চট্টগ্রামস্থ পাহাড়ি শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের ১৯ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও কাউন্সিল সম্পন্ন
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার আহ্বান
আইপিনিউজ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: “শ্রমজীবীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুন” স্লোগানে চট্টগ্রামের পাহাড়ি শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন পাহাড়ি শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল (২৭ জানুয়ারি ২০২৩) শুক্রবার চট্টগ্রামস্থ বন্দর এলাকার ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনের আলোচনা সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নিতাই প্রসাদ ঘোষ এবং অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তার হোসেন।
এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা, ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জিয়াউল হক জিয়া,পিসিপি, চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ।
বিকাল ৩ঃ০০ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনী সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সহ-সভাপতি অনিল বিকাশ চাকমা এবং সাধারণ সম্পাদক জগৎ জ্যোতি চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পাহাড়ি শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অমর কৃষ্ণ চাকমা (বাবু)। আলোচনা সভায় শুরুতে সম্মেলনের উদ্বোধক বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
নিতাই প্রসাদ ঘোষ বলেন, “পার্বত্য এলাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ যে দূরাবস্থা চলমান ছিল, সে অবস্থাকে স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির চুক্তি হয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সরকার সেই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের পরিবর্তে পাহাড়ি জনগণের উপর নানামুখী অত্যাচার-নিপীড়ন এখনও অব্যাহত রেখেছে। স্বাধীনতার পরবর্তীতে যে মূলনীতির উপর দাঁড়িয়ে এই রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল বর্তমানে আমরা সেই মূলনীতি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। এদেশের আদিবাসীসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অন্যান্য নাগরিকের মতো সমান ও নায্য অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়, কিন্তু এই রাষ্ট্রকাঠামো তাদেরকে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো রেখেছে। তাদেরকে শিক্ষা, উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর করে দিচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ে ভূমি-উচ্ছেদ হতো না, পাহাড়িদের নিজ বাস্তুভিটা হারাতে হতো না, জীবন সংকটে থাকতে হতো না, সেটেলার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক হয়রানির শিকার হতে হতো না।”
এছাড়াও তিনি এই দুঃসময়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থেকে দেশের শোষিত-বঞ্চিত সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের ডাক দেন।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা বলেন, “নায্যতার কথা আসলে এখানে নিজ অধিকারের কথা আমাদেরকে বলতেই হবে। আমরা আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই, পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। আদিবাসীরা দেশের উন্নয়ন কাঠামোর বিরুদ্ধে কখনোই ছিল না, বরং এই উন্নয়ন কাঠামো তাদেরকে মূলধারা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমশ। পাহড়ে উন্নয়ন হচ্ছে আদিবাসীদের ভূমি-উচ্ছেদ করে, জায়গা বেদখল করে।”
তিনি আরো বলেন, “নিপীড়িত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সেই চুক্তির দীর্ঘ ২৫ বছরেও সরকার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা প্রতিনিয়ত জটিলতার দিকে এগোচ্ছে। আদিবাসীরা এদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতার উপর বিশ্বাস রাখে। এদেশের আলোবাতাসে নায্য অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু বর্তমান সরকার নিপীড়িত, অসহায় আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কতটুকু এগিয়ে আসছে!”
এছাড়াও তিনি আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিতসহ পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ ও দ্রুত বাস্তবায়নের আন্দোলনে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সকল পেশাজীবি শ্রেণীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ি শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম সেই দায়িত্ববোধ থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ শ্রমজীবী জুম্ম সমাজকে অধিকার সচেতন করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। আদিবাসী জাতিসমূহের উপর প্রতিনিয়ত শাসকগোষ্ঠী নিপীড়ন-অত্যাচার জারি রেখেছে। পাহাড়ে পর্যটনের নামে আদিবাসীদের ভূমি-উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাই আমাদের নিজ নায্য অধিকার বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে।” তাছাড়া তিনি চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন বেগবান করতে সকল জুম্ম সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
স্বাগত বক্তব্যে ফোরামের সহ-সভাপতি অনিল বিকাশ চাকমা বলেন, “তিন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আগত বিভিন্ন শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আদিবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম দীর্ঘদিন ধরে অবদান রেখে আসছে। আমাদের জুম্ম নারীসমাজ পিছিয়ে পড়ে থাকলে আন্দোলন জোরদার করা সম্ভব না। তাই জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় নারী সমাজের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তাছাড়া তিনি সারাদেশে নিপীড়িত আদিবাসী জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সকল স্তরের পাহাড়ি শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সামিল করতে ফোরামের সঙ্গে সকলের এগিয়ে আসা আহ্বান জানান।
এরপর অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘটে এবং অমর কৃষ্ণ চাকমাকে সভাপতি, জগৎ জ্যোতি চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও সন্তোষ বিকাশ চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করার মাধ্যমে শপথবাক্য পাঠপূর্বক পাহাড়ি শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের ২১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। কাউন্সিল পর্বের পরবর্তীতে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়।