কোটার বিশ্বজনীনতা; অধিকার ও বাস্তবতা- অমর শান্তি চাকমা
কোটা একটি রাষ্ট্রে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীদের বা জনগণদের প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের জন্য পজিটিভ ডিসক্রিমিন্যাশন। যেটা বাংলাদেশে শুরু হয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সন্তানদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার হিসেবে ১৯৭২ সালে কোটা চালু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন সরকারি কর্মচারী নিয়োগে মেধা কোটা ছিল মাত্র ২০ শতাংশ। এছাড়া ৪০ শতাংশ জেলা কোটা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর ১০ শতাংশ ছিল যুদ্ধাহত নারী কোটা। ১৯৭৬ সালে মেধা কোটায় বরাদ্দ হয় ৪০ শতাংশ, জেলা কোটায় ২০ শতাংশ ও আগের মতোই মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা হয় ৩০ শতাংশ। ১৯৮৫ সালে আবারও পরিবর্তন আনা হয় কোটা ব্যবস্থায়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ শতাংশ, জেলা কোটায় ১০ শতাংশ ও নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করা হয়। আর প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য রাখা হয় ৫ শতাংশ কোটা।
খেয়াল করুন, প্রয়োজনীয়তার তাগিদেই এ সমস্থ পিছিয়ে থাকা জনগণদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যেমনটা সরকারী চাকরীতে কোটা চেয়েছিল পাকিস্থান সময়ে পূর্ব বাংলার মানুষ । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও ব্রিটিশ ভারতে মুসলিমদের জন্য ৮০% কোটা চেয়েছিলেন।
কোটা বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা। সমতা, ন্যায্যতার জন্য, প্রজাতন্ত্রে সমাজের সকল স্থরের মানুষের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়। একটু খোঁজ নিয়ে দেখলে দেখা যায় পাশের রাষ্ট্র ভারতে সরকারী চাকরি ও উচ্চশিক্ষার জন্য শতকরা ৪৯.৫ ভাগ কোটা রয়েছে। পাকিস্থানে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারী কর্মচারী নিয়োগ করা হয় কেবলমাত্র ৭.৫%। বাকি ৯২.৫% নিয়োগ হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। মালয়েশিয়ায় ১০০ ভাগই কোটা। এর ৬০ ভাগ পায় মালয় জনগোষ্ঠী বাকি ৪০ ভাগ পায় চাইনিজ, ভারতীয়, স্বদেশজাত ও অন্যান্যরা। ইউরোপের কানাডায় নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করা আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২০ সালের মধ্য নারীদের প্রতিনিধিত্ব ৪০% এ উন্নীত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রও বিশ্বপরিবারে বিশেষ সুবিধার অধিকার পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের সুবিধা নিয়ে জাতিসংঘ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন প্রতিস্থান থেকে ডোনেশন পাচ্ছে। বিশ্বকাপ ফুটবলেও সকল মহাদেশের যথার্থ প্রতিনিধিত্বের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। যোগ্যতার প্রশ্ন হলে ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোই কেবল বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করতো। এশিয়া ও আফ্রিকান দেশগুলো খেলার সুযোগ পেতো কিনা সন্দেহ। তবে কোটায় খেলে বলে যে বিশ্বকাপ ফুটবলের রঙ, প্রতিদন্ধিতা কমেছে এমন না বরং অনেক ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতা বেড়েছে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। গোটা বিশ্ব একই প্লাটফর্মে দাঁড়াতে পেরেছে।
এটা গেলো বিশ্বব্যবস্থায় কোটা ব্যবস্থার কিছু জ্বলজ্যান্ত চিত্র। এবার আসুন দেশের দিকে। বাংলাদেশে সরকারী চাকরীতে শতকরা ৫৬% কোটা এবং ৪৪% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হতো। এর মধ্যে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা, ১০% নারী, ১০% জেলা, ৫% আদিবাসী এবং ১% প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্ধ। দেশে নিবন্ধিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখের মত। আদিবাসীদের সংখ্যা ১৫-২০ লাখ। প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা ২-৩ লাখের মতন। একটি আনুপাতিক রেটিও যদি করেন তাহলে দেখবেন আদিবাসীরা মোট জনসংখ্যার ২% এর কাছাকাছি। এখন তাদের বর্তমান বাস্তবতা লক্ষ্য করুন, ১৯৮৫ সাল থেকে আদিবাসী কোটার ব্যবস্থা করা হয়। কোটা থাকা সত্ত্বেও গত ৩৩ বছরে কতজন আদিবাসী সরকারী ১ম ও ২য় শ্রেণীর চাকুরীতে যোগ দিতে পেরেছে তা দেখুন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মতে দেশে বর্তমানে মোট ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৩৯৩ জন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যার মধ্যে ১ম-৯ম গ্রেড পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির পদে রয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৮১৯ জন। এদের মধ্যে কতজন আদিবাসী রয়েছেন সেটা গবেষণার বিষয়। তবে সংখ্যাটা যে
০.৫% এর এদিক সেদিক সেটা নির্দিদ্বায় বলা যায়। আবার যারাই কর্মরত আছেন তারা দক্ষতার, যোগ্যতার সাথেই কাজ করে যাচ্ছেন সেটাও আমরা দাবী করতে পারি। ভুটানের সাবেক রাষ্ট্রদূত শরদিন্দু শেখর চাকমা, মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমারা তারই প্রমাণ দেই।
তথাকথিত মেধাবীদের এটাও জেনে রাখা দরকার বিসিএসে কোটা প্রয়োগ হয় ভাইভার পরে গিয়ে। প্রিলি, রিটেন এবং ভাইভাতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই কোটার ব্যবহার হয়। তার মানে আপনাদের সেই তথাকথিত মেধাবীদের সাথে লড়াই করে, নূন্যতম যোগ্যতা অর্জন করেই তাদের ঠিকতে হয়। পাশের রাষ্ট্র ভারতে যেটা করতে হয় না। সেখানে কোটায় যারা থাকে তাদেরকেই পরস্পরের সাথে লড়াই করতে হয়।
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার বাস্তবতা, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, দক্ষ শিক্ষক, যথোপযুক্ত গাইডলাইন প্রভৃতির অপ্রতুলতার কারণে তারা মূল ধারার জনগোষ্ঠীদের থেকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকে। তাই ১৮-২০ লাখ আদিবাসীর শতকরা ১ ভাগের মত ঢাকার অত্যাধুনিক সুবিধাপ্রাপ্ত সংখ্যাটি দেখে বাকি ৯৯% এর মত আদিবাসীর বাস্তবতা আপনারা বিচার করতে পারেন না। এমন অনেক বন্ধু, সহপাঠী আছেন যারা প্রশ্ন করেন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায় পড়েও কেন কোটার দাবী করি। তাদের জন্য বলি, এ দাবী, এ আন্দোলনটা ব্যক্তির নয়, সামগ্রিকের। নিজের জন্য আন্দোলন নয়, ১৮-২০ লক্ষ আদিবাসীর জন্য।
তবে এ প্রশ্নটাও অযৌক্তিক নয় যে, প্রকৃত অর্থে যে সমস্থ আদিবাসী প্রান্তিকতায় অবস্থান করছে তারা কি আধো এ কোটার সুফল পাচ্ছে? যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামে পাংখুয়া, ম্রো, লুসাই, খিয়াং প্রভৃতি সমতলে কোচ, পাহান, সান্তাল প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। আমরাও চাই এ সমস্থ আদিবাসীদের মধ্যে প্রান্তিক থেকেও প্রান্তিকতায় যারা আছেন তারা এ কোটার সুফল ভোগ করুক। তবে সে ক্ষেত্রে এই আমাদেরকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে। মূল ধারার একজন বাঙালী প্রথম শ্রেণীর কর্মচারী বন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীণে গিয়ে ম্রো, পাংখুয়া, লুসাই জনগোষ্ঠীদের তুলে আনবেন সে কথা আমরা ভাবতে পারিনা, অন্তত ইতিহাস আমাদের সেটা ভাবতে দেই না। পাহাড়ে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের মধ্যে শিক্ষার হার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে লুসাই, পাংখুয়া, ম্রো রা আগের তুলনায় এখন আগাচ্ছে বলে আমরা দাবী করতে পারি। সুতরাং, ৫% আদিবাসী কোটা বহাল রাখা এখন সময়ের দাবী।
এবার আসুন আদিবাসী কোটার স্বপক্ষে কিছু আইনী বিধি-বিধান এবং কিছু প্রতিশ্রুতির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক…
১। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৪, “অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীদের জন্য সরকারী চাকুরী ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫% কোটা নিশ্চিতকরণের অঙ্গিকার।”
২। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯ এর ৩(ক) তে লিপিবদ্ধ করা “নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত করিবে না।”
৩। অন্যদিকে সত্তর আশির দশকে জুম্ম আদিবাসী জনগণের বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের দাবী জানিয়ে আসা
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৪ দফা দাবির উপধারা “সকল সরকারী চাকুরি ও উচ্চ শিক্ষায় উপজাতি প্রার্থীদের জন্য ৫% কোটা নিশ্চিত করতে হবে।” এবং উক্ত ৪ দফা দাবি পরবর্তীতে ৫ দফা এবং সংশোধিত ৫ দফা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির “ঘ” এর ১০ নং অনুচ্ছেদে, “সরকারী চাকুরী ও উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলসমূহের সমপর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত সরকার উপজাতীয়দের জন্য সরকারী চাকুরী এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখিবেন। উপরোক্ত লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার উপজাতীয় ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য অধিক পরিমাণ বৃত্তির ব্যবস্থা করিবেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় বৃত্তি প্রদান করিবেন।”
আমরা জানি সমতা, ন্যায্যতা আনয়নের জন্য, শ্রেণীর বিভাজন বিনাশ করে একীভূত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কোটার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, ধর্ম নিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে যুগ যুগ ধরে বাঙালী ছাড়াও ৪৫ টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস যারা ঐতিহাসিক কাল থেকেই শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিগতভাবে শোষণ বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে। অন্যদিকে তাদের স্বকীয় রীতি-নীতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য দেশের মূল ধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে এ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুখ উজ্জ্বল করতে বাঙালী জনগোষ্ঠীর চেয়েও বেশী ভূমিকা রেখে চলেছে। পক্ষান্তরে এ রাষ্ট্র, সরকার জাতির গৌরবত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের উপড় উপজাতি, ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীর নিকৃষ্ঠ তকমা লেপে দিয়েছে অনেক আগে।
এবার আদিবাসী কোটার বিলোপ ঘটিয়ে কি তবে সরকার রাষ্ট্র গঠনে আদিবাসীদের অংশীদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে?
সরকার কি তাহলে সংবিধানকে, ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ভঙ্গ করছে না??
অমর শান্তি চাকমা; শীক্ষার্থী- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়