মতামত ও বিশ্লেষণ

খাসিদের পানবাগান ধ্বংস করার পাঁয়তারা আর কতদিন চলবে? – সিলভানুস লামিন

আমরা কী সত্যিই এত দীর্ঘজীবী?

এফিমেরা পোকা। মানুষের সময়কাল হিসেবে বাঁচে মাত্র ৫ মিনিট থেকে ২৪ ঘণ্টা। এই পোকার দৃষ্টিতে তার আয়ুস্কাল কত হতে পারে? ৫০ বছর-৬০ বছর?? বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুস্কাল ৬০-৭০ বছর! কিন্তু ঈশ্বরের সময়কাল হিসেবে সেটি কত? হয়তো সেকেন্ডের ভগ্নাংশ মাত্র! অথচ আমরা ভাবি, হাজার বছর বাঁচবো, ক্ষমতা নিয়ে শাসন করবো, সম্পদের পাহাড় গড়বো! এই ভাবনার মোহে আমরা এমন এক অন্ধ খেলায় মত্ত হয়ে যাই, যেখানে দুর্বলদের দমন, নিপীড়ন আর শোষণ করে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবি। যে মানুষটি একটু আলাদা মত রাখে, তাকেও থামিয়ে দিতে চাই নিজের ক্ষমতার জোরে। যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেবল প্রভাবশালীদের জন্যই সংরক্ষিত! এই পৃথিবীতে বিশেষ করে আমাদের দেশে দুর্বল (সংখ্যালঘু, শ্রমজীবী, দরিদ্র) মানুষের কোন মূল্য ও সম্মান নেই! প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী ও সম্পদশালী মানুষের কাছে এই দুর্বল মানুষেরা হাতের পুতুল! যা ইচ্ছে তাই করে তাঁদের সাথে! কখনও এই দুর্বল মানুষদেরকে তারা ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য আবার স্বার্থ হাসিল হলে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে আবার কখনও এই দুর্বল মানুষের সম্বলটুকু ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপায় নির্যাতনের খড়গ! আজ সেই নির্মম চিত্রই দেখছি! রিশন কংয়াংয়ের সবুজ পান বাগানটাকে ধ্বংস করে কেউ কেউ উল্লাস করছে! এরা কী হাজারটা বছর বাঁচবে? এভাবেই রাজত্ব করবে? ঈশ্বরকে কী তাদের এমন অক্ষেয় আয়ুস্কাল দিয়েছেন?

বন্ধুর কান্না দেখার সাহস হারিয়ে ফেলেছি…

রিশন কংয়াংয়ের মুখটা আজ দেখার সৎসাহস আমার নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর পান বাগানের ধ্বংসস্তুপ দেখেছি! কী নির্মম অত্যাচার!! কী জঘন্য মানসিকতা!! কী ভয়ংকর তাণ্ডবলীলা করেছে এই দুর্বৃত্ত্বরা! তাঁর ভেতরে যে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে সেটা তাঁর মুখমন্ডলই বলে দিয়েছে! আমার ভেতরেও রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচণ্ডভাবে! রিশন কংয়াং যে আমার ছোটকালের বন্ধু! কাছের বন্ধু, প্রাণের বন্ধু। বেশ কয়েকমাস আগেই ফুরফুরে মেজাজে আমার সাথে কথা বলেছে সে! উচ্ছল, বন্ধুবৎসল এবং প্রাণবন্ত এক পরোপোকারী মানুষ আমার এই বন্ধু রিশন! আমি যতদূর জানি, সে কোনদিনও কারও ক্ষতি করেনি বরং মানুষের উপকার করে গেছে। তাই তো তাকে গ্রামের হেডম্যান নির্বাচন করা হয়েছে। সবার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ঈর্ষণীয়। আমি আজ তাকে ফোন করার সাহস পাইনি! ফোন করে কী বলবো? কী ভাষায় তাকে শান্ত্বনা দেব? ভেতরে ভেতরে সমব্যথী হলেও তাকে কোনকিছুই বলতে পারিনি। তাঁর অস্রুসিক্ত নয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারিনি! জীবিকার একমাত্র সম্বল তাঁর এ পানজুম। এই পানজুমের আয় দিয়েই চলে সংসার, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ,চিকিৎসা এবং পরিবারের ভরণপোষণ! একজন মানুষ যখন তার জীবিকার একমাত্র সম্বল হারান তখন তার মনাভ্যান্তরে কেমন ধরনের ঝড় বয়ে যেতে পারে সেটা বর্ণনা করতে পারবে না এই সভ্য জগতের কোন ভাষা! তিলে তিলে গড়া একটা বাগান নিমিষেই নিঃশেষ হলো কিছু পাষাণ্ড মানুষের হাতে! আজ রিশন কংয়াংয়ের জীবন ও জীবিকা চরম অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। একটা পানজুম গড়ে তুলতে আরও ৫-৬ বছর লাগবে। এই ৫-৬ বছরে রিশন কংয়াং কীভাবে চলবে? তাঁর সংসারের চাকা কীভাবে চলবে, কীভাবে চলবে তার সন্তানদের পড়াশোনা?

একটা পানজুম, একখণ্ড প্রাণবৈচিত্র্য আর সহাবস্থানের প্রতীক

খাসিদের পানজুম শুধু পান গাছে ভর্তি নয়; এটা একেকটা ছোট জৈব-বাস্তুতন্ত্র। সেখানে সহাবস্থান করে সুপারি, কলাগাছ, ফলজ, বনজ ও ঔষধি উদ্ভিদ। বাস করে শামুক, মৌমাছি, পাখি, সরীসৃপ, অজস্র পোকামাকড়। এমনকি মাটির নিচেও জীবনের স্পন্দন। এটাই তো অভিযোজন! যখন জলবায়ুর হুমকি ক্রমে বাড়ছে, তখন খাসিদের এই পানজুম হয়ে উঠেছে টেকসই পরিবেশ রক্ষার নিঃশব্দ অথচ শক্তিশালী এক উদ্যোগ। এই বাগান ধ্বংস মানে শুধুই ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং একটি পরিবেশগত হত্যাকাণ্ডও! আজ যখন জাফলং অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির মুখে। পাথরখেকো লোভীদের কারণে ঠিক তখনই এই সবুজ বাগানগুলো ছিল আমাদের আশার আলো। কিন্তু সেই আলোও যেন কিছু মানুষের চোখে সহ্য হয়নি। তাই রিশনের সবুজ স্বপ্নকেই তারা রক্তে ভাসিয়েছে। প্রশ্ন জাগে। এই ধ্বংসের নেশা কতদিন চলবে?

আশাবাদ এখনো বাঁচিয়ে রাখে আমাদের

আজ পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতি, তাঁদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ আমাকে একরকম আশাবাদী করেছে। সুশীল সমাজ, পেশাজীবী, যুব প্রতিনিধি ও সামাজিক সংগঠনের উপস্থিতি প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ এখনো মানবিকতা হারায়নি। আমাদের সমাজের বড় অংশ আজও বিশ্বাস করে সহানুভূতি, ন্যায়বিচার আর মানবাধিকার সবার জন্য। এই বিশ্বাস থেকেই আমি বলি, রিশন কংয়াং ন্যায়বিচার পাবেন। যারা তাঁর জীবন ও জীবিকা ছিন্নভিন্ন করেছে, তারা যেন দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তি পায়। শুধু শাস্তিই নয়;এই ঘটনায় রিশন ও আর একজনের যে বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার পুনর্বাসনের দিকেও প্রশাসনের মনোযোগ চাই। এতে করে রিশনের অন্তরের যন্ত্রণার কিছুটা হলেও উপশম হবে। আমি চাই, আবার যেন দেখতে পারি আমার বন্ধুর সেই হাসিমুখ। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি, রিশন। তুমি একা নও।

Back to top button