কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত
৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। গানের দল মাদলের প্রতিবাদী গানের পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সভার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনু রশীদ। এরপর জাতিসংঘ মহসচিবের অনুবাদিত বাণী বাংলায় পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস। সংগঠনের ভূমি ও আইন বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল আজিম এবং কেন্দ্রীয় সদস্য মেইথিন প্রমীলার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন কনা, পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা কাজল দেবনাথ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী শাহীন আনাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, রাজেকুজ্জামান রতন, সহ সাধারণ সম্পাদক, বাসদ, খুশী কবীর, সমন্বয়ক, নিজেরা করি, অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়, রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি, ডোরা চৌধুরী, কান্ট্রি ডিরেক্টর, হেকস ইপার, শরীফ জামিল, সাধারণ সম্পাদক, বাপা, নির্মল রোজারিও, সভাপতি, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান এসোসিয়েশন, ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, সহ সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম সহ বিভিন্ন আদিবাসী ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ।
অনুষ্ঠানে সন্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী নারী পরিষদের সভাপতি, বাসন্তী মুর্মু। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২২ আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা।
আদিবাসী দিবসের আলোচনায় উপস্থিত অতিথিবৃন্দ আদিবাসীদের স্বীকৃতি, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি দাওয়া জানান। তারা সাম্প্রতিক তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো পরিপত্রে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশের তীব্র নিন্দা জানান।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২২ আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা তার বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র ১৯৭২ সালে সংবিধানে বাংলাদেশে বসবাসরত সকল নাগরিকদের বাঙালি বলে অভিহিত করার মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের পরিচয় কেড়ে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে, করে যাচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকার আজকাল গালভরা উন্নয়নের কথা বলেন। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামেও উন্নয়নের কথা শুনান, সেই উন্নয়ন কাদের স্বার্থে তা গভীরভাবে ভেবে দেখলেই বুঝা যায়। এই উন্নয়ন পার্বত্য আদিবাসীদের ভূমি, অস্তিত্ব ধ্বংস করার উন্নয়ন।’
তিনি তার আলোচনায় তরুণদের আগামী দিনের লড়াইয়ের দায়িত্ব কাধে তুলে নিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘তরুণদের উদ্দ্যেশে বলতে চাই আপনারা আর প্রবীণদের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। আমরা যারা প্রবীণ দীর্ঘদিন ধরে লড়াই সংগ্রাম করেছি, আদিবাসীদের জন্য কোন উল্লেখযোগ্য অধিকার আদায় করতে পারিনি। বরং দিনদিন আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয়ে ওঠেছে। প্রবীণদের অসমাপ্ত কাজ আপনাদের শেষ করতে হবে। আপনাদের প্রতি সেই আহবান জানাই।’
আদিবাসী নারী নেত্রী বাসন্তী মুর্মু সন্মানিত অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘আজ নারীরা সংসার চালায়, সন্তান লালন-পালন করে আবার দেশও চালায়। কিন্তু নারীরা সমাজে দেশে সন্মান পায়না, বরং নির্যাতিত হয়। আমাদের আদিবাসী সমাজেও গারো আর খাসিয়ারা বাদে নারীরা ভূমির অধিকার পান না। আমরা সকল আদিবাসী সমাজে আদিবাসী নারীদের ভূমির অধিকার চাই। পাশাপাশি রাষ্ট্র গঠনে অংশগ্রহণ করতে পাহাড়ে আর সমতলে আদিবাসী নারীদের জন্য সংসদীয় আসন চাই। পাশের দেশ ভারতে আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, অথচ আমাদের দেশের সংসদে আদিবাসীদের নিয়ে কথা বলার কেউ নাই।’
আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহবায়ক ফজলে হোসেন বাদশা সাম্প্রতিক তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক পাঠানো পরিপত্রে সমালোচনা করে বলেন, আমি অবাক হয়ে গেলাম, আজকে তথ্য মন্ত্রণালয় আমাদের সংবিধান রক্ষা করে চলতে বলেছে। আমি সরকার এবং মন্ত্রণালয়কে বলবো আপনারাই সংবিধান রক্ষা করে চলেন। আপনারা সংবিধান লংঘণ করে আদিবাসীদের লাঞ্চনা বঞ্চনা করেন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। এই স্বীকৃতি পাওয়া তাদের রাজনৈতিক অধিকার। রাষ্ট্রকে তাদের অধিকার মেনে নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো বাস্তবায়ন করেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মেসবাহ কামাল বলেন, আদিবাসীরা বারবার লাঞ্চিত হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে, তাদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ আচরণ করা রাষ্ট্রের মোটেও কাম্য নয়। তাই তিনি রাষ্ট্রকে মানবিক হয়ে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানান।
আদিবাসী দিবসের উদ্বোধক বিশিষ্ট নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনু রশীদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক জনশুমারীতে দেখা গেছে যে আদিবাসীদের-হিন্দুদের সংখ্যা অনেক কমেছে। কিন্তু আমি বলি আসলে কমছেনা, তাদের লুন্ঠণ করা হয়েছে, তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আদিবাসীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারতাম, কীভাবে প্রকৃতিকে ভালবাসতে হবে, কীভাবে সন্তানের মতন ধরীত্রিকে ভালবাসতে হবে, কীভাবে মানুষকে সন্মান করতে হবে। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের অবহেলা করেছি। আমরা শিখেছি মানুষকে অবহেলা করতে, শিক্ষকদের গলায় জুতার মালা পরাতে। আগামীতে আমাদের এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।’
আলোচনা শেষে আদিবাসী কালচারাল ফোরাম ও অন্যান্য আদিবাসী সাংস্কৃতিক দলের অংশগ্রহনে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। তারপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে বাংলা একাডেমি হয়ে আবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক বর্নাঢ্য র্যালীর মাধ্যমে আদিবাসী দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।