চলেশ রিছিল হত্যার দশ বছর
মধুপুরের গারো আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিল হত্যার আজ দশ বছর পূর্ন হলো । ২০০৭ সালের ১৮ই মার্চ দেশে জরুরী অবস্থা চলাকালে আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা খুন হন চলেশ রিছিল।
চলেশ রিছিল হত্যার পর ঘটনাটি দেশ বিদেশে ব্যাপক আলোচনা- সমালোচনার সৃষ্টি হলেও এই হত্যা মামলাটি আজও পুলিশ তালিকাভুক্ত করেনি । তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকার এ ব্যাপারে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে । সেই কমিটির প্রতিবেদনও এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। সরকারের একাধিক মন্ত্রী চলেশ হত্যার বিচার হবে বলে কথা দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই আশ্বাসের বাণীও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে আদিবাসী নেতৃবৃন্দ ও চলেশ রিছিলের পরিবারের সদস্যদের।
কেন এই হত্যাকান্ড ?: মধুপরে ইকোপার্ক বিরোধী আদিবাসীদের আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন চলেশ রিছিল। এজন্য বনবিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা তার উপর ছিলেন বিক্ষুব্ধ। ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ময়মনসিংহের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে মধুপুরের দিকে আসছিলেন চলেশ রিছিল। সেদিন ওই মাইক্রোতে তার সঙ্গী ছিলেন প্রতাব জাম্বিল। প্রতাব জাম্বিল জানান, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ধরে মুক্তাগাছা উপজেলার কালিবাড়ী বাসস্ট্যান্ড অতিক্রম করার পরপরই সাদা পোশাকে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রিক্সা ভ্যান দিয়ে সড়ক অবরোধ করে। তারা গাড়ি থেকে চলেশ, প্রতাব, তুহিন ও পীরেনকে ধরে পিকআপে তোলে। সরাসরি তাদের নিয়ে যাওয়া হয় মধুপুরের কাকরাইদে বিএডিসির খামারে স্থাপিত সেনা ক্যাম্পে। সেখানে দিনব্যাপি অত্যাচারের পর সন্ধ্যার দিকে চলেশ রিছিলের মৃত্যু হয়।
হত্যা নিয়ে মিথ্যাচার: চলেশ রিছিলকে হাসপাতালে নেওয়ার পরেই আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তার মৃত্যু নিয়ে শুরু করেছিল মিথ্যাচার। মধুপুর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিয়াজ হোসেনের মাধ্যমে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, তারা চলেশকে গ্রেফতার করতে গেলে দৌড়ে পালানোর সময় সে হোঁচট খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। হাসপাতালে আনার পর তার মৃত্যু হয়। ওই রাতেই মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ডা. কামরুজ্জামান বাদী হয়ে মধুপুর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন। ময়না তদন্ত শেষে পরদিন ১৯ মার্চ চলেশের মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মামলা রেকর্ড করা হয়নি: ২০ মার্চ তাকে সমাহিত করার পর তার প্রথম স্ত্রী সন্ধ্যারানী সিমসাং আইন শৃংখলা বাহিনী ও বনবিভাগের কর্মকর্তাদের নাম উল্লে¬খ করে মধুপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করতে যান। পুলিশ অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করলেও তালিকাভুক্ত করা থেকে বিরত থাকে। এ ব্যাপারে মধুপুর থানার তৎকালীন ওসি জানিয়েছিলেন, একটি ঘটনার ব্যাপারে দুটি মামলা হতে পারে না। যেহেতু অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে তাই হত্যা মামলা গ্রহণ করা হয়নি। চিকিৎসক বাদী হয়ে দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল খালেক জানান, ময়না তদন্তের প্রতিবেদন, পুনঃ ময়না তদন্তের প্রতিবেদন ইত্যাদি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে চলেশ হৃদরোগে মারা গেছেন। এছাড়া ২০০৭ সালের ২৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) কেএম তরিকুল ইসলাম প্রশাসনিক তদন্ত রিপোর্টেও হার্টের রোগে মারা যাওয়ার বিষয়টি উলে¬খ করেছেন। উক্ত রিপোর্টগুলোর প্রেক্ষিতে ওই বছরই (২০০৭) ১৩ সেপ্টেম্বর অপমৃত্যু মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে। আদালত উক্ত প্রতিবেদন গ্রহণও করে নিয়েছেন।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি: চলেশ রিছিলের মৃত্যুতে সেসময় ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সারাদেশে। দেশ-বিদেশের অনেক মানবাধিকার সংগঠন এ ঘটনার নিন্দা জানায়। চলেশ রিছিলের মৃত্যুর বিষয়টি তদন্তের জন্য ২০০৭ সালের ৫ মে অবসরপ্রাপ্ত জেলা দায়রা জজ রফিক উদ্দিনের নেতৃত্বে এক সদস্য বিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্ত কমিটির দাবির প্রেক্ষিতে সে বছর জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে চলেশের লাশ উত্তোলন করে পুনরায় ময়না তদন্ত করা হয়। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ঘটনার ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। কিন্তু আজও সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি।
নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীর জুড়ে: এদিকে এ ঘটনার পরপরই তিনটি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) পক্ষ থেকে যৌথ অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে তারা সেসময় সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, চলেশ রিছিলের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ও রক্তের দাগ ছিলো। দুই হাতের হাড় ও সব আঙ্গুল ভাঙা ছিলো। হাত পায়ের বেশ কয়েকটি নখ উপরানো ছিলো।
কথা রাখেননি মন্ত্রীরা : মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৮ মার্চ স্থানীয় আওয়ামীলীগ চলেশের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ সভার আয়োজন করে। মধুপুরের সাংসদ তৎকালীন খাদ্য মন্ত্রী মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী সে সভায় গিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন এ হত্যার বিচারের ব্যবস্থা করবেন। মামলাটি পুলিশ যাতে তালিকাভুক্ত করে বিচারের উদ্যোগ নেয় সে ব্যাপারে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু বেশ কয়েকবছর অতিক্রান্ত হলেও তাদের সে কথার কোন বাস্তবায়ন হয়নি।
আমরা চলেশ রিছিল হত্যার বিচার চাই। আমরা মনে করি চলেশকে যারা হত্যা করেছে তারা যতবড় ক্ষমতাধর হোক আইনের আওতায় এনে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা দরকার। তা না হলে ইতিহাস বলবে এই সময়টি ছিল বর্বর সময়। অসভ্য সময়।
কৃতজ্ঞতাঃ আচিকনিউজ২৪।কম