কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৯ বছর ও রাষ্ট্রের বিচারহীনতার সংস্কৃতি

আজ কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৯ বছর পূর্ণ হলো । পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এটি একটি দুঃখজনক ও কলঙ্কিত অধ্যায়, যা এখনো সেখানকার মানুষের মনে গভীর বেদনা ও ক্ষোভের প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে । হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা ছিলেন জুম্ম নারীর অধিকার ও পার্বত্য অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক সাহসী প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন গভীর রাতে, বাঘাইছড়ির নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনা ক্যাম্পের তৎকালীন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমেদের নেতৃত্বে একদল সেনা ও ভিডিপি সদস্য এই অপহরণে জড়িত ছিল। কিন্তু দীর্ঘ ২৯ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও কল্পনা চাকমার কোনো হদিস মেলেনি। অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর বিচার হয়নি, কিংবা তাদের গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদ করাও সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্র, সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা, সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ কারোরই পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে জবাবদিহিতার নজির দেখা যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনেকে মনে করছেন, এই ব্যর্থতা শুধু একটি ব্যক্তির বা কোন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি অবিচার নয়, বরং এটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও ন্যায়ের প্রশ্নে চরম ব্যর্থতার প্রতীক। এটি আমাদের জাতীয় চেতনার জন্যও একটি গভীর লজ্জা ও আত্মসমালোচনার বিষয়।
কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী ছিলেন তাঁর নিজের দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা (কালীচরণ) ও লাল বিহারী চাকমা (ক্ষুদিরাম)। ১৯৯৬ সালের ১১ জুন প্রয়োজনীয় আলাপ ও রাতের খাবার সেরে নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কল্পনা চাকমা, তার বৃদ্ধা মা, তার দুই বড় ভাই ও তার বড় বৌদি। ১২ জুন সকাল হলেই বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কেতন চাকমার পক্ষে নির্বাচনী দায়িত্বও পালন করছিলেন কল্পনা চাকমা। সারাদিন পরিশ্রম করে সবাই অচিরেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হন। ঠিক সেই মুহূর্তে নিরাপত্তাবাহিনীর কিছু অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত ১২ জুন তারিখের প্রথম প্রহরে রাত আনুমানিক ১:০০ টা হতে ১:৩০ টার মধ্যে ঠান্ডা মাথায় কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
অপহরণের ঘটনার সময় অপহরণকারী নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা কল্পনার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমাকেও বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু, তারা সেখান থেকে কোনভাবে পালাতে সক্ষম হন। কল্পনার দুই ভাই জানায় তারা টর্চের আলোতে স্পষ্টতই অপহরণকারীদের মধ্য থেকে বাড়ির পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লে. ফেরদৌস এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার মোঃ নুরুল হক ও মোঃ সালেহ আহমদকে চিনতে পারেন।
ঘটনার পর ভোর হওয়ার সাথে সাথে ১২ জুন সকাল পৌনে ৭ টায় কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা স্থানীয় মুরুব্বি সম্রাটসুর চাকমা ও ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমাকে নিয়ে বাঘাইছড়ির টিএনওর (বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) হাসান জাহাঙ্গীরের নিকট বিষয়টি অবহিত করেন। টিএনও কালিন্দী কুমার চাকমার বিবরণ রেকর্ডভুক্ত করে বাঘাইছড়ি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট পাঠিয়ে দেন। কালিন্দি কুমার চাকমা ঘটনাস্থলে পাওয়া পাঁচটি এ্যামুনিশন বা গুলি, টিএনও’র কাছে জমা দেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে কালিন্দি কুমার চাকমার লিখিত জবানবন্দী টিএনও পড়ে শোনাননি।
এর কিছুক্ষণ পর কালিন্দী কুমার চাকমাকে থানায় পাঠানো হলে পুলিশের নিকট ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। সারাদিন কালিন্দী কুমার চাকমাকে থানায় রাখা হয়। বিকেলে রাঙ্গামাটি থেকে এডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট রেস্ট হাউজে আসলে তাদের কাছে গিয়েও বিস্তারিত তুলে ধরেন কালিন্দী কুমার চাকমা। তিনি তাদের সকলের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন যে, অপহরণকারীদের মধ্যে তারা লে: ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমদকে পরিষ্কারভাবে চিনতে পেরেছেন।
পরে বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট লে. ফেরদৌস, পিসি নুরুল হক ও সালেহ আহমদের নামে এফআইআর (মামলা নং ২, তারিখ ১২/০৬/৯৬ ধারা ৩৬৪ দ: বি:) দায়ের করেন।
এদিকে, ১৭ জুন, ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ডাকা অর্ধদিবস সড়ক অবরোধ চলাকালে বাঘাইছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর যোগসাজসে স্থানীয় ভিডিপি ও সেটলারদের সাম্প্রদায়িক হামলায় বাবুপাড়া ও মুসলিম ব্লক এলাকায় গুলি করে রূপন চাকমাকে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে সুকেশ, মনোতোষ ও সমর বিজয় চাকমা কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার হত্যাকারীদেরও আজ পর্যন্ত কোন বিচার হয়নি।
কল্পনা চাকমাকে অপহরণের ঘটনাটি দ্রুত অঞ্চল ছড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে, এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশে-বিদেশে ব্যাপকহারে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠে। দেশের এবং বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করে কল্পনা চাকমাকে দ্রুত উদ্ধার ও ঘটনার তদন্তের দাবি জানান। দেশ-বিদেশের তুমুল প্রতিবাদের মুখে সরকার অবশেষে অপহরণ ঘটনার ৩ মাস পর ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়।
কমিটি ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে ১৯৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৪০ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু দীর্ঘ ২৯ বছরেও আজ পর্যন্ত কোন সরকার তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি। এরপর ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৭ তারিখে মামলাটি বাঘাইছড়ি থানা থেকে জেলা গোয়েন্দা শাখা, রাঙ্গামাটি’র নিকট হস্তান্তর করা হয়। এর আট বছর পর ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ তারিখ আবার বাঘাইছড়ি থানায় মামলাটি পুন:হস্তান্তর করা হয়। কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনাটি বাঘাইছড়ি থানায় মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পর ২১ মে ২০১০ সালের ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করলেও সেই রিপোর্টটিতে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে উক্ত চুড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। এরপর ২ সেপ্টেম্বর ২০১০ আদালত বাদীর দাখিলকৃত নারাজির উপর শুনানী শেষে মামলার বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য পুনরায় সিআইডি পুলিশকে নির্দেশ দেন। এর দুই বছর পর গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ জনৈক তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক চট্টগ্রাম জোন সিআইডির পক্ষ থেকে চুড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়। উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্টেও অপহৃত কল্পনার কোন হদিশ না পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় এবং অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা লেঃ ফেরদৌসসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আবারও উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখান করেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
এমতাবস্থায় গত ১৬ জানুয়ারি ২০১৩ রাঙ্গামাটিস্থ জজ আদালত রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপারকে ঘটনার বিষয়ে তদন্ত করে তদন্ত দাখিল করার দায়িত্ব প্রদান করেন। এরপর গত ২০ জুলাই ২০১৪ রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার আমেনা বেগম কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার উপর রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করেন। নামে এটি ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ হলেও বাস্তবে তদন্তে কোনো কিছুই অগ্রগতি মেলেনি বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে পুলিশ সুপার আমেনা বেগম অন্যত্র বদলী হয়ে গেলে ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ মামলার তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তিনিও গতানুগতিকভাবে তদন্ত কাজ চালিয়ে যান। এরপর ১৯ অক্টোবর ২০১৬ আদালত ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে এই মামলার দায়িত্বভার দেন তৎকালীন রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসানকে।
তিনি দুই বছর পর ২০১৮ সালে কারও বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তিনিও পূর্বের তদন্ত রিপোর্টের মতোই তার প্রতিবেদনে বলেন, ‘আমার তদন্তকালে ভিকটিমের অবস্থান নিশ্চিত না হওয়ায় তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। …. বিধায় মামলার তদন্ত দীর্ঘায়িত না করিয়া বাঘাইছড়ি থানার চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য নং ০৩, তারিখ ৭/৯/২০১৬ দ: বি: বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করিলাম। ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া গেলে বা তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা হইবে।’
কালিন্দী কুমার চাকমা আবারও উক্ত ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখার সুপারিশ প্রত্যাখান করে আদালতে নারাজি আবেদ দাখিল করেন এবং উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত কারার দাবি জানান। এবিষয়ে আদালত ৮ জুন ২০১৭ প্রথম শুনানির আয়োজন করেন এবং নারাজির উপর পুলিশের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এরপর আদালত থেকে একের পর এক শুনানির দিন ধার্য করলেও পুলিশ এ বিষয়ে বার বার প্রতিবেদন দাখিলে অপারগতা প্রকাশ করে সময় চাইতে থাকে।
গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ দুপুরে রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তা বাদী কালিন্দী কুমার চাকমার নারাজী আবেদন নামঞ্জুর করে কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি খারিজের আদেশ দেন।
উক্ত আদেশের মাধ্যমে কল্পনা চাকমা অপহৃত হলেও কে বা কারা অপহরণ করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে ২০১৮ সালে তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার দ্বিতীয় দফায় তদন্ত শেষে আদালতে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন সেটিই বহাল রাখে।
বাদীপক্ষ ২০২৪ সালের ৮ জুলাই কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি পুনর্বিবেচনা বা রিভিশনের জন্য রাঙ্গামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আবেদন করে। আদালত আবেদনটি গ্রহণ করে গত ১৭ নভেম্বর ২০২৪ শুনানির দিন ধার্য্য করলেও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। রাষ্ট্র কর্তৃক শুনানি অনুষ্ঠিত না করা বা সময় ক্ষেপণ করে বিচারিক প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত করার মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে অনেকে অভিযোগ করেন।
প্রায় দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে মামলাটি চলার পর ৩৯ জন তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তের পরও রাঙ্গামাটি প্রশাসন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক অপহৃত কল্পনা চাকমার হদিশ দিতে না পারা এবং চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমদকে গ্রেপ্তার করে যথাযথ বিচারের আওতায় আনতে না পারার ব্যর্থতা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে বলে অনেকে মনে করছেন।