কল্পনা চাকমা অপহরণের ২১বছরঃ অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি
আজ ১২ জুন ২০১৭, সোমবার, সকাল ১০.৩০টায় হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের যৌথ উদ্যোগে ঢাকার সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর রুণি মিলনায়তনে ‘কল্পনা চাকমা অপহরণের ২১ বছর উপলক্ষে এবং অবিলম্বে কল্পনা চাকমা অপহরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে’ এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনের সদস্য ও নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবীর, ব্লাস্টের সম্মানিত পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য দীপায়ন খীসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন কণা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মনিরা ত্রিপুরা প্রমুখসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করবেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য রাখি ম্রং। সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি চঞ্চনা চাকমা।
খুশী কবির বলেন- কল্পনা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল জাতিগত সহিংসতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বৈষম্য, বঞ্চনা, ধর্ষণ, অপহরণ ও হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তীব্র কণ্ঠে প্রতিবাদ করতেন। শুধু তাই নয়, কল্পনা চাকমা আদিবাসী নারী তথা নারীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সকল ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী একটি কণ্ঠস্বর। তাই কল্পনা চাকমা গণতন্ত্রের প্রতীক। কল্পনা চাকমার অপহরনের মামলাটাকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তাই সবার দায়িত্ব বলে তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়া তিনি উল্লেখ করেন, সেই অতীতকাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু পার্বত্য বিরোধীরা সবসময় এটাকে পুঁজি করে পার্বত্যবাসীদের অধিকার আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন হিসেবে দেখেন। ফলে সমতল থেকে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যাদেরকে সেখানে বসানো হয়েছে স্বার্থরক্ষার জন্য বিশেষ বাহিনী তাদেরকে ব্যবহার করছে। ফলে আজ অব্দি লংগদুর মত সহিংসতার ঘটনার কোন সুষ্ঠু তদন্ত হয় না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ব্যারিস্টা সারা হোসেন বলেন-কল্পনা চাকমার অপহরণের ২১ বছর পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতনের সহিংসতার মাত্রা কমেনি বরং বেড়েই চলেছে। কল্পনা চাকমার অপহরনের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে অনেক ধরনের আইনগত ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, কিন্তু দেশে নারী নির্যাতনের মাত্রা কমেনি। নির্যাতনের শিকার নারীরা বিচার পাচ্ছেন না। আবার বিচারপ্রার্থীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হন। তিনি উল্লেখ করেন ৭১ সালে সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের অপহৃতের পর স্বাধীন বাংলাদেশে কল্পনা চাকমাই প্রথম অপহৃত নারী যার মামলা এই ২১ বছরেও কোনো সুরাহা হয়নি। কল্পনা চাকমা শুধুমাত্র পার্বত্য নারীদের নেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রতিবাদী নারীদের কন্ঠস্বর।
সঞ্জীব দ্রং বলেন- কল্পনা চাকমা শৈশব থেকে পাহাড়ের মানুষের নির্যাতন দেখে বড় হয়েছেন। তাই কল্পনা চাকমা চেয়েছিলেন একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে। শাসকবাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। তাই ২১ বছর আগে তাকে হারিয়ে যেতে হল। এই ২১ বছরে পাহাড়ের প্রতি রাষ্ট্রের মনোভাব একটুও পাল্টায়নি, বরং পাহাড়ে দমন নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। কল্পনা চাকমার আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায় সেই জন্য তরুণ সমাজকে আন্দোলনে সামিল হবার আহ্বান জানান তিনি।
ড. জোবাইদা নাসরীণ কণা বলেন- কল্পনা চাকমার অপহরনের ক্ষত পাহাড়ের রাজনৈতিক আন্দোলন ও নারী আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তোলে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন চর্চিত বাঙালী জাতীয়তাবাদী ঘরানার নারী আন্দোলনে কল্পনা চাকমার অপহরণ প্রথম পাহাড়ি ও বাঙালী নারী আন্দোলনের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। তাই আমরা আজো বলি আমাদের ধমণীতে কল্পনার রক্ত বইছে। কল্পনা চাকমার অপহরণ দেশ বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু গত ২১ বছরেও মামলার তদন্তে কোন অগ্রগতি হয়নি বলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন।
দীপায়ন খীসা বলেন, ২১বছরেও তদন্তের কোন অগ্রগতি নেই বলে তিনি বলেন, মামলায় আসামীর নাম সুস্পষ্ট লেখা থাকলেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুখোমুখি করা হয়নি।
রাখি ম্রং বলেন- কল্পনা চাকমা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামী আদিবাসী নারী সমাজের এক নির্ভীক অগ্রসৈনিক। বছরের পর বছর কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা নানান নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। আদিবাসী সমাজের উদীয়মান এক নারীনেত্রীর চাঞ্চল্যকর অপহরণ ঘটনা নিয়ে সরকারের এহেন বিমাতাসুলভ আচরণ আদিবাসী জাতিসহ এ দেশের প্রগতিশীল ও বিশিষ্ট নারী নেতৃত্বদের প্রশ্নবিদ্ধ করছে। রাষ্ট্রীয় আইন দেশের সকল নাগরিকের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। কেউ আইনের উধ্বে নয়। কাজেই কল্পনা চাকমার অপহরণকারীরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তারাও আইনের উর্ধ্বে নয়। সুতরাং কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনার অতিশীঘ্রই সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমরা জোর দাবী জানাচ্ছি। না হলে সরকারকে কল্পনার অপরহণের কলঙ্কের বোঝা প্রতিটি মূহুর্তে বয়ে বেড়াতে হবে। কারণ যতদিন না এর বিচার না হবে ততদিন আদিবাসী সমাজ ও দেশের বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষেরা এর বিচার দাবী করবেই।
১৯৯৬ সালে ১২ জুন মধ্যরাতে তৎকালীন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ২৩ বছরের কল্পনা চাকমাকে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিজ বাড়ি নিউলাল্যাঘোনা গ্রাম থেকে অপহরণ করা হয়। দুর্বৃত্তরা কল্পনা চাকমাকে সুপরিকল্পিতভাবে অপহরণ করে এবং এ ঘটনার কোন প্রকার প্রমাণ না রাখার চেষ্টা করে। অপহরণকারীরা এইসময় কল্পনার দুই ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা (কালীচরণ) ও লাল বিহারী চাকমাকেও (ক্ষুদিরাম) বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যারচেষ্টা করে। কল্পনার বড় ভাইয়েরা টর্চের আলোতে পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌস (মো. কায়সার খান) এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও মো. সালেহ আহম্মদকে চিনতে পারেন। কল্পনা চাকমার ভাইয়ের সাক্ষ্য অনুযায়ী উক্ত সেনাবাহিনী এবং ভিডিপির সদস্যরা কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে।কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা ইতোমধ্য ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং মামলার কার্যক্রম সুপারিশ প্রত্যাখান করে আদালতে না রাজি আবেদন দাখিল করেছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। এবিষয়ে গত ৮ জুন ২০১৭ আদালতে শুনানির পর আবার আগামী ১৮ জুলাই ২০১৭ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
দেশের সকল আদিবাসী নারী সমাজের সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষে সরকারের নিকট নিম্নোক্ত দাবিসমূহ জানানো হয়-
১. অবিলম্বে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত স্বাপেক্ষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে
২. বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার আদিবাসী হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
৩. পার্বত্য অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন ও শান্তি এবং পার্বত্য এবং সমতলের আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
৫. সম্প্রতি লংগদুতে পাহাড়ি গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলাকারী ও অগ্নিসংযোগকারীদের অচিরেই গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে এবং অগ্নিসংযোগ ও সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং তাদের জীবন ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ, দ্রুত ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
৭. পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক সকল অস্থায়ী ক্যাম্প ও অপারেশন উত্তরণ প্রত্যাহার করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।