিন ধরে এক গভীরভাবে প্রোথিত বিচারহীনতার সংস্কৃতির শিকার, যার ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতি অপরাধীদের মনে এমন বার্তা পৌঁছে দেয় যে, তারা যা-ই করুক না কেন, শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। এর ফলে একই ধরনের অপরাধ বারবার ঘটছে এবং ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ২০১৬ সালের গোবিন্দগঞ্জে তিন সাঁওতাল হত্যাকাণ্ড, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে চার যুবককে হত্যা, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাঙামাটিতে বৌদ্ধ বিহার ভাঙচুর ও লুটপাট, এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলার মতো ঘটনা স্পষ্ট প্রমাণ যে ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর এবং অপরাধীরা প্রায়শই শাস্তি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে কাপেং ফাউন্ডেশন আশা প্রকাশ করেছে যে, সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো সকল ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। সংগঠনটির মনে করে, শুধু অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি আনা নয়, বরং এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা জরুরি যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিক জাতি, ধর্ম, ভাষা বা পরিচয় নির্বিশেষে নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং সমান অধিকার ভোগ করতে পারে। এর জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করা, ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের লঙ্ঘন প্রতিরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে কাপেং ফাউন্ডেশন।