চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পাহাড়বাসী রাষ্ট্রের কাছে অধিকার পুনরুদ্ধারের আশা করেছিল
ঢাকায় আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন।

আজ ২ ডিসেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার “জাতীয় ঐক্য সুসংহত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুন”— এই স্লোগানকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর ধানমন্ডির উইমেন্স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতোর সভাপতিত্বে এবং তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিরন মিত্র চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী ও নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবির, এএলআরডি নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য কে এস মং মারমা, সিপিবির সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন, জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন, বাসদের সহ সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন,পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেনসহ বিভিন্ন আদিবাসী ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশের বহু মানুষই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না, ফলে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। তিনি জানান, কিছু গোষ্ঠী বর্তমানে চুক্তিকে “বিগত সরকারের চুক্তি” আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবি তুলছে, যা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। এটি কোনো দলের সঙ্গে করা নয়; এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি। তিনি অভিযোগ করেন, চুক্তি স্বাক্ষরের পরও পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভূমি দখল এবং হত্যা-নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে, যা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। তিনি জানান, চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনকারী পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বহুবার চিঠি দেওয়া হলেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি; বরং সেনা উপস্থিতি আরও বাড়ানো হচ্ছে।
সিপিবির সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন ,পার্বত্য চুক্তির ২৮ টি বছর পূর্ণ হতে চললেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগন এখনো শোষণ বঞ্ছনা ও বৈষম্যর শিকার হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পরবর্তী সময়েও পাহাড়িদের উপর জাতিগত হামলা, ভূমি বেদখল ও রাষ্ট্রীয় শোষণ অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ধীরগতি হলে উক্ত অঞ্চলে আবারো চুক্তি- পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে যেতে পারে। এ লক্ষ্য সরকার তথা রাষ্ট্র সদিচ্ছায় এগিয়ে আসলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি স্থাপন সম্ভব হবে।
বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পাহাড়বাসী রাষ্ট্রের কাছে অধিকার পুনরুদ্ধারের আশা করেছিল। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন না করে রাষ্ট্র পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তিনি বলেন, সংবিধান রচনার সময় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে “বাঙালি” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, যা উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সকল জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ভূমি ও অস্তিত্ব রক্ষা করা। কিন্তু পাহাড়ে ভূমি দখল ও অধিকার হরণের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। তিনি স্থায়ী শান্তির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন ও ভূমি দখল বন্ধ করার আহ্বান জানান।
পার্বত্য জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য কে এস মং বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা শুধু আঞ্চলিক নয়—এটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা। এরশাদ সরকার থেকে শুরু করে পরবর্তী সব সরকারই বিভিন্ন বৈঠকের মধ্য দিয়ে আলোচনার ভিত্তি তৈরি করেছিল, যার ধারাবাহিকতায় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পাহাড়ের ছোট জাতিসত্তাগুলোর অধিকার নিশ্চিত করার যে অঙ্গীকার ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি বলেন, “সন্তু লারমা চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ই বলেছিলেন—চুক্তি করা যতটা কঠিন, বাস্তবায়ন করা তার চেয়েও কঠিন হবে।” আজ পাহাড়িদের ভাষা, সংস্কৃতি, ভূমি—সবকিছুর উপর আঘাত চলছে। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী ভয়ভীতি আজও পাহাড়ে বিদ্যমান। তাই জাতীয় স্বার্থে চুক্তি বাস্তবায়ন ছাড়া বিকল্প নেই। প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দেন।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য চুক্তি রাষ্ট্র ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যকার অধিকার রক্ষার একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি অবাস্তবায়িত থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। তিনি বলেন, ২৪ জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল—তার অনেকটাই আজ উপেক্ষিত। অসংখ্য সংস্কার কমিশন গঠন হলেও কোনো কমিশনে আদিবাসীদের বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, পার্বত্য চুক্তির কথা বললেই এখন অনেককে “রাষ্ট্রবিরোধী” তকমা দেওয়া হচ্ছে। অথচ বিশ্বের শতাধিক দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে, এবং তাদের অধিকার রক্ষাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ।
মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির বলেন, ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষই আদিবাসী ছিলেন। কিন্তু দমন-পীড়ন, বৈষম্য ও ভূমি হারানোর চাপে তাদের সশস্ত্র আন্দোলনে যেতে বাধ্য করা হয়। আন্দোলনের ফলে একটি চুক্তি হলেও সেটির মূল ধারা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন, চুক্তি বাস্তবায়ন কেন হচ্ছে না—তা খতিয়ে দেখতে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করা হলেও তাদের কাজে বাধা দেওয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অনুসন্ধানে গেলে সেটেলার বাঙালিদের হামলার মুখেও পড়তে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বর্তমান বাংলাদেশ পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানে জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তন করেছে। তাই আদিবাসী জনগণের ভূমি, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব রক্ষায় চুক্তি বাস্তবায়নই একমাত্র পথ, এবং সেজন্য সকল পক্ষকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
আলোচনার শুরুতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ সভাপতি অমর শান্তি চাকমা, তিনি বলেন সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘোষণা দিলেও মাঠপর্যায়ে বাস্তবতা আগের মত ধীরগতির। পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির তথ্য অনুযায়ী চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্য শুধুমাত্র ২৫ টি ধারা সম্পূর্ণ , ১৮ টি ধারা আংশিক এবং ২৯ টি ধারা এখনও সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল স্তম্ভ আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের ক্ষমতায়ন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ ,স্থায়ী ভোটার তালিকা প্রণয়ন , পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে পাহাড়িদের আগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ করা, জুম্ম জনগণের নিরাপত্তা ও সামাজিক আস্থা গঠনের ব্যাবস্থাসহ চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখেছে সরকার।


