কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের অনুসারী অশীতিপর বৃদ্ধার বসতি ভেঙে দেওয়া ও তাঁকে হেনস্থার প্রতিবাদে বিবৃতি
আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের অনুসারী অশীতিপর বৃদ্ধার বসতি ভেঙে দেওয়া ও তাঁকে হেনস্থার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ যৌথ বিবৃতি দিয়েছে দেশের বিশিষ্টজনেরা। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এই বিবৃতিতে বলা হয়, “অতি সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার টাকিমারা গ্রামের একদল বাসিন্দা লালন সাঁইয়ের অনুসারী অশীতিপর বৃদ্ধ চায়না বেগমের বসত ঘর ভেঙে দিয়েছে। এ সময় প্রতিবাদ করায় চায়না বেগম নিজেও হেনস্থার শিকার হয়েছেন। এমনকি আক্রমণকারীরা তাঁকে হত্যার হুমকিও দিয়েছে। সংবাদসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ২৬ জুন, বুধবার সকাল ৬:০০ টায় এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। সংস্কৃতি নির্ভরতায় বিকশিত স্বাধীন বাংলাদেশে লালন অনুসারীর বসতিতে হামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় আমরা ব্যথিত-বিক্ষুব্ধ।”
এছাড়াও বিবৃতিতে বলা হয়, টাকিমারা গ্রামের হামলার ঘটনাটি বাউল ঘরানার উপর আক্রমণের প্রথম কোনো ঘটনা নয়। প্রায়শই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক স্বভাব কবি রাধাপদ সরকারের উপর অমানবিক নির্যাতনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই চায়না বেগম (৯০) এর বসতিতে হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটলো। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাউল শিল্পী ও নাট্যকর্মীর উপর ধারাবাহিক হামলা নির্যাতন, হেনস্থা, বাউলের বাদ্যযন্ত্র ও পাণ্ডুলিপিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও বরাবরই রাষ্ট্র ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে একদিকে সংস্কৃতি বিরোধী চরম ভাবাপন্ন মানসিকতার সম্প্রসারণ যেমন ঘটছে তেমনি সংস্কৃতি চর্চা ভীতিকর আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হচ্ছে।
বিবৃতিতে আরো উল্ল্যেখ করা হয়, ২৬ জুনের হামলার ঘটনায় ভুক্তভোগী চায়না বেগম সাবেক ইউপি সদস্য এনামুল হক, মাতব্বর মোশারফ হোসেন, আনার মণ্ডল, সাইদুল হাজিসহ অজ্ঞাতনামা ৪৫-৫০ জনের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেফতার না করে বরং কথিত “সুষ্ঠু সমাধান”-এর নামে উভয়পক্ষকে থানায় ডাকা হয়েছে। অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা কুষ্টিয়া মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খায়রুজ্জামানকে উদ্ধৃত করে সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে “আজ (শুক্রবার) বিকাল ৪টায় উভয়পক্ষকে থানায় ডাকা হয়েছে। সেখানে একটি সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা করা হবে। না হলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।” তদন্ত কর্মকর্তার এ ধরনের বিবৃতিতে আমরা বিষ্মিত হয়েছি। একটি অপরাধের ঘটনায় যখন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে আইনে সোপর্দ করার কথা তখন অপরাধীকে থানায় ডেকে এনে সমাধানের চেষ্টা করার বিষয়টি আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকার এবং জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণের পরিপন্থি।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আমরা মনে করি, এ ধরনের অপরাধের ঘটনায় দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, অপরাধীর প্রভাব-প্রতিপত্তিতে গুরুত্ব প্রদান প্রভৃতি বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিকাশ ও অপরাধ প্রবণ মনস্তত্ত্ব গঠনে ভূমিকা রাখছে, যা লালন অনুসারী চায়না বেগম কিংবা সংস্কৃতি ও সংস্কৃতজনদের উপর ধারাবাহিক হামলা-নির্যাতনের ক্ষেত্র ক্রমাগত সম্প্রসারণ করছে। এমতাবস্থায় সংস্কৃতি ও ভিন্নমত-পথের বাধাহীন চর্চা এবং বিকাশে রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিসহ কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আমাদের বলতে দ্বিধা নেই, ২৯ জুন শুক্রবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় চায়না বেগমের অভিযোগের বিপরীতে কথিত সমাধানের যে সংবাদ পাওয়া গেছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক এবং একটি অপরাধকে চাপা দেওয়ার প্রশাসনিক তৎপরতা। একদল গ্রামবাসীর ঘর ভেঙে দেওয়া ঘটনায় থানায় বসে সমাধান কিংবা বৃদ্ধা নারীকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের সিদ্ধান্তগ্রহণের মধ্য দিয়ে অপরাধের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেওয়া হলো।
আমরা বিশ্বাস করি, ঘর ভাঙা ও তৎপরবর্তী তথাকথিত সমাধানতত্ত্ব বাংলাদেশের সকল প্রকার সংস্কৃতি এবং ভিন্নমত ও পথের চর্চা বন্ধ করে ধর্মান্ধ-মৌলবাদি মনস্তত্ত্ব গঠন প্রবণতাকে বেগবান করার মধ্য দিয়ে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতার ও সুবিচার নিশ্চিতের সাংবিধানিক অঙ্গিকার পালনকে ব্যহত করবে।
সংস্কৃতি চর্চায় বিদ্বেষপোষণকারী জনগোষ্ঠীর আস্ফালন রুখে দেওয়াসহ অবাধ-ভীতিমুক্ত সংস্কৃতি চর্চা এবং এ ক্ষেত্রে সরকার ও রাজনীতির দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক সচেতন নাগরিক ও গণমাধ্যম সবসময় সোচ্চার থাকবে- এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।
বিবৃতি স্বাক্ষর করেছেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এবং রাশেদা কে. চৌধুরী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, মহিলা পরিষদ এর সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি সভাপতি এস.এম.এ সবুর, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এর সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, অধ্যাপক এম. এম. আকাশ, রোবায়েত ফেরদৌস, ড. জোবায়দা নাসরিন, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর অ্যাডভোকেট পারভেজ হাসেম, জীবনানন্দ জয়ন্ত, জাতীয় শ্রমিক জোট এর কার্যকরী সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ, আনন্দন এর প্রধান সংগঠক এ কে আজাদ, লালন অনুসারি ফকির দেবোরাহ্ জান্নাত, রাজন ফকির, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এর সহযোগী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, খেলাঘর এর সাধারণ সম্পাদক রেজাউল কবির, সমাজ কর্মী জাহাঙ্গীর আলম সবুজ, সংস্কৃতি কর্মী অলক দাস গুপ্ত এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল) এর সভাপতি গৌতম শীল।