জাতীয়শিক্ষা

খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং কারাগারে বম নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় ঢাকায় বিক্ষোভ

গতকাল ১৮ জুলাই, ২০২৫ শুক্রবার, খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় এক ত্রিপুরা কিশোরীকে ৬ সেটেলার বাঙালি কর্তৃক ধর্ষণের বিচার ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর সেনাবাহিনীর লাঠিচার্জ – আটক এবং কেএনএফ সন্দেহে আটককৃত অবস্থায় কারাগারে ভান লাল রোয়াল বমের মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এর সামনে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবার গতকাল বিকাল- ৪ টায় এই বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে।

পিসিপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দীপায়ন খীসা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের নারী বিষয়ক সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা, বাংলাদেশ আদিবাসী পরিষদের প্রচার সম্পাদক বিভূতিভূষণ মাহাতো, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অংশৈসিং মারমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অর্থ সম্পাদক জানকি চিসিম, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক উসাইন মারমা। সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুর্মী চাকমা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, যারা ধর্ষণ করেছে তাদের একটা রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক দলকে সেই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখি নাই। তারা সবাই বিএনপির নেতাকর্মী। ধর্ষকদের গ্রেপ্তারের সময় আসামীদের মুখে হাসি দেখেছি। কারণ তারা ভালো করেই জানে আইন তাদের কিছু করতে পারবে না। আইন, প্রশাসন সব সেই সেটেলারদের হাতে। বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে বলতে চাই, আপনার আমালে তিন তিন জন নিরীহ বম চিকিৎসার অভাবে কারাগারে মারা গেছে। আপনাকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে। আপনারা আপনাদের অভ্যুত্থানের ১টি বছর পার করেছেন। কিন্তু আপনারা আদিবাসীদের জন্য কিছুই করতে পারেন নাই। বরং আমরা দেখেছি, জমিদারের নাতি ইপিজেড নির্মাণ করার জন্য সমতল আদিবাসীদের তাদের পিতৃ জমি থেকে তাড়ানোর হুমকি দিয়েছে। আমরাও স্পষ্ট করে বলতে চাই , যদি এদেশের আদিবাসীরা ভালো না থাকে তাহলে এই দেশও ভালো থাকবে না।

ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, একটা ত্রিপুরা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে অথচ রাষ্ট্র এখনও নিশ্চুপ। উল্টো যারা প্রতিবাদ করেছে তাদের ওপর অন‍্যায়ভাবে লাঠিচার্জ করা হয়েছে। ধর্ষকদের নানানভাবে রক্ষা করে, প্রতিবাদী কন্ঠস্বরগুলোকে ভয়ভীতি দেখিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র আদিবাসীদের ওপর চলা নির্যাতনকে আরও উৎসাহ দিয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা অবস্থায় ভানলাল রুয়াল বমের মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। অবিলম্বে সকল নিরীহ বমদের মুক্তি দিতে হবে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি দীপক শীল সংহতি বক্তব্যে বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকাররে পতনের পর আমরা এমন একটি দেশের আশা করেছিলাম যেখানে আদিবাসী, বাঙালি সবাই সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। এই জন্য আমরা শেখ হাসিনা সরকারকে পতনে আন্দোলনে নেমেছিলাম। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি ইউনুস সরকারও ঠিক একই পথেই হাটঁছেন। আজ শেখ হাসিনা যদি পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতো তাহলে আদিবাসীদের এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো না।

অংশৈসিং মারমা বলেন, ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে পাহাড়ী শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে গেলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সেনাবাহিনী লাঠি চার্জ করে। তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে সেনাবাহিনী সেই সেটেলার ধর্ষককে সহযোগিতা করছে? পাহাড়ের এই ধর্ষণ সমস্যা, ভূমি সমস্যা সবকিছুর মূলে রয়েছে এই রেশনখোর সেটেলার বাহিনী। শাসকগোষ্ঠীকে হুশিয়ার দিয়ে বলছি, আপনারা যদি পাহাড়ের এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারেন তাহলে এই পাহাড়ী তরুণরাই তাদের সমাধানের রাস্তা খুঁজে নিবে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অর্থ সম্পাদক জানোকি চিসিম বলেন, জুলাই পরবর্তী পাহাড়ে অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু দুর্ভাগের বিষয় এই পর্যন্ত একটা মামলারও সুস্থ সমাধান হয় নি। বরং আমরা দেখতে পায় ধর্ষকরা হেসে খেলে ঘুরে বেড়াই আর সুইসাইড করে আদিবাসী নারী।

সমাবেশে সংহতি জানিয়ে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা বলেন, পাহাড়ে আদিবাসী নারীরা জন্ম থেকেই কখনও সেটেলার বাঙালিদের দ্বারা, কখনও বা রাষ্ট্র দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয়। নারীদের আর্তচিৎকার রাষ্ট্রের কানে পৌঁছায় না। এই রাষ্ট্র ধর্ষণকারীদেরকে দৃস্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইনডিরেক্টলি ধর্ষণকে জায়েজ করতেছে।

সমাবেশে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুর্মী চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, আজকে আদিবাসী এবং সারা দেশের নারীদের অবাধে সুস্থু বিচরণের পরিবেশ চাইতে এখানে এসেছি। এই রাষ্ট্রের অবশ্যই আমাদের এই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এই রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে একটা আদিবাসী মেয়ে যাতে মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারে।

সমাবেশের সভাপতি পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা তার সভাপতির বক্তব্যে বলেন, খাগড়াছড়িতে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেটি শুধু ধর্ষণ নয়। এটি আদিবাসীদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। এদেশের পথপরিক্রমায় পরিবর্তিত সকল শাসকই আদিবাসীদের অস্তিত্বকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করে গেছে আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ, ভূমি দখল, সাম্প্রদায়িক হামলা এবং গণহত্যার মাধ্যমে। তিনি আরো দাবি রাখেন, বিগত কয়েকবছর ধরে কেএনএফ দমনের নামে সাধারণ নিরীহ বম জনগোষ্ঠীকে জেলে রেখে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

উক্ত সমাবেশে সংহতি জানিয়েছে ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরাম, বাংলাদেশ গারো স্টুডেনৃটস ইউনিয়ন, বাংলাদেশ গারো স্টুডেন্টস ফেডাটেশন। উক্ত প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। বিক্ষোভ মিছিলটি রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যের পাদদেশে গিয়ে সমাপ্ত হয়।

Back to top button