জাতীয়

কল্পনা’র মামলা খারিজ জনগণের ন্যায়বিচারের অধিকারের সাথে তামাশা, বলছেন বিশিষ্টজনরা

কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৮ বছর

আইপিনিউজ ডেক্স: আজ ১২ জুন ২০২৪, পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন এর সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমার অপহরণের ২৮ বর্ষপূর্তি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন দিবাগত রাতে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল ভিডিপি ও সেনা সদস্য কর্তৃক অপহরণ করা হয়। এ সময় অপহরণকারীরা কল্পনার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমাকেও বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। টর্চের আলোতে স্পষ্টতই অপহরণকারীদের মধ্যে থেকে বাড়ির পাশ্বর্বতী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লে: ফেরদৌস (মো: ফেরদৌস কায়ছার খান) এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার মো: নুরুল হক ও মো: সালেহ আহমদকে চিনতে পারেন বলে জানান কল্পনার দুই ভাই।

সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে কল্পনা চাকমা অপহরণের এই ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যাপক আলোড়ন তুলে। এ ঘটনার পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড়ও উঠে। ফলে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হন। সাবেক বিচারপতি আব্দুল জলিল একজন সৎ বিচারপতি ছিলেন। এ জন্য তিনি কল্পনা চাকমার অপহরণের প্রকৃত সত্যতা খুজঁতে ১৯৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন চাপে সত্যটা প্রকাশ করতে পারেননি। তবে জলিল কমিশনের একটা বক্তব্য ছিল, স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন, তবে কার দ্বারা অপহৃত হয়েছেন সেটি তিনি বলে যাননি। ১২ জুন ১৯৯৬ ভোর হওয়ার সাথে সাথে সর্বত্র কল্পনার খোঁজখবর নিয়েও কোনো হদিশ না পাওয়ায় কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা স্থানীয় মুরুব্বি সম্রাটসুর চাকমা ও ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমাকে নিয়ে বাঘাইছড়ির টিএনও (বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট বিষয়টি অবহিত করেন। বাঘাইছড়ি টিএনওর কাছে বর্ণিত বিবরণের অংশবিশেষ থেকে নিয়ে বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং থানায় তা মামলা নং ২, তারিখ ১২/০৬/৯৬ ধারা ৩৬৪ দ: বি: হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

কল্পনা অপহরণ ইস্যুতে আঁকা ছবি। শিল্পী: কনকচাঁপা চাকমা।

এদিকে নথিভুক্ত হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হলেও সেই রিপোর্টে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে উক্ত চূড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। এরপর বাদীর নারাজী আবেদনের প্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ২০১০ শুনানী শেষে মামলার বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত সিআইডি পুলিশকে নির্দেশ দেন। এরপর আদালতের নির্দেশে একে একে চট্টগ্রাম জোন সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কয়েকজন পুলিশ সুপার রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একের পর এক ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করেন। কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা ও মামলার বিশ বছর ও পাঁচ মাসের অধিক সময় পর ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ তাঁর চূড়ান্ত রিপোর্ট রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কগনিজেন্স আদালতে দাখিল করেন। তাঁর রিপোর্টেও পূর্বের রিপোর্টের বক্তব্যগুলো চর্বিতচর্বন করে প্রকৃত পক্ষে দোষীদের ও অভিযুক্তদের আড়াল করা হয় এবং ‘…সার্বিক তদন্তে লেঃ ফেরদৌস, ভিডিপি নূরুল হক ও পি.সি সালেহ আহমেদের উক্ত ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে দাবি করা হয়। এমনকি রিপোর্টে ‘কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে সত্য বলিয়া প্রমাণিত হয়’ বলে স্বীকার করা হলেও ‘দীর্ঘ ২০ বৎসর ৩৯ জন তদন্তকারী অফিসারের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কল্পনা চাকমাকে অদ্যাবধি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই এবং অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ’ বলে দায়িত্বহীন ও হতাশাব্যঞ্জক বক্তব্য তুলে ধরা হয়।

এদিকে কল্পনা অপহরণ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা উক্ত ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। এবিষয়ে আদালত গত ৮ জুন ২০১৭ প্রথম শুনানির আয়োজন করেন এবং নারাজির উপর পুলিশের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এরপর থেকে আদালত একের পর এক শুনানির দিন ধার্য করলেও পুলিশ এ বিষয়ে বার বার প্রতিবেদন দাখিলে অপারগতা প্রকাশ করে ক্রমাগত সময় চাইতে থাকেন।

বক্তৃতারত কল্পনা চাকমা

অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক যে, গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তার নেতৃত্বে রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতও মামলার ৩৯তম কর্মকর্তার চূড়ান্ত রিপোর্টটি গ্রহণ করে এবং বাদী কালিন্দী কুমার চাকমার নারাজী আবেদন নাকচ করে মামলাটি চ‚ড়ান্তভাবে অবসানের রায় দেন। কল্পনার হদিশ, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি এবং ভুক্তভোগী পরিবারের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত না করেই কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি খারিজের আদেশ কল্পনা চাকমা অপহরণকারীদের যেমন অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে, তেমনি অপরদিকে ভুক্তভোগী কল্পনা ও তার পরিবারের মানবাধিকারকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং বিচারহীনতার চরম এক নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে মনে করছেন দেশের কয়েকজন বিশিষ্টজন।

যা বলছেন বিশিষ্টজনরা: 

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, “একজন বিচার প্রার্থী হিসেবে কল্পনার ভাই নারাজি দিয়েছিলেন। কিন্তু মামলা খারিজ করে দেওয়ার মধ্যে আমাদের সন্দেহ ও প্রশ্ন তুলবার অবকাশ আছে। একটা নির্দিষ্ট সরকারী কর্মকর্তা কল্পনা চাকমাকে তুলে নিয়ে আসে। তার পর থেকে কল্পনা চাকমা নিখোঁজ। সে দায় তো উক্ত কর্মকর্তা এড়িয়ে যেতে পারে না। আমরা তো জানি সেই কর্মকর্তার কথা কিন্তু যে রিপোর্টগুলো তদন্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এযাবৎকালে এসেছে কোনো সময়ই তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কাজেই এটা দু:খজনক। এই মামলাটি উচ্চ আদালতে নিয়ে গিয়ে বিচার নিশ্চিত করা দরকার।”

এদিকে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির আইপিনিউজকে বলেন, “কোর্টের যে আদেশ আমাদের জন্য অত্যন্ত দু:খজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। তদন্ত কর্মকর্তাদের রিপোর্টও হাস্যকর ও অযৌক্তিক বলে আমি মনে করি। কিন্তু এই রিপোর্ট গ্রহন করে কোর্ট যে মামলা খারিজ করে দিলেন তা অযোক্তিকতো বটেই একইসাথে এটা মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার, মানবাধিকারের সাথে তামাশা করা হল। এতে আমি ভীষণ ভীষণ ক্ষুব্দ।”

কল্পনা চাকমা

নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবির আরো বলেন, “এর মধ্য দিয়ে বোঝা গেল যে, আসলে ন্যায়বিচার সবাই পায়না। আপনি যদি আদিবাসী হন, নারী কিংবা পাহাড়ী হন তাহলে ন্যায়বিচার আশা করা যাবে না। অন্যদিকে ঘটনার সাথে যদি আর্মি জড়িত থাকে তবে কোনো কিছু করা যাবে না। এই বার্তাটি খুবই পরিষ্কার। যেমন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যে তনু হত্যা হলো তার বিচারই হয়নি, হবেও না।”

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ বলেন, “কল্পনা অপহৃত হয়েছে আজকে থেকে ২৮ বছর আগে। এত বছর পরে এ মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে আমি তিনটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরবো। প্রথমত এ বিষয়ে ‘রাষ্ট্রের অমনোযোগীতা’ দ্বিতীয়ত ‘উদাসীনতা’ আছে বলে প্রমাণিত হল। অন্যদিকে এ বিষয়টি নিয়ে আদিবাসী অধিকার আন্দোলনেও এক ধরণের ঘাটতি আছে বলে মনে করি।”

তিনি বলেন, “কল্পনা অপহণের ইস্যুটি এখন ‘স্মরণ’ এর পর্যায়ে চলে গেছে। কেবল অপহরণ দিবসটি আসলে প্রতিবছর এ নিয়ে মাতামাতি হয় এবং দিবস কেন্দ্রিক আন্দোলন হয়ে গেছে। এই বিষটি নিয়ে লাগাতার আন্দোলন আমি সেভাবে দেখিনি। বাকী সময়গুলো কল্পনা চাকমা প্রায়ই বিস্মৃত থাকে। অন্যদিকে কল্পনা চাকমা’র একটা রাজনৈতিক পরিচয় আছে। সেকারণেই রাষ্ট্রও এ মামলাটি’র বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছেনা বলে মনে করি।”

এদিকে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, “আমাদের রাষ্ট্র যে নিষ্ঠুর, অমাণবিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ণবাদী তা এই কল্পনা চাকমা’র ২৮ বছরের নিরুদ্দেশ এবং তার অপহরণ মামলা খারিজ হওয়াই জলন্ত প্রমাণ। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেকেই হই চৈ করল। কিন্তু কারোর দিবে রাষ্ট্র কর্ণপাত করলো না। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দু:খজনক ও দুর্ভাগ্যজনক।”

এ আদিবাসী নেতা আরো বলেন, “২৮ বছর ধরে কল্পনা চাকমা’র অপহরণ ঘটনাটি আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থার যে দুর্বলতা ও অকার্যকারীতা সেটিকে স্পষ্ট করল। তবে কল্পনা চাকমা’র সংগ্রাম নিশ্চই আজকের তরুণ মানবাধিকার কর্মীদের প্রেরণা দিবে ও উদ্দীপ্ত করবে। আদিবাসীদের অধিকার, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর কাজ তরুণদের প্রেরণা দিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”

Back to top button