খাগড়াছড়িতে এক জুম্ম ছাত্রীকে ধর্ষণের বিচার ও জুম্মদের উপর সহিংসতার প্রতিবাদে রোয়াংছড়িতে বিক্ষোভ

থাগড়াছড়িতে এক জুম্ম ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বিচারের দাবিতে এবং চলমান শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচিতে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মদের উপর পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা ও ঘরবাড়ি-দোকানপাট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে রোয়াংছড়িতে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমাবেশের শুরুতে রোয়াংছড়ির উসারা মহাথের লাইব্রেরির প্রাঙ্গণ হতে বাজার প্রদক্ষিণ করে মিছিল করা হয়। পরবর্তীতে বান্দরবান সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী চসিংথোয়াই মারমার সঞ্চালনায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রোয়াংছড়ি থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক মনিলাল তঞ্চঙ্গ্যার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অংশৈসাই মারমা,বান্দরবান সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মেনিপ্রু মারমা,প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উমংথোয়াই মারমা,পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রোয়াংছড়ি থানা শাখার সভাপতি হ্লামংচিং মারমা,তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বিটনময় তঞ্চঙ্গ্যা,হিল উইমেন্স ফেডারেশন বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি উলিসিং মারমা,রোয়াংছড়ি সচেতন জনতার প্রতিনিধি মংয়ইচিং মারমা,মানবাধিকার কর্মী জন ত্রিপুরা, আলেক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ভারতসেন তঞ্চঙ্গ্যা।
অংশৈসাই মারমা সংহতি বক্তব্যে বলেন, আমরা গত ৩ মাস আগে ঠিক এইখানে জড়ো হয়েছিলাম থানচিতে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হওয়া আমাদের বোন চিংম্রা খিয়াং এর হত্যার বিচার চাইতে। আমরা আবারো সেই ক্ষোভ ও বেদনা ভরা মন নিয়ে আবারো এখানে জড়ো হয়েছি গতকাল খাগড়াছড়িতে ঘটে যাওয়া আদিবাসীদের উপরে সাম্প্রদায়িক হামলা এবং রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে হত্যার শিকার হওয়া সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাতে।
তিনি আরো বলেন, আমরা জানি যে আমরা এই রাষ্ট্রের কাছে সঠিক সুষ্ঠু বিচার পাবো না কারণ অতীতে ও আমরা আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়,নিপীড়ন,নির্যাতন ও গণহত্যার সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার পায়নি। পরিশেষে তিনি রাষ্ট্রের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান দাবি জানিয়ে তার বক্তব্য সমাপ্তি করেন।
ছাত্রনেতা হ্লামংচিং মারমা বলেন, বরাবরের মতোই আজকে ও বলছি এই রাষ্ট্রই ধর্ষকদের পাহাড়াদার,রাষ্ট্র ধর্ষকদের নিরাপত্তা দেওয়ার কারণে খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। খাগড়াছড়িতে জুম্মদের উপরে আবারো একটি সাম্প্রদায়িক হামলা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হলো। আমি মনে করি এটি পূর্ব পরিকল্পিত। খাগড়াছড়িতে ৮ম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক মারমা ছাত্রীকে সেটেলার বাঙালিরা সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে এবং এরই প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণ সড়ক অবরোধের ডাক দিলে সেখানে সেটেলার বাঙালিরা পাল্টা কর্মসূচী ঘোষণা করে জুম্মদের উপর হামলা চালিয়েছে। গতকালকে গুইমারায় পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সামনে সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের উপর হামলা করেছে এবং ঘর-বাড়ি অগ্নি-সংযোগ করেছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা রাজপথে দাড়িয়ে নিজেদের অধিকারের কথা, ন্যায় বিচারের কথা বলতে গেলে এই রাষ্ট্র আমাদের সন্ত্রাসী তকমা লাগিয়ে দেয়। বিভিন্ন মামলা হামলার ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখতে চায়।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের জুম্ম জনগন এম এন লারমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব দীর্ঘ ২ যুগ সশস্ত্র সংগ্রাম ও শত রক্তের বিনিময়ে পাহাড়ের গণমানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৯৭সালে ২রা ডিসেম্বর তৎকালীন সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত করেছিলেন কিন্তু আজকে প্রায় ২৭ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রর বিভিন্ন শাসক,সরকার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এই সকল সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে।
খাগড়াছড়িতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলা ও আদিবাসীদের হত্যার জন্য রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে বিটনময় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, এই পাহাড়ের বুকে অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত পাহাড়ের ছাত্রসমাজ তাদের লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। পাহাড়ে আদিবাসীদের সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটি অন্যায়, অত্যাচার ও নির্বিচারে গণহত্যার মাশুল একদিন এই রাষ্ট্রকে গুণতে হবে। অবশেষে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে তার সংহতি বক্তব্য সমাপ্তি করেন।
উলিসিং মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারী ধর্ষণ ও জুম্মদের উপরে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করার ইতিহাস অনেক পুরনো। আমরা প্রতিদিনই শুনতে পাই পাহাড়ের কোথাও না কোথাও আমাদের জুম্ম মা-বোনেরা নিপীড়নের শিকার হয়েছে। আমাদের জুম্ম বাপ-ভাইয়েরা বিনাকারণে সেনাবাহিনীর কাছে অত্যাচারের শিকার হয়েছে। কিন্তু আমরা সেইসবের প্রতিবাদ করতে গেলে ন্যায় বিচার চাইতে গেলে, অধিকার চাইতে গেলে আমরা হয়ে যায় সন্ত্রাসী,বিচ্ছিন্নতাবাদী।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা অধিকার চাইতে গেলে যদি সন্ত্রাসী হয়ে যায় তাহলে আমরা সন্ত্রাসী হতে রাজী। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র চুক্তি বাস্তবায়ন না করে উল্টো চুক্তি বিরোধী কার্যকলাপ এবং ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারত সেন তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের পর থেকে আজকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘুদের উপর শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন সময় দমন,নিপিড়ন,নির্যাতন,লুটপাট,অন্যায়,অবিচার, জুলুম চালিয়ে আমাদেকে দাবিয়ে রাখার জন্য আমাদের মনে যে,ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং খাগড়াছড়িতে চলমান রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদে সাম্প্রদায়িক হামলা, জুম্মদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা এটা তারই একটা ধারাবাহিকতা। তিনি আরো বলেন, এই রাষ্ট্রে আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক সাথে লড়াই করতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান ছাত্র ও যুব সমাজকে আরো অধিক সোচ্চার হতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী জন ত্রিপুরা বলেন, এই রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীকে হুশিয়ারী দিয়ে বলেন, অতীতে ও পাহাড়ের মানুষ অধিকার আদায়ের জন্য বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো ভবিষ্যতে ও নিজেদের ভূমি রক্ষার্থে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে আবারো কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জন করা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করাই আমাদের বর্তমান ছাত্র ও যুবসমাজের লক্ষ্যে। তিনি আরো বলেন, ভেবেছিলাম ৫ আগস্টের পরে নতুন রাষ্ট্র আমাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে কিন্তু এখন দেখছি আগের তুলনায় ধর্ষণ, হত্যা, সাম্প্রদায়িক হামলা আরো দ্বিগুণ বেড়েছে। তিনি আরো বলেন বর্তমান বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে গিয়ে কিছু কিছু মূর্খের দল নারী কমিশন আইন বাতিলের দাবি জানাচ্ছে যাতে আরো অধিকমাত্রায় নারীদের উপর ধর্ষণ নিপিড়ন চালানো যায়। তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে অপরিকল্পিত পর্যটন আজ আমাদের পাহাড়ের মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। আমাদের মা বোনেরা স্বাধীন ও নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারছে না। অবশেষে তিনি খাগড়ছিতে চলমান জুম্ম ছাত্র জনতার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে তার বক্তব্য সমাপ্তি করেন।
পরিশেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রোয়াংছড়ি থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক মনিলাল তঞ্চঙ্গ্যার সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আজকের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।