ক্ষমা কর আয়েশা, ক্ষমা কর সাগরী… :প্রশান্ত ত্রিপুরা
সাগরীর কথা কি মনে আছে আপনাদের? পুরো নাম সাগরী উরাঁও, যে নওগাঁর বদলগাছিতে এক ধর্ষকের হাতে প্রাণ দিয়েছিল আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে, ২০১২ সালের ১৯ মে তারিখে। নওগাঁতে সে নাকি নানাবাড়িতে এসেছিল ‘কাজের খোঁজে’, যদিও তার বয়স ছিল মাত্র সাত বছর! তার নাম কোনোদিন কোনো স্কুলের রেজিস্টারে উঠেছিল কিনা, বা জীবদ্দশায় কেউ কখনো তার কোনো ছবি তুলেছিল কিনা আমাদের জানা নেই। তবে তার লাশের একটি ছবি – যেটিতে মাথার কাছে রক্তের দাগ না থাকলে দেখে মনে হত একটি নিষ্পাপ শিশু শান্তভাবে ঘুমিয়ে আছে – সোশাল মিডিয়াতে প্রায় ভাইরাল হয়ে পড়েছিল। আমি দেখেছি, পাঁচবছর আগে সেই ছবিসহ দেওয়া একজনের একটি ফেসবুক পোস্ট শেয়ার হয়েছিল প্রায় দুইশতবার! ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের ছবি প্রকাশ করার পক্ষে নই আমি, কিন্তু আমি নিজেও পাঁচ বছর আগে লেখা একটি কবিতায় সাগরীর নাম ব্যবহার করেছিলাম। এছাড়া আমার ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ গ্রন্থে আমি তার নাম উল্লেখ করেছি, এবং পরে নিজের একটি প্রবন্ধের শিরোনামেও আমি তার নাম ব্যবহার করেছি।
‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ গ্রন্থের কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে আমি সাগরীর নাম উল্লেখ করেছি আমাদের ব্যর্থ সমাজ ও রাষ্ট্রের ‘বিভিন্ন গহ্বরে’ হারিয়ে যাওয়া অগণিত শিশুর একজন প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানে সাগরীর নামের পাশেই উল্লেখ করেছি আরো দুইটি নাম – একদিকে সুজাতা, আরেক দিকে ফেলানী। সীমান্তের কাঁটাতারে লাশ হয়ে ঝুলে থাকা ফেলানীর ছবি বাংলাদেশের সচেতন মহলে কে না দেখেছে? সে তুলনায় সুজাতা [চাকমা] ততটা পরিচিতি পায় নি কখনো, যদিও এক্ষেত্রে সাগরীর চাইতে সামান্য একটু এগিয়ে হয়ত রয়েছে সে। সুজাতাও ছিল শিশু, যদিও বয়সে সাগরীর চাইতে কিছুটা বড়, এবং সে স্কুলেও পড়ত, চতুর্থ শ্রেণীতে। বাড়ির কাছে গরু আনতে গিয়ে সুজাতা একজন ধর্ষক-ঘাতকের হাতে প্রাণ দিয়েছিল ২০১২ সালেরই মে মাসে। সম্প্রতি, মে ৯ তারিখে, তার মৃত্যুরও পাঁচ বছর পূর্তি হয়ে গেল, কিন্তু তাকে নিয়ে ফেসবুকে বা পত্রপত্রিকায় তেমন কোনো লেখালেখি আমার চোখে পড়ে নি। সুজাতাকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে অভিযুক্ত আসামি গতবছর পর্যন্ত কারাগারে ছিল বলে শুনেছি, কিন্তু সেই মামলার কি অবস্থা, তা জানি না। অন্যদিকে সাগরীর ব্যাপারে এ যাবত আমি কয়েকবার একাধিকজনের কাছে খোঁজ নিয়েও কোনো তথ্য জানতে পারি নি। তাকে ধর্ষণ ও হত্যা করার দায়ে অভিযুক্ত একজনের নাম পত্রিকায় এসেছিল, কিন্তু সেই মানুষ (‘পশু’ বলছি না সচেতনভাবেই) যদি এখনো মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায় এই দেশে, আপনি কি অবাক হবেন?
আজ সকালে বিবিসির খবরে ধর্ষণের বিচার প্রসঙ্গে আমাদের আইনমন্ত্রীর কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল। সেগুলির একটি ছিল এরকম, “ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে ধর্ষিতের সাক্ষ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সমস্যা হল সামাজিক কারণে ধর্ষিতরা ঠিকমত সাক্ষ্য দিতে চান না”। এই বক্তব্যের আইনি তাৎপর্য কী আমি জানি না, তবে আমি ভাবছিলাম, সাগরী বা সুজাতার মত যারা ধর্ষকের হাতে প্রাণও হারায়, তাদের হয়ে কে কথা বলবে? ধর্ষণের বিচার না হয় নাইবা করা গেল ‘সাক্ষ্যের অভাবে’, কিন্তু খুনের বিচার কি হবে?
প্রান্তিক বর্গের কোনো নারী শিশু যখন ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকার হয়, আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র সচরাচর তার প্রতিকার করতে পারে না, করতে চায় না। এই জানা কথাটিই সম্প্রতি নতুন করে আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন গাজীপুরের শ্রীপুরে আত্মহত্যা করা হজরত আলী নামক এক ব্যক্তি, যিনি চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া তাঁর পালিত কন্যা আয়েশা আক্তার সহ। সেই ঘটনায় বাবা-মেয়ে দুইজনেরই মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুকালে সাগরীর যে বয়স ছিল, আয়েশারও ছিল তারই কাছাকাছি। ফেসবুকে ‘ক্ষমা কর আয়েশা…’ শিরোনামে একটি ইভেন্ট খোলা হয়েছে, যার আওতায় আগামীকাল (শনিবার মে ২০, বিকাল ৪:৩০টা) শাহবাগে একটি সমাবেশ হবে। আমি এই ইভেন্টে ‘যাব’ বলেছি ভার্চুয়াল ভাবে, তবে সত্যিই যাব কিনা জানি না। যদি যাইও, পাঁচ বছর পরে কি আমরা আয়েশার কথা মনে রাখব? সাগরীর কথা আমরা মনে রাখি নি। সাগরী বা সুজাতাদের মত শিশুদের রক্ষা করতে না পারার গ্লানি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার জন্য আমরাও কি তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দেই নি, দেই না, আমাদের স্মৃতি থেকে? আইনের খাতা থেকে? সে হিসেবে আমরাও কি একেকজন হজরত আলী নই? সাগরী, সুজাতা, আয়েশা – তোমরা কি আসলে পারবে আমাদের ক্ষমা করতে?
প্রশান্ত ত্রিপুরা; নৃবিজ্ঞানী