আঞ্চলিক সংবাদ

খাগড়াছড়িতে আদিবাসী ছাত্রী ধর্ষণঃ ঘটনা পরবর্তী আসলে কী ঘটেছিল সেখানে?

বিশেষ প্রতিবেদন :গতকাল ০১ অক্টোবর মঙ্গলবার খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক সোহেল রানা কর্তৃক ৭ম শ্রেনির এক জুম্ম ছাত্রীকে ধর্ষনের অভিযোগ এবং উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অভিযুক্ত শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, দোকান-পাট পুড়িয়ে দেওয়া এবং কয়েকজনকে ‍গুরুতর আহত করার খবর পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্র মতে, ভিক্টিম আদিবাসী ছাত্রী তার বাঙালি সহপাঠীদের সাথে শিক্ষকের আবাসন কক্ষে দেখা করতে যায়। কক্ষ থেকে বাকী শিক্ষার্থীরা ফিরে আসে এবং ভিক্টিম শিক্ষার্থীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু, আধা ঘন্টার বেশি সময় পার হয়ে গেলেও ভিক্টিম ছাত্রীটি ফিরে না আসায় শিক্ষার্থীদের মাঝে সন্দেহের উদ্রেক হয় এবং এক পর্যায়ে শিক্ষকের কোয়ার্টারের দরজা ভেঙে শিক্ষার্থীরা ভিতরে প্রবেশ করলে ভিক্টিমের ওড়না পাওয়া গেলেও সেখানে শিক্ষক ও ভিক্টিমের খোঁজ পাওয়া যায় নি। পরে ঘটনা জানাজানি হলে স্থানীয় এলাকাবাসী এবং স্থানীয় জুম্ম শিক্ষার্থীরা মিলে প্রিন্সিপালের অফিস ঘেরাও করার এক পর্যায়ে স্কুলের বাথরুম থেকে অভিযুক্ত ধর্ষক শিক্ষক সোহেল রানাকে পাওয়া যায় এবং পরবর্তীতে প্রশাসনের সহযোগীতায় ভিক্টিম ছাত্রীটিকে একটি কক্ষ থেকে উদ্ধার করলে ছাত্রীটি ধর্ষনের অভিযোগের কথা সহপাঠীদের নিকট স্বীকার করে।

অভিযুক্ত ধর্ষক শিক্ষক সোহেল রানা। ছবি: সংগৃহীত।

প্রত্যক্ষদর্শী ও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা আনুমানিক ১:৩০ টায় অভিযুক্ত শিক্ষককে সেখানে গনপিটুনি দেয়।  গনপিটুনি পরবর্তীতে পুলিশ প্রশাসনের নিকট অভিযুক্ত ধর্ষককে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উত্তেজিত একদল যুবক দ্বিতীয় ধাপে পুলিশের সামনেই মারতে শুরু করে এবং এসময় পুলিশকে উত্তেজিত যুবকদের নিবৃত্ত করতে কোন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় নি । এক পর্যায়ে অভিযুক্ত ধর্ষক পালিয়ে যেতে চাইলে পার্শ্ববর্তী সড়কে অটোরিক্সার ধাক্কায় পড়ে যাওয়ার পর হাসাপাতালে নেওয়া হয় বলে জানা যায়। পুলিশ অভিযুক্ত শিক্ষককে হাসপাতালে নিয়ে গেলে দ্বায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাগড়াছড়ি সদরের নারানখাইয়া গ্রামের এক পাহাড়ী অধিবাসী আইপিনিউজকে বলেন, ঘটনাকে কেন্দ্র করে আনুমানিক ২:০০ টা থেকে ২:৩০ টায় সেটলার বাঙালিরা স্কুলের জুম্ম শিক্ষার্থীদের দা, কিরিচ, লাঠি নিয়ে হামলা করতে আসে। পরে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিকার ভূমিকায় স্থানীয় আদিবাসীরাও হামলা প্রতিরোধে এগিয়ে আসলে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।

সেটলার বাঙালিদের সঙ্গবদ্ধ অবস্থান এবং জুম্মদের উপর হামলার প্রস্তুতি। ছবি: সংগৃহীত।

জানা যায়, সেটলার বাঙালিরা চেঙ্গী স্কয়ার এলাকায় সাম্প্রদায়িক স্লোগান দিয়ে জড়ো হয়ে উসকানি দিতে থাকে। পরে চেঙ্গী স্কয়ার এলাকা থেকে পাহাড়ী অধ্যুষিত মহাজনপাড়ায় সেটলার বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ভাস্কর্য ভাংচুর, জুম্ম মালিকানাধীন উদ্যোক্তাদের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়িতে হামলা ও লুটপাট এবং আগুন দেওয়ার চেষ্টা চালায়। এতে মহাজন পাড়ায় পাহাড়ী মালিকানাধীন সৌম্য ফ্যাশন হাউজ, ব্যাম্বো শ্যুট রেস্টুরেন্ট এবং পাহাড়ী উদ্যেক্তাদের দোকানগুলোতেও লুটপাট চালায় সেটলার বাঙালিরা।

জেলা প্রশাসন কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারার নোটিশ।

এদিকে ঘটনা সংগঠনের সময় আনুমানিক ৩:০০ ঘটিকার সময় প্রশাসন খাগড়াছড়ি সদরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা জারি পরবর্তীতেও সেটলাররা সঙ্গবদ্ধহয়ে খাগড়াছড়ি সদরের জামতলা, পানখাইয়া পাড়া, নিউজিল্যান্ড, মিলনপুর, কলেজগেইট, স্লুইচ গেইট এলাকায় জুম্মদের হামলা করার চেষ্টা করলে সংঘবদ্ধ জুম্ম জনতা সেটলারদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে এবং ধাওয়া দিয়ে এক পর্যায়ে পানবাজারে অবস্থান নেয়। তবে সেটলার বাঙালিরা পানখাইয়াপাড়া সড়কের খাগড়াছড়ি স্পেশালাইজড ট্রিটমেন্ট সেন্টার হাসপাতালও ভাঙচুর করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।

পরে সেটলাররা পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে য়ংড বৌদ্ধ বিহারের পিছনের রাস্তা এবং মিনি সুপার মার্কেটের মসজিদের দিক থেকে জুম্মদের উপর হামলা করলে খাগড়াছড়ি-মধুপুর সড়কের রাখাইন ও মারমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সেটলার বাঙালিরা হামলা চালিয়ে লুটপাট চালায় এবং কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। পরবর্তীতে জুম্মরা নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বুদ্ধমূর্তি রক্ষায় প্রতিরোধ করতে শুরু করলে আইন রক্ষাকারী বাহিনী আনুমানিক সন্ধ্যা ৭:৩০ টায় অবস্থান নেয়।

সেটলার বাঙালি কর্তৃক ভাঙা বুদ্ধ মূর্তি। ছবি: সংগৃহীত।

এদিকে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগ, পুরোদিনের ঘটনাপ্রবাহ চলাকালীন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ-পাতদুষ্ট আচরন লক্ষ্য করা গিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাম্প্রদায়িক হামলা এড়াতে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ তো নেয়নি বরং জুম্মরা নিজেদের প্রতিষ্ঠান ও গ্রাম রক্ষার জন্য প্রতিরোধ শুরু করলে তাদেরকে নিবৃত্ত করা হলেও হামলাকারী সেটলার বাঙালিদের নিবৃত্ত করতে প্রশাসন কোন ধরনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

এদিকে ঘটনার শুরুতেই ভিক্টিম শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। ভিক্টিমের বয়ানের বরাট দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাগড়াছড়ির নেতৃস্থানীয় এক নারী নেত্রী বলেন, ভিক্তিম ছাত্রীটি প্রথমে উপস্থিত নারী সহপাঠীদের নিকট ধর্ষনের ঘটনার সত্যতা প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন চাপে, বিদ্যমান পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতায় ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে এবং বিচারহীনতার ভয়ে তার বয়ান পরিবর্তন করে।  এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভিক্টিমকে মেডিকেল পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যদিও নেওয়া হয়েছে, কিন্তু আসলেই নিরপেক্ষ ও প্রকৃত মেডিকেল রিপোর্ট আসবে কি না সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। কারন আমাদের কাছে এরকম অনেক ঘটনাপ্রবাহের ইতিহাস আছে যেখানে ভিক্তিম নিজে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষনের প্রকৃত প্রমাণ ও দৃশ্যমান আলামত থাকলেও অদৃশ্য কোন শক্তির চাপে হয়তো মেডিকেল পরীক্ষায়  প্রায়সময়ই নেতিবাচক ফল আসে।

তবে অসমর্থিত সূত্রে জানা যাচ্ছে, এ ঘটনায় ভিক্টিমের মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের ঘটনার আলামত আছে। তবে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসাপাতালের দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসার ডা: রিপল বাপ্পি চাকমাকে বারংবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এ বিষয়ে স্থানীয় ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম এর এক দায়িত্বশীল নেতা আইপিনিউজকে বলেছেন, “মেডিকেল রিপোর্ট পজিটিভ এবং থানার দায়িত্বরত পুলিশ এ বিষয়টি আমাদেরকে জানিয়েছেন। এ ঘটনায় মামলাও দায়ের করা হয়েছে এবং উক্ত মেডিকেল রিপোর্ট কোর্টে দাখিল করা হয়েছে।”

সেটলার বাঙালির হামলায় আহত সৌরভ চাকমা।

এদিকে সেটলার বাঙালিদের হামলায় দক্ষিন খবংপড়িয়া আদর্শ বৌদ্ধ বিহারের সেবক উজ্জ্বল মারমাকে পিঠে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করা হয় এবং সৌরভ চাকমা (২০) নামে এক শিক্ষার্থীর ডান চোখে গুলতি দিয়ে আঘাত করা হয়। এছাড়া আরো অনেক জুম্ম হতাহত হন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

উল্লেখ্য, অভিযুক্ত ধর্ষনকারী শিক্ষক সোহেল রানার বিরুদ্ধে এর আগেও যৌন হয়রানি ও ধর্ষনের অভিযোগ রয়েছে। নারী নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে কুষ্টিয়া থেকে সাজাস্বরুপ খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয় তাকে। বিগত ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সালেও অভিযুক্ত শিক্ষক এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে পাহাড়ি-বাঙালি সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রবল প্রতিবাদের মুখে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পরে জামিন নিয়ে একই প্রতিষ্ঠান খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে পুনঃনিয়োগ লাভ করলে তার প্রতিবাদে আবারও সাধারণ শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেয়। তা সত্ত্বেও তাকে পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়।

 

 

 

Back to top button