মতামত ও বিশ্লেষণ

কল্পনা অপহরণের বিচার না হলে, প্রকৃত অপরাধীদের চেহারা উম্মোচিত হবে না: ইমতিয়াজ মাহমুদ

কল্পনা অপহরণের ২৫ বর্ষপূর্তিতে লেখক ও আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ এর ফেসবুকে লেখাটি আইপিনিউজ এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল-

(১)
কল্পনা চাকমা কে ছিলেন জানেন? কল্পনা চাকমা ছিলেন আমাদের পাহাড়ের একজন আদিবাসী নারী। একদম তরুণ, উনিশ বিশ কি একুশ বছর বয়সী একটা মেয়ে। এই বয়সী একটা মেয়েকে ‘মেয়ে’ বলেই উল্লেখ করা বিধেয়। তাইলে আমি নারী বলছি কেন? নারী বলছি তার কারণ আছে। এই ছোট ক্ষীণকায়া অতি সাধারণ মেয়েটা, জীবন তাঁকে এমন একটা অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল যে সে যেন হয়ে উঠেছিল পাহাড়ের সকল নারীর প্রতিচ্ছবি। পাহাড়ের সকল আদিবাসী নারীর সংগ্রামী রূপখানি যেন ছিলেন আমাদের এই ছোট বোনটি- কল্পনা চাকমা।
পাহাড়ের আদিবাসী নারীর রূপটা কি? সাধারণভাবে নারীর জীবন হয় দুই ফ্রন্টে দুইটা স্বতন্ত্র লড়াইয়ের সমন্বয়। একটা লড়াই তো হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে চলমান লড়াই। আরেকটা হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে নারীর একান্ত লড়াই। পাহাড়ের সংগ্রামী নারীর জীবনে লড়াইয়ের একটা তৃতীয় ফ্রন্টও আছে- সেটা হচ্ছে আদিবাসীদের প্রতি চলমান জাতিগত নির্যাতন ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। এই তিনটা লড়াইয়েই কল্পনা চাকমা অগ্রগামী একজন সংগ্রামী নেতা ছিলেন। হিল উইম্যান ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন কল্পনা চাকমা।

কল্পনার জন্ম রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। ১৯৯৬ সনের ১১ই জুন তারিখে মধ্যরাতে তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়ী থেকে অপহরণ করা হয়। খুবই সাধারণ অস্বচ্ছল একটি পাহাড়ি পরিবারের মেয়ে। কলেজে পড়তেন তখন। নিজের মেধা, যোগ্যতা ও নেতৃত্বের গুণে সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর অপহরণের খবর সেসময় সারা দুনিয়ায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে দেয়। অপহরণের অভিযোগ ছিল সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে, সুনির্দিষ্টভাবে একজন সামরিক কর্মকর্তার নামও বলে আসছে কল্পনার পরিবার।
অদ্যাবধি কল্পনা চাকমার অপহরণের কোন বিচার বিচার হয়নি, এমনকি গ্রহণযোগ্য কোন তদন্তও হয়নি অদ্যাবধি।

(২)
কল্পনা চাকমার কথা যখনই আসে, আমার মনে সবসময়ই একটা অসহায় ব্যর্থতার কথা মনে আসে। অপহরণের সেই রাতে কল্পনা চাকমা চিৎকার করছিলেন, ‘দাদা মরে বাজা’/ দাদা আমাকে বাঁচাও। কল্পনা চাকমার সেই চিৎকার যেন এখনো আপনি শুনতে পাবেন পাহাড়ের সর্বত্র। আমার মনে হয় আমি যেন কল্পনার সেই দাদা যে তাঁর বোনকে তো বাঁচাতে পারেনি, ওর জন্যে ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করতে পারেনি।

কিন্তু আজকে আমি সেই অসহায়ত্ব ও কান্নার কথা বলতে চাই না। কান্নার কথা বলতে হয় বটে, কিন্তু কান্নার মধ্যে কি হয়, অনেক সময় প্রয়োজনীয় কথাটা হারিয়ে যায়।

আজ বরং আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এই যে পাহাড়ে সেদিন একজন কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছে আর এই যে এতদিন পরেও সেই অপহরণের কোন বিচার হলোনা, এই কথাটা যেন কখনোই কোনদিন ভুলবেন না।

বিশেষ করে আমাদের সমতলের শহর নগরের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী তরুণ যুবা ছাত্র যারা আছেন, আপনারা যেন কোনদিনই ভুলবেন না। ভুলবেন না যে এইটা আমাদের সকলের একটা ব্যর্থতা, এই ঘটনা আমাদের সকলের জন্যে একটা কলঙ্ক, এই ঘটনা আমাদের সকলের প্রতি ঘটে যাওয়া একটা অন্যায়।

মনে রাখবেন যতদিন পর্যন্ত না কল্পনার চাকমার অপহরণের বিচার না হবে, প্রকৃত অপরাধীদের চেহারা উম্মোচিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত এই ঘটনা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমির কপালে একটা কলঙ্কচিহ্ন হয়ে দৃশ্যমান হয়ে থাকবে। যতদিন পর্যন্ত না আমরা কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে পারব, একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারব না।

মনে রাখবেন, পাহাড়ের ‘অসহায়’ চাকমা ‘উপজাতির’ মানুষের প্রতি সহানুভূতি বা মায়া দেখানোর প্রশ্ন এটা নয়- গোটা দেশের মর্যাদার প্রশ্ন এটা, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে বাঙালীর দায় মোচনের প্রশ্ন এটা। যে অন্যায় আমরা করেছি, তার প্রতকার আমাদেরকেই করতে হবে।

(৩)
আর পাহাড়ে তরুণ নারীদেরকে এই সুযোগে একটা কথা বলি। মনে রাখবেন, কল্পনা চাকমার উত্তরাধিকারী আপনারা। লড়াই করা আপনাদের দায়িত্বের একটা অনিবার্য অংশ। কল্পনা চাকমার সংগ্রামটা অব্যাহত রাখা আপনি উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছেন। না, বন্দুক নিয়ে নেমে পড়তে হবে এমন কোন কথা নাই। লড়াই-সংগ্রাম গণতান্ত্রিক পন্থায়ও হয়। কিন্তু লড়তে আপনাকে হবেই, কেননা আপনি জন্মেছেন এমন একটা পরিস্থিতে যেখানে নিজের অধিকার আদায়ের জন্যে সংগ্রাম না করে উপায় নেই।

সংগ্রামটা কি? পাহাড়ে নারীর সংগ্রাম হচ্ছে ত্রিমুখী সংগ্রাম। একটা তো হচ্ছে জাতিগত অধিকারের সংগ্রাম। পৃথিবীব্যাপী আদিবাসী মানুষের যে সংগ্রাম সেটার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ আপনি। সেই সংগ্রাম থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবেন না। জাতিগত স্বীকৃতি, ভূমির অধিকার, নিজের সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার- এই সবকিছুর জন্যেই যে অব্যাহত লড়াই সেটাতে অংশ না নিয়ে থাকতে পারবেন? পারবেন না। সেই সাথে দেশব্যাপী মেহনতি মানুষের মুক্তির লড়াই। দেশব্যাপী এই লড়াইয়েও আপনাকে অংশ নিতে হবে।

আরেকটা লড়াই আছে যেটা একান্তই নারীর লড়াই, নারীর সংগ্রাম- সেটা হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর অধিকারের লড়াই। আমরা যেটাকে নারী অধিকারের সংগ্রাম বলি বা কেউ কেউ নারীবাদ বলে চিহ্নিত করেন যেটাকে- সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সেটাও আপনার জীবনসংগ্রামেরই একটা অনিবার্য অংশ। পিতৃতন্ত্র ব্যাপারটা কেবল শহরে বা সমতলে বিদ্যমান এমনটা ভাববেন না। পিতৃতন্ত্র পাহাড়েও বিদ্যমান, আদিবাসী সমাজেও বিদ্যমান।

মনে রাখবেন, কল্পনা চাকমা অবিভক্ত হিল উইম্যান কাউন্সিলের নেতা ছিলেন। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই সেটা তাঁর সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।

(৪)
কল্পনার সেই চিৎকার, দাদা মরে বাজা/(দাদা আমাকে বাঁচাও), সেটা থেমে যায়নি। আমরা যারা আমাদের বোন কল্পনাকে রক্ষা করতে পারিনি বলে অসহায় গ্লানি নিয়ে জীবন যাপন করে যাচ্ছি, আমরা আর কতদিন বেঁচে থাকব জানিনা। ১৯৯৬ থেকে ২০২১ কতো বছর হয়েছে? আমরা তো একটা প্রপার(যথাযথ) তদন্তই নিশ্চিত করতে পারিনি অদ্যাবধি।

কিন্তু যেদিন আমি মরে যাব সেদিন যদি দেখি যে পাহাড়ের চুড়ায় চুড়ায় হাজার কল্পনা চাকমা দৃঢ় পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিবাসী হিসাবে, দেশের একজন নাগরিক হিসাবে এবং, সবার উপরে, একজন নারী হিসাবে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার সংগ্রামে, সেদিন অন্তত এই সান্ত্বনা নিয়ে যেতে পারব যে না, একজন কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা যায়, গুম করে দেওয়া যায়, কিন্তু পাহাড়ের ঘরে ঘরে কল্পনা চাকমারা জন্ম নেয় বারবার।

ইমতিয়াজ মাহমুদঃ লেখক ও আইনজীবী

Back to top button