কল্পনা চাকমা অপহরণের ২১ বছর
অপহরণ ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কর এবং যথাযথ বিচার নিশ্চিত কর
অপহরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান কর
আজ ১২ জুন ২০১৭, কল্পনা চাকমা অপহরণের ২১তম প্রতিবাদ দিবস। ১৯৯৬ সালের এই দিনেই দিবাগত রাত আনুমানিক ১:৩০ টা হতে ২:০০ টার মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত কর্তৃক নির্মমভাবে অপহরণের শিকার হন। অপহরণকারীরা এসময় কল্পনার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা (কালীচরণ) ও লাল বিহারী চাকমা (ক্ষুদিরাম)কেও বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। কল্পনার বড় ভাইয়েরা স্পষ্টতই টর্চের আলোতে অপহরণকারীদের মধ্যে তাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌস (সম্পূর্ণ নাম মো: ফেরদৌস কায়ছার খান) এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি সদস্য মো: নূরুল হক ও মো: সালেহ আহম্মদকে চিনতে পারেন।
কল্পনা চাকমা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামী আদিবাসী জুম্ম নারী সমাজের এক নির্ভীক অগ্রসৈনিক। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং এদেশে একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিচালিত সকল জাতিগত সহিংসতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বৈষম্য, বঞ্ছনা, নারী ধর্ষণ, অপহরণ ও হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তার কন্ঠ ছিল সদা সোচ্চার। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী এবং স্বজাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিবেদিত এক কর্মী। তিনি বরাবরই সেনাবাহিনীর যেকোন নির্যাতন, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। বস্তুত কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতন ও সেনাশাসনের কুৎসিত দিককে এবং এসব নির্যাতন, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠকে রুদ্ধ করার হীন ও কাপুরুষোচিত ষড়যন্ত্রকে উন্মোচন করে দেয়।
কল্পনা অপহরণ ঘটনার পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার মুখে সরকার কিছুদিনের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও বিগত ২১ বছরেও সরকার সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। অপহরণ ঘটনার পরপরই কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমার অভিযোগ স্থানীয় বাঘাইছড়ি থানায় মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হলেও সেই রিপোর্টে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে উক্ত চূড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। এরপর ২ সেপ্টেম্বর ২০১০ আদালত বাদীর দাখিলকৃত নারাজির উপর শুনানী শেষে মামলার বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য পুনরায় সিআইডি পুলিশকে নির্দেশ দেন। এর দুই বছর পর গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ জনৈক তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক চট্টগ্রাম জোন সিআইডির পক্ষ থেকে চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়। উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্টও চরম ব্যর্থতার সাথে অপহৃত কল্পনার কোন হদিশ না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে। সঙ্গত কারণে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আবারও উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান। এমতাবস্থায় গত ১৬ জানুয়ারি ২০১৩ রাঙ্গামাটিস্থ জজ আদালত পুলিশ সুপার, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাকে ঘটনার বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার দায়িত্ব প্রদান করেন। এরপর গত ২০ জুলাই ২০১৪ রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার আমেনা বেগম কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার উপর রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করেন। নামে এটি ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ হলেও বাস্তবে তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই। পরবর্তীতে পুলিশ সুপার আমেনা বেগম অন্যত্র বদলী হয়ে গেলে গত ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ মামলার তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করলেও তিনিও গতানুগতিকভাবে তদন্ত কাজ চালিয়ে যান। এরপর গত ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ এই মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নেন পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান। বস্তুত এ পর্যন্ত প্রতিবেদনসমূহে নানাভাবে প্রকৃত অভিযুক্ত ও দোষীদের আড়াল করার নানা অপচেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দায়সারা বক্তব্য প্রদান ও ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে।
কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা ও মামলার বিশ বছর ও পাঁচ মাসের অধিক সময় পর গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপার তাঁর চূড়ান্ত রিপোর্ট রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কগনিজেন্স আদালতে দাখিল করেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তাঁর রিপোর্টেও পূর্বের রিপোর্টের বক্তব্যগুলো চর্বিতচর্বন করে প্রকৃত পক্ষে দোষীদের ও অভিযুক্তদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালানো হয় এবং ‘…সার্বিক তদন্তে লেঃ ফেরদৌস, ভিডিপি নূরুল হক ও পি.সি সালেহ আহমেদের উক্ত ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে দাবি করা হয়। এমনকি রিপোর্টে ‘কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে সত্য বলিয়া প্রমাণিত হয়’ বলে স্বীকার করা হলেও ‘দীর্ঘ ২০ বৎসর ৩৯ জন তদন্তকারী অফিসারের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কল্পনা চাকমাকে অদ্যাবধি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই এবং অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ’ বলে দায়িত্বহীন ও হতাশাব্যঞ্জক বক্তব্য প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ‘ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া গেলে বা তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা হইবে’ বলে প্রকারান্তরে মামলার কার্যক্রম বা তদন্ত কাজ বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়।
বলাবাহুল্য, কল্পনা অপহরণ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা ইতোমধ্যে উক্ত ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করেছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। এবিষয়ে গত ৮ জুন ২০১৭ আদালতে শুনানির পর আবার আগামী ১৮ জুলাই ২০১৭ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বলাবাহুল্য, কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনাটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ও দেশের আদিবাসী নারীদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও সহিংসতার এক জ্বলন্ত প্রতীক। বস্তুত এটাই আজ সত্য যে, কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনাটি আজ ২১ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও এই রাষ্ট্র, সরকার, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগ, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কেউই কল্পনা চাকমার হদিশ দিতে পারেনি, অভিযুক্ত অপহরণকারীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে পারেনি, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেনি, তথা এই রাষ্ট্র কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার সুবিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে এ দেশের অন্যায়-অবিচার ও অপরাধের বিচারহীনতার অপসংস্কৃতিকেই অত্যন্ত প্রকটভাবে ফুটিয়ে তুলেছে এবং জাতিগত সংখ্যালঘু আদিবাসীদের প্রতি চরম নির্যাতন ও বৈষম্যকে উন্মোচিত করেছে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই একদিন এর জবাব দিতে হবে। অপরদিকে কল্পনা অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ডাকা ২৭ জুন ১৯৯৬ অর্ধদিবস সড়ক অবরোধ চলাকালে আবার বাঘাইছড়ি সেনা কর্তৃপক্ষের মদদে স্থানীয় ভিডিপি ও সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক হামলায় বাবুপাড়া ও মুসলিম ব্লক এলাকায় গুলি করে রূপন চাকমাকে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে সুকেশ, মনোতোষ ও সমর বিজয় চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রেও সরকার বা প্রশাসন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কোনভাবেই দায়দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
বলাবাহুল্য এ সমস্ত কোন সহিংস ঘটনার জন্য রাষ্ট্র, সরকার, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও নিরাপত্তা বাহিনী কেউ এর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। দায়সারা বক্তব্য ও ভূমিকা গ্রহণ করে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার মত বর্বরোচিত ও জঘন্য মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার ন্যায়বিচার ব্যর্থ হতে পারে না। দোষীদের চিহ্নিত করে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্র, সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই তা নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত না হওয়া ও চুক্তির আলোকে এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন কার্যকর না হওয়ার কারণে এবং সরকার, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে যথাযথ বিচারের সংস্কৃতি অব্যাহত না থাকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও জুম্ম নারী তথা আদিবাসী নারীর উপর নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ ইত্যাদি এখনও অব্যাহত রয়েছে। তাই কল্পনা অপহরণ ঘটনার সুবিচার নিশ্চিতকরণসহ জুম্ম নারীসহ দেশের সকল নারী সমাজের সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের নিকট নি¤েœাক্ত দাবি জানাচ্ছিÑ
অবিলম্বে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কর এবং যথাযথ বিচার নিশ্চিত কর।
অভিযুক্ত কল্পনা অপহরণকারীদের এবং রূপন, সুকেশ, মনোতোষ ও সমর বিজয় চাকমার হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ কর।
পার্বত্য অ লের সুষম উন্নয়ন, জুম্ম নারী সমাজের নিরাপত্তা ও অগ্রগতিসহ পার্বত্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন কর।
…………………………………………………………………………………………………………………………
পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন কর্তৃক ১২ জুন ২০১৭, কল্যাণপুর, রাঙ্গামাটি থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রচারপত্র