মতামত ও বিশ্লেষণ

কোটা বনাম খোটা – বিপম চাকমা

১.
আান্দোলনের কারণে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে ১ম ও ২য় শ্রেণীর চাকুরীতে কোটা বাতিল করেছে এতে অনেকে খুশি। আমরাও খুশি, কেন জানেন? কোটার খোটা আর খেতে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষিত হতে আসা বন্ধুদের কাছ থেকে কোটার খোটা খেতে হয়নি এমন কোন সংখ্যা লঘু ছাত্র-ছাত্রী বাংলাদেশে নেই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাসের প্রথম দিনেই এই সুমধুর বাক্যটা শুনার সৌভাগ্য লাভ করেছি-“ও-ও কোঠায় ভর্তি হয়েছ।” হ্যাঁ কোটায় ভর্তি হয়েছিলাম। মন্দভাগ্য যে অনার্স ১ম বর্ষ ফা্ইনালের রেজাল্ট বের হওয়ার পর থেকে এই সুমধুর বাক্যটা আর শুনতে হয়নি। ক্লাসের প্রথম দিন যারা কোটার খোটা দিয়ে নিজেকে সুপিুরয়র ভেবে মজা পেয়েছিলেন তারাই পরবর্তী সাত বছর নোটের জন্য আমার কাছে এসেছেন। অন্যদের হয়তো কোটায় ভর্তি না হয়েও শুধু সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে এ খোটা খেতে হয়েছে।

এর পরে বলা শুরু হলো-‘তোদের তো চিন্তা নাই কোটা আছে, বিসিএসে-এ হয়ে যাবে।’ এর মধ্যে এক বন্ধু ছিল আরও এককাঠি উপরে। সে সবসময় বলত-‘তোদের কোন চিন্তা নাই, আমিতো কুমিল্লা জেলার, আমাদের জেলা কোটাও খালি নাই।’ বিসিএস এর রেজাল্ট যখন হল তখন দেখি সেই বন্ধুর অবস্থান আমার পরে। আমি ভেবে পেলাম না, সে কোন কোটায় মেধা তালিকায় আমার পরে গেল। অথচ রাঙ্গামাটি জেলা থেকে আমি ছাড়া আর কেউ পাস করেনি। তবে কি উপজাতি কোটা শুধু কথার কথা? শুধু কাগজে কলমের ব্যাপার? আমার সাথে আরও পাচঁ -ছয় জন যারা ভাইভা দিয়েছিল তারা কোথায়?
চাকুরীতে এসেও কোটার খোটা শেষ হলো না। শুনে যেতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সংখ্যালঘু সর্বোচ্চ আমলা নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা তাঁকেও সম্ভবত এই খোটা খেতে হয়েছে।

আমার জানা মতে কোটা বলে বিশেষ কোন সুবিধার ব্যবস্থা নেই। ভাইভা পর্যন্ত পাস না করে কেউ কোটার সুবিধা নিয়ে চাকুরী পায় না। চুড়ান্ত রেজাল্ট তৈরির সময় আইনের শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে উপজাতি কোটা জেলা কোটার সাথে মার্জ করে দেয়া হয়। ৫% অর্থও এই নয় যে ১০০ জনের মধ্যে ৫ জন চাকুরী পাবে। নিয়োগবিধি বইটা পড়লেই ১০০ জনে যে ৫ জন নয় সেটা বুঝা যায়।

আর দুর্নীতিটাও হয় কোটাকে ঘিরেই। নিশ্চয় এর সুযোগটা সংখ্যালঘুরা নিতে পারে না। প্রতি বছর মেডিকেল ভর্তির কোটার রেজাল্ট হলে দেখতে পাই উপজাতি কোটধারীদের নাম মো: নজরুল ইসলাম, মো: মতউর রহমান ইত্যাদি।

সুতরাং কোটার প্রয়োগ আসলে আছে কি নেই সেটা যেমন প্রশ্ন সাপেক্ষ অন্যদিকে কোটা ব্যবস্থাটা সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দ্বারা সংঘটিত একটা মানসিক নির্যাতনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও বটে। যাহোক রাষ্ট্র এ নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছে খুশি না হয়ে উপায় কি?

২.
তাহলে আমিও কি চাই কোটা পদ্ধতি বাতিল হোক। না, যারা আন্দোলন করেছেন তারা এখন বলছেন তারা বাতিল চাননি তারা সংস্কার চেয়েছেন। আমারও বক্তব্য বাতিল না করে সংস্কার করলে ভাল হতো।

সরকার সবার জন্য সমান অধিকারের ব্যবস্থা করেছে কিন্তু তাতে ন্যায়বিচার হয়েছে কি? যারা সুপারিশ করেছেন তাদের এটা মনে রাখা উচিত ছিল যে, ন্যায়বিচার আর সমান অধিকার এক নয়।

ব্রিটিশ আমলে বাঙালী মুসলমানের জন্য নির্বাচনে আলাদা আসনের ব্যবস্থা কেন ছিল? – পিছিয়ে পড়া বলে?
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কোটা কেন দাবী করে?- অনুন্নত দেশ বলে।
জিম্বাবে বা দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য কোটা আছে কেন?- পিছিয়ে আছে বলে।
অতএব কোটা ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটা বিশেষ ব্যবস্থা। দেশ বা সমাজের পিছিয়ে পড়াদের জন্য। বাংলাদেশের সংবিধানেও পিছিয়ে পড়াদের বিশেষ সুবিধা দানের কথা বলা আছে। সেটা কোটা ব্যবস্থা।

ক) এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা ৯৫ জনের মাসিক ইনকাম ৫০০০/ (পাচঁ হাজার) টাকার উপরে নয়। অবাক হচ্ছেন? এটা বুঝার জন্য গবেষণা করতে হবে না।হাটবারের একদিন পথে অপেক্ষা করেন। হাটফেরত লোকজনের ঝোলা তল্লাশি করেন বাচচার জন্য এক প্যাকেট চিপস, সামান্য খোলা ভোজ্য তেল, এবং কিছু শুটকি ও পেয়াজ রসুন ইত্যাদি সামান্য মসলা ছাড়া আর কিছু পাবেন না। যে সাবান দিয়ে তারা কাপড় ধোয় সে সাবান গায়েও মাখে।
যে ছেলে-মেয়ে বাইরে পড়ালেখা করছে তার বাবা-মা চাকুরীজীবী না হলে অতি কষ্টে তার মাসিক খরচের টাকা যোগায়।

খ) তার মাতৃভাষা বাংলা নয়। এটা যে তার উপর কত বড় বোঝা এদেশে যার ভাষা বাংলা নয় সে ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। আমার মাতৃভাষা বাংলার মত ইন্দো-আর্য শাখাভুক্ত হলেও সঠিকভাবে ‘চ’ ‘স’ উচ্চারণ করতে না পারার কারণে কত বার কত জনের কাছ থেকে বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে তার হিসাব নেই। যারা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের লোক নয় তাদের অবস্থাতো আরও খারাপ। এই সত্যটা বুঝতে পারবেন আপনি যদি পার্বত্য এলাকায় স্কুল কলেজে চাকুরী করেন। তাহলে আপনি কিভাবে আশা করেন ভিন্ন ভাষী একজন ছেলে-মেয়ে আপনার সাথে সমান তালে এসে পাল্লা দিবে। SSC/HSC রেজাল্ট হলে আমরাই গলা ফাটাই ইংরেজিতে ফেলের হার বেশি হওয়ার কারণে পাসের হার কমেছে।কারণ ইংরেজি বিদেশি ভাষা।

এ ধরনের আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন বাস্তবতার কারণেই সংখ্যালঘুদের জন্য কার্যকর কোটা ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। খোটা দেয়ার জন্য কোটা ব্যবস্থা রাখার দরকার নেই।

বিপম চাকমা; লেখক-সাহিত্যিক

Back to top button