গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল হত্যাঃ বিচারহীনতার ৮ বছর
দিবসটি উপলক্ষে গতকাল বুধবার সকাল থেকে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার জয়পুর গ্রামে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে সকালবেলা ফুল দেওয়া হয় ও মোমবাতি প্রজ্বলন করা হয়। এর পরপর মাদারপুর ও জয়পুর গ্রাম থেকে সাঁওতালরা জাতীয় পতাকা ও কালো পতাকা, সাথে সাঁওতালদের তীর-ধনুক, নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র, ব্যানার ও বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে গাইবান্ধা জেলা শহরে প্রবেশ করে। শহরে স্থানীয় নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (গানাসাস) সামনে থেকে মিছিল বের হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সমাবেশে মিলিত হয়। সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ ও জনউদ্যোগ গাইবান্ধা যৌথভাবে এসব কর্মসূচি পালন করে।
সমাবেশে বক্তারা সেই ৬ নভেম্বর, ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, এখনও সেদিনের ঘটনায় আহতরা শরীরের গুলির স্প্রিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন, আহতদের অনেকে ভালো চিকিৎসার অভাবে কাটাচ্ছেন পঙ্গু জীবন। ঘটনা পরবর্তী অনেক আশার বানী শোনানো হয়েছে সরকার পক্ষ থেকে যার কোন বাস্তব প্রতিফলন নেই।
বক্তারা আরও বলেন, শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ হত্যার ঘটনার পর থমাস হেমব্রম বাদী হয়ে তৎকালীন সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদসহ ৩৩ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। কিন্তু বিচার হওয়া তো দূরের কথা মামলার আসামি সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বুলবুল আকন্দসহ অন্যান্য মূল আসামিদের কেউই গ্রেফতার হয়নি। এছাড়া সাঁওতাল ও বাঙালিদের থেকে অধিগ্রহণকৃত ১ হাজার ৮শ ৪২ দশমিক ৩০ একর পৈত্রিক সম্পত্তি ফেরত দেয়ার ব্যাপারেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সমাবেশে সাঁওতাল হত্যার বিচার, আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের ক্ষতিপূরণ এবং সাঁওতালদের রক্তভেজা তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড নির্মাণ বন্ধের জোর দাবি জানান বক্তারা।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী, অ্যাড, রফিক আহমেদ সিরাজী, এলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, পরিবেশ আন্দোলনের নেতা ওয়াজিউর রহমান রাফেল, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের আহবায়ক অ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু, বাসদ নওগাঁ’র জয়নাল আবেদীন মুকুল, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বিচিত্রা তির্কি, আদিবাসী নেতা বিমল খালকো, মানবাধিকার কর্মী গোলাম রব্বানী মুসা, আদিবাসী নেতা প্রিসিলা মুরমুু, সুফল হেমব্রম, থমাস হেমব্রম, মাথিয়াস মারডি, বৃটিশ সরেন, তৃষ্ণা মুরমু প্রমুখ। সমাবেশ পরিচালনা করেন জনউদ্যোগের সদস্য সচিব প্রবীর চক্রবর্ত্তী।
সাঁওতাল হত্যা দিবসের পটভূমি
১৯৫৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নে চিনিকল স্থাপিত হয়। ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই আখ চাষের জন্য সাপমারা ইউনিয়নের রামপুরা, ফকিরগঞ্জ, মাদারপুর এবং সাহেবগঞ্জ ও কাটাবাড়ি ইউনিয়নের কটিয়াবাড়ি এলাকায় ১৫টির অধিক আদিবাসী গ্রাম এবং ৫টি বাঙালি গ্রাম মিলিয়ে মোট এক হাজার ৮’শ ৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল। এতে ২ হাজারের অধিক আদিবাসী বাঙালী উচ্ছেদ হয়। ৭৩ শতাংশ মুসলমান আর ২৭ শতাংশ সাঁওতালদের জমি অধিগ্রহণের পর ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম’ নামে নামকরণ করা হয়। এই অধিগ্রহণের শর্তে উল্লেখ ছিল, কখনো আখ চাষ না করা হলে ওই কৃষিজমি তার প্রকৃত মালিকদেরকেই ফিরিয়ে দিতে হবে।
চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অব্যস্থাপনার দরুণ ৩১ মার্চ ২০০৪ সালে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে নানা সময় চালু হয়, আবার বন্ধ হয় এভাবেই চলতে থাকে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ নানাভাবে অধিগ্রহণকৃত জমি বহিরাগত প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে। অধিগ্রহণের চুক্তি লংঘন করে কেবলমাত্র আখচাষের জন্য বরাদ্দকৃত জমিতে ধান, গম, সরিষা, আলু, তামাক ও হাইব্রিড ভূট্টা চাষ শুরু হয়। ২০০২ সালে অধিগ্রহণ চুক্তি ভঙ্গ করায় বাপ-দাদার জমি ফেরত চেয়ে আন্দোলন শুরু করেন সাঁওতালরা। আর ২০১৪ সালে গঠিত হয় ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’। এরপর চলতে থাকে সাঁওতাল-বাঙালিদের ভূমি উদ্ধারের মানববন্ধন, মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচি।
আন্দোলনরত আদিবাসী ও বাঙালিরা পুরো ঘটনাটি প্রশাসনের নজরে আনে। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সনের ৩০ মার্চ গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকা সরেজমিন তদন্ত করেন। তদন্তকালে উল্লিখিত জমিতে ধান, তামাক ও মিষ্টিকুমড়ার আবাদ দেখতে পান। সরেজমিনে দেখে যাওয়ার পর সমাধানের পথে না হেঁটে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন ১০ মে ২০১৬ তারিখে উক্ত ভূমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন সরকার বরাবর।
এরপর ২০১৬ সালের ১ জুলাই সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের প্রায় ১০০ একর জমিতে ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করে বসবাস আর জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন সাঁওতাল-বাঙালিরা। বাকি জমিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ রোপণ করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ২০১৬ সালের ১২ জুলাই সাঁওতাল পল্লীতে হামলা ও লুটপাট চালায় চিনিকল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারি বাহিনী।
পরে হঠাৎ কোনো নোটিশ ছাড়াই ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সকালে আখ কাটা নিয়ে পুলিশসহ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ বাঁধে। এতে চারজন সাঁওতাল গুলিবিদ্ধ হলেও শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামে তিনজন নিহত ও উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয় এবং চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারান দ্বিজেন টুডু। পরে ওই দিন সন্ধ্যার দিকেই ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন। বাড়িঘরে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের আগুন দেওয়ার ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশও হয়।