কল্পনার তেজ সামাল দিতে, অপহৃত হতে হয়েছে: জোবাইদা নাসরীন
চেলসী রেমাঃ গত রবিবার ধানমন্ডীর ছায়ানটে কল্পনা চাকমা অপহরণের দৃষ্টান্তমূলক তদন্ত, শাস্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবিতে বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম ও বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর আয়োজনে সংহতি সমাবেশ ও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ১২ই জুন ১৯৯৬ সালে নিজ বাড়ী থেকে অপহরণের স্বীকার হয়। ঘটনার ২৬ বছর কেটে গেলেও এখনো খোঁজ মেলেনি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমার।
অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন কণা বলেন ‘‘কল্পনা সেসময় পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। একই সাথে নিজ সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধেও কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশে নারী আন্দোলন একসময় জাতীয়তাবাদী ছিল। কল্পনা অপহরণের পরই প্রথম এই জাতীয়তাবাদী চরিত্রে অভিঘাত তৈরী করে। তখনই মূল ধারার নারী আন্দোলনের সাথে পাহাড়ের আদিবাসী নারী আন্দোলনের এক সমন্বয় ঘটে। কল্পনা চাকমার মেজাজের ধার কেবল বুঝতে পেরেছিল বিশেষ বাহিনীরা। যার জন্য তাকে অপহরণ করেই নি:স্তব্ধ করে দেওয়া হল।”
“এখন আর শুধুমাত্র শাস্তি নয়, সঠিক তদন্ত চাই।” বলেন রেখা চৌধুরী, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
কি হয়েছিলো ১২ই জুন ১৯৯৬ সালে?
১৯৯৬ সালে ১২ই জুন আনুমানিক ১.৩০ এর দিকে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত অপহরণ করে কল্পনা চাকমাকে। ঘটনার সময় কল্পনা চাকমার দুই ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমাকে লক্ষ্য করে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। অপহরণের পরপরই কালিন্দী কুমার চাকমা বাঘাইছড়ি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। কল্পনার বড় ভাইয়েরা টর্চের আলোতে বিশেষ বাহিনীর অপহরণকারীদের চেহারা চিনতে পারে বলে দাবি করেছিলেন।
অপহরণের ঘটনার কিছুদিন পর অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোন রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি।
অপহরণ মামলা নথিভুক্তির প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালে পুলিশের চূড়ান্ত তদন্তের রিপোর্টে অভিযুক্তদের এড়িয়ে যাওয়া হয়। এর ফলে কালিন্দী কুমার চাকমা বাদী হয়ে আদালতে উক্ত চূড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করে। এ আবেদনের শুনানিতে, আদালত সিআইডি-কে মামলার জোর তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্ত রিপোর্টে ‘কোনো হদিস পাওয়া যায়নি’ বলে উল্লেখ করে সিআইডি। কালিন্দী কুমার চাকমা আবারও সিআইডির তদন্ত প্রত্যাখান করেন, বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
২০১৪ সালে রাঙ্গামাটির জজ আদালত, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারকে তদন্ত সাপেক্ষে একটি প্রতিবেদন দাখিল করার দায়িত্ব প্রদান করে। পুলিশ সুপার আমেনা বেগম রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করলেও তার মধ্যে কোন অগ্রগতির রেশ দেখা যায়নি।
২০১৫ সালে মামলার তদন্ত চলাকালীন সময় ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের বদলী হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন পুলিশ সুপারের নাম ‘সাঈদ তারিকুল হাসান’।
২০১৬ সালে মামলার ৩৯তম চূড়ান্ত রিপোর্ট রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কগনিজেন্স আদালতে দাখিল করা হলেও, সেই রিপোর্টেও কোন অগ্রগতির দেখা মেলেনি। বরং আগের রিপোর্টের বক্তব্যগুলোই তুলে ধরা হয়েছিলো এবং অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছিলো বলে দাবি করা হয়েছিলো। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি দাবী করেছিলো যে ‘অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি’। শুনানির পর শুনানির শেষে ২০১৯ সালে তদন্ত বন্ধ ঘোষণা করে দেয়া হয়।
১৯৯৬ সালে অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে অর্ধদিবস সড়ক অবরোধ বিক্ষোভ ডাকা হয়। সেখানে স্থানীয় ভিডিপি ও সেটেলারদের গুলিবর্ষনে রূপন চাকমা নিহত হয়। এবং ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে সুকেশ, মনতোষ ও সমর বিজয় চাকমা হত্যাকান্ডের ঘটনায়ও প্রশাসনের ভূমিকা নিষ্ক্রিয় ছিলো।