ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও মানুষের বিবর্তন – পাভেল পার্থ
জাতিসংঘ ‘লোকায়ত জ্ঞানকে’ ২০২২ সনের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য করেছে। ঘোষনা করেছে ‘লোকায়ত জ্ঞান সুরক্ষা ও জ্ঞানপ্রবাহ বিস্তার করে আদিবাসী নারী’। ‘লোকায়ত জ্ঞান’ এবং ‘আদিবাসী নারীর ভূমিকা’ প্রসঙ্গকে প্রতিদিন পাড়ি দিতে হয় এক দীর্ঘ তর্কের ময়দান। অস্বীকৃতি, রাজনীতি, কাঠামোগত বৈষম্য, প্রাণডাকাতি কিংবা মেধাস্বত্ত্ব লংঘন ঘিরে যেকোনো আলাপে চট করেই ‘আদিবাসী নারী ও লোকায়ত জ্ঞানের’ কোনো না কোনো উদাহরণ আমাদের সামনে উঁকি দেয়। আর এসব উদাহরণ ‘অপরত্বের বাহাদুরিতে’ আড়াল করে রাখলেও, কোনোভাবেই অনৈতিহাসিক নয়। বরং এসব উদাহরণ আমাদের সামনে মেলে ধরে টানটান বহুত্ববাদী সম্পর্ক, দর্শনের তল, সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও বিজ্ঞানমনস্কতা। তো জাতিসংঘ ঘোষিত ২০২২ সনের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য থেকে আমরা কী আন্দাজ করবো? এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে কি প্রান্তজনের ‘লোকায়ত জ্ঞানকে’ স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে? নাকি ‘লোকায়ত জ্ঞান’ সুরক্ষা ও বিস্তারে আদিবাসী নারীর ভূমিকাকে সম্মান জানানো হচ্ছে। কিন্তু অধিপতি কাঠামো ও জ্ঞানকান্ডে প্রবলভাবে আড়াল ও অদৃশ্য করে রাখা ‘লোকায়ত জ্ঞান’ ও ‘আদিবাসী নারীর’ মতোন এমন ‘যমজ প্রান্তিকতাকে’ এককাতারে গেঁথে ফেলার কারণ কী হতে পারে? হয়তো সমাজের প্রবীণজন, প্রচলিত মৌখিক বয়ান কিংবা কোনো কাঠামোগত বিদ্যায়তনিক পরিসর এর ব্যাখা দাঁড় করাতে পারবে। তবে চলতি আলাপের কাজ এই দীর্ঘ বাহাসকে ধাক্কা দেয়ার মানত করেনি। আদিবাসী নারীর লোকায়ত জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের কোনো সূত্র পাওয়া যায় কীনা তার কিছু অমূদ্রিত প্রাথমিক খসড়া উদাহরণ হাজির করছে এই আলাপ। লোকায়ত জ্ঞান, আদিবাসী নারীর ভূমিকা, মেধাস্বত্ত্ব তর্ক, অপরত্বের রাজনীতি বিষয়ে সতর্ক থেকেই চলতি আলাপ শুরু হচ্ছে।
একটা বিষয় হরহামেশাই ঘটে, বিদ্যায়তন থেকে শুরু করে চারধারের আপাত নিরীহ কী হিংস্র জিজ্ঞাসাগুলোতেও। জ্ঞানপ্রবাহ সুরক্ষা ও বিস্তারে আদিবাসী নারীর ভূমিকা কী? অধিপতি কাঠামোতে বরাবরই ‘ভেষজবিদ্যা’, ‘বুনন ও সেলাই’, ‘কৃষি ও জুমচাষ’ কিংবা ‘পশুপালনবিদ্যাকেই’ মূলত আদিবাসী নারীর লোকায়ত জ্ঞানকাঠামোর ভিত্তি হিসেবে পাঠ করা হয়। খুব বড়জোর ‘পূর্বাভাস ও আবহাওয়াপঞ্জিকা’ কিংবা ‘স্থাপত্যবিদ্যার’ ক্ষেত্রে কিছু বিরল উদাহরণ হাজির করে অধিপতি কাঠামো। এমনকি ‘লোকায়ত জ্ঞান’ বিষয়েও আমাদের রয়েছে তীব্র বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রেণিকরণের রাজনীতি। লোকায়ত জ্ঞান বলতে চট করে আমাদের সামনে মুখস্থ উদাহরণ হাজির হয়, কোনো আদিবাসী নারী বনের লতাগুল্ম পিষে পেট ব্যথার ভেষজ বানাচ্ছে কিংবা বাঁশের চটি দিয়ে বুনছেন কোনো কৃত্যের উপকরণ। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ, বিবর্তনবিদ্যা, প্রযুক্তিবিজ্ঞান কিংবা জ্যোর্তিবিদ্যা বিষয়ে ‘লোকায়ত জ্ঞানের’ খুব কম উদাহরণই আমাদের সামনে হাজির হয়। কেন হয় না? কারণ আমাদের মনের গহীনে আমরা টেনে চলছি ঐতিহাসিক কাঠামোগত বৈষম্য। এমনকি জ্ঞানবিস্তারে আদিবাসী নারীর ভূমিকাকে কেন আমরা জীবনের সকল প্রান্তব্যাপী আন্দাজ করতে পারি না? এর কারণও আমাদের সমাজ ও মনের গহীনে দগদগ হয়ে থাকা এক প্রশ্নহীন উপনিবেশিকতা। তো চলতি আলাপখানিও কোনোভাবেই এই উপনিবেশিক ও বৈষম্যমূলক ঐতিহাসিকতার ময়দানের বাইরের কেউ নয়। তবে সতর্ক ও সংবেদনশীল।
পৃথিবী সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব বিষয়ে নানারকম মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। পৃথিবীর প্রথমদিকে সরল, এককোষী এবং অমেরুদন্ডী জীবের উদ্ভব ঘটে। তারপর ধীরে ধীরে দীর্ঘ বিবর্তনের ভেতর দিয়ে জটিল, বহুকোষী এবং মেরুদন্ডী জীবের বিকাশ ঘটে। মানুষ এই সৌরজগতের পৃথিবী নামক গ্রহের জটিল বহুকোষী এক মেরুদন্ডী প্রজাতির জীব। মানব বিবর্তনের মানচিত্রে দেখা যায়, প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ লাখ বছর আগে হোমিনিড নামে পরিচিত প্রাচীন মানুষের উদ্ভব ঘটে পৃথিবীর বুকে। হোমিনিডরা সোজা হয়ে হাঁটাচলাফেরা করতো। ১৮ থেকে ২৩ লাখ বছর আগে হোমো হ্যাবিলিসদের দেখা পাওয়া যায়। হোমো হ্যাবিলিসরা কথা বলার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারতো। ৪ থেকে ১৯ লাখ বছর আগে হোমো ইরেকটাসদের সাক্ষাত পাওয়া যায়। যারা আগুন আবিষ্কার করেছিল এবং দলবদ্ধ হয়ে শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। ৩৫ হাজার থেকে দেড় লাখ বছর আগে প্রাচীন মানব নিয়ানডার্থালদের বিচরণ ছিল। নিয়ানডার্থালরা নানা ধরণের অস্ত্র ও তৈজস নির্মাণ করেছিল এবং সংঘবদ্ধ বসতি গড়ে তুলেছিল। প্রায় ৪০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার বছর আগেই আজকের ‘আধুনিক মানবপ্রজাতি হিসেবে পরিচিত হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানুষের’ বিকাশ ঘটেছে। ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ নামে পরিচিত মানবপ্রজাতিই প্রথম শিল্পকলার সূচনা করে, হাড় ও ধাতু দিয়ে নানা অস্ত্র ও ব্যবহার্য উপকরণ আবিষ্কার করে। কিন্তু ঐতিহ্যগত কী লোকায়তজ্ঞানের আলাপের ময়দানে আমরা কখনোই মানবসভ্যতার বির্বতন ও ক্রমবিকাশ নিয়ে খুব বেশি উদাহরণ দেখিনা। তো, আজকের আলাপে আমরা কিছুটা বোঝার চেষ্টা করবো মধুপুর শালবনের মান্দি নারীরা কীভাবে নিজেদের লোকায়ত বিবর্তনবিদ্যার মাধ্যমে আমার কাছে মেলে ধরেছিলেন মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাস।
বাংলাদেশে বাস্তুতন্ত্রের নানা ভাগ ও বিন্যাস আছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির নানামুখী সম্পর্ক। মান্দি বা গারো জাতির বসতিস্থাপনমূলক ভূবিদ্যা অনুযায়ী বাস্তুতন্ত্রকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। হা.বিমা, হা.ফাল এবং হা.রঙ্গা। মান্দিকুসুকে (আচিক ভাষায়) এর সরল অর্থ ‘মায়ের মাটি’ বা ‘গর্ভভূমি’। সমসাময়িককালে এই অঞ্চলটি ‘মধুপুর শালবন’ হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করেন। আসলে এটি এমন এক অ ল যার উত্তরে পর্বতশ্রেণি এবং দক্ষিণে জলপ্রবাহ অঞ্চল বিস্তৃত। হয়তো প্রস্তরযুগের পরপর কৃষিযুগের সূচনায় এই অঞ্চলে গড়ে ওঠেছিল আদি জুমসভ্যতা। মধুপুরের মান্দি গ্রামে খুঁজে পাওয়া কিছু মৌখিক আখ্যানে দেখা গেছে এই অঞ্চলে অরণ্যসৃষ্টির সাথে ‘বীজবৃষ্টির’ একটি কাহিনি আছে। মিদ্দি (দেবতা) মিশিসালজং ওপর থেকে নানা জাতের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে এই অ লে এক বিরাট অরণ্যের জন্ম দিয়েছিলেন। এই কাহিনি জানান দেয়, এই অঞ্চলের মাটি ও পানিস্তরের এক প্রাচীন বৈশিষ্ট্য যেখানে গড়ে ওঠেছে এক বিশেষ মিশ্র শালবন। আবার একইসাথে এই কাহিনি জানায়, কৃষিসভ্যতার সূচনালগ্নে হয়তো প্রাচীন মানুষেরা এই অঞ্চলের নানা প্রজাতির বীজ বহন করে এনেছিলেন এবং বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তো এই অরণ্য কতখানি বিস্তৃত ছিল প্রাক-কৃষিযুগে তা বলা মুশকিল। কিন্তু মধুপুরের মান্দিদের কিছু মৌখিক আখ্যান জানান দেয়, হা.বিমার এক বড় অংশ জুড়ে ছিল বলসালব্রিং (শালবন)। রাষ্ট্র ১৯৫০ সনে এই বনে জুমচাষ নিষিদ্ধ করে ও পরবর্তীতে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। মান্দি বয়ানে মানুষের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে মূলত তিথেং, গেণাল, মাচ্ছি, দেরমা-দরজং এবং মান্দি এই পাঁচ প্রজাতির মানুষের কথা জানা যায়। এদের উদ্ভব ও বিচরণকাল ভিন্ন ভিন্ন। এদের বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ ভিন্ন ভিন্ন।
তিথেং: তিথেংরা ছিল অরণ্যবাসী। এরা গাছের ডালে ঝুলে থাকতে পারত। এদের শরীর লোমশ থাকলেও মাথায় চুল কম ছিল। হাত পা কাটাছেঁড়া ক্ষত হলে তারা থুথু দিয়ে ঘষে চিকিৎসা করতে জানতো। তারা গাছের ওপরে এবং মাটির গুহায় বাস করতো। বড় গাছের নিচে এসব গর্ত গুহা থাকতো। এরা কাঁচা জিনিস খেত। গাছের ডাল ও ঝুরি দিয়ে ওঠানামা করার মই বানিয়েছিল তারা। এসব মই ব্যবহার করে তারা গাছ থেকে নিজেদের গর্তে ঢুকে ঘুমাত।
গেণাল: এরা তিথেংদের থেকে উচ্চতায় বড় ছিল। এরা বেশ শক্তিশালী ছিল। এরা এক জায়গায় বেশিদিন বসবাস করতো না। ঘুরেফিরে বেড়াত। এদের শরীরেও লোম ছিল। এরা পাথর দিয়ে অনেক কিছু শিকার করতে পারতো। এরা বড় বড় পাথর তুলতে পারতো। বন্যপশু শিকার করতে পারতো।
মাচ্ছি: মাচ্ছিদের মাথায় চুল ছিল। নারী-পুরুষ উভয়ের লম্বা চুল ছিল। এরা তিথেংদের থেকে উচ্চতায় লম্বা ছিল। এরা গাছের ডালে ঝুলতো না। এরা মাটিতেই থাকতো। এরা তুলনামূলকভাবে দ্রুত দৌড়াতে পারতো। এরাও বনের ভেতরে থাকতো। এরা বসতির আশেপাশে বীজ ছিটিয়ে বুনতো। এরা আগুন জ্বালাতে জানতো। এরা চাল স্ধি করে খেত। এরা কখনোই চুরি করতো না। কারো জিনিস নিত না।
দেরমা-দরজং: দেরমা-দেরজংয়ের বৈশিষ্ট্যের ভেতর বলা হয় এরা সর্বভূক। এরা ৬ মাস ঘুরেফিরে, শিকার করে ও খাদ্যগ্রহণ করে বেড়াত। আর ৬ মাস এরা বিশ্রাম নিত ও আহার করতো।
মান্দি: চিগেলবাড়িওয়ারিখুট্টি নামের এক জলবেষ্টিত অরণ্যভূমিতে ‘মান্দি’ প্রজাতির বিস্তারের কথা জানা যায়। এই মান্দিরাই আজকের ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ প্রজাতির মানুষ। মান্দিসামজে মৌখিকবয়ানে প্রচলিত ইতিহাস, আখ্যান ও বসতিস্থাপন সবকিছু এই প্রজাতির মানুষকে ঘিরেই। মৌখিক মান্দিপুরাণ জানায়, দিমারিসি ও নুরুমান্দি হলো আদি নারী ও পুরুষ। আবার এই মান্দি প্রজাতির বিবর্তনের প্রথম দিকের কিছু মানুষের নাম ও বৈশিষ্ট্য জানা যায়। যেমন, দিমারিসি-নুরুমান্দি, নুসি-দেমসি, আনাল-গুণাল। এছাড়া মান্দি মহাকাব্য শেরানজিংপালাতেও সমসাময়িককালের মান্দিসভ্যতার এক আদি বিবরণ পাওয়া যায়।
প্রত্মবিদ, বিবর্তনবিদ কিংবা ইতিহাসবিদেরা মূলত নানা বস্তুগত প্রত্নসম্পদ, ফসিল ও প্রত্নজৈবরাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করে মানববিবর্তনের ক্রমবিকাশের একটি রূপরেখা দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীতে নানা সমাজে মৌখিক বয়ান ও স্মৃতিবিস্মৃতির ভেতর এখনো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে থাকা বিবর্তন সম্পর্কিত নানা উপাদান ও ভাষ্য আমাদের কাছে সামগ্রিকভাবে প্রাণের উদ্ভব ও জীবনের বিবর্তন ও বিকাশকে বুঝতে সহযোগিতা করতে পারে। আর এজন্য আমরা লোকায়ত জ্ঞানপ্রবাহের ওপর আস্থা তৈরি করতে পারি। চলতি এই আলাপখানি মধুপুর শালবনের প্রবীণ মান্দি নারীদের ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতিভান্ড থেকে পাওয়া কিছু নমুনার মাধ্যমে একটা প্রাথমিক পর্যায়ের আলাপের সূত্রপাত করলো মাত্র। এই আলাপখানি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সামগ্রিক প্রস্তুতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও কাঠামোকে মজবুত করা জরুরি।
পাভেল পার্থঃ গবেষক ও লেখক। ই-মেইল: [email protected]