মতামত ও বিশ্লেষণ

এম এন লারমা ছিলেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল ধারার নেতাদের মধ্যে অদ্বিতীয়ঃ রাজা দেবাশীষ রায়

গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ও মহান বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৭৮তম জন্মদিবস উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাকমা সার্কেলের চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। আলোচনা সভায় প্রদত্ত তাঁর বক্তব্য নিম্নের পত্রস্থ করা হলো।

সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় নেতা শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, প্রয়াত নেতার বড় বোন শ্রীমতি জ্যোতিপ্রভা লারমা, সম্মানিত আলোচকবৃন্দ, সম্মানিত নেতৃবৃন্দ, সম্মানিত সুধীজন। আমি আজকে যা বলবো তা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত, একজন চাকমা হিসেবে, একজন পাহাড়ি হিসেবে, একজন আদিবাসী হিসেবে, একজন জুম্ম হিসেবে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে। আমার বক্তব্যের সাথে চাকমা সার্কেলসহ কোন প্রতিষ্ঠানের কোন সম্পর্ক নেই।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মত বিশাল ব্যক্তিত্ব ও নেতার বিষয়ে বলা মোটেই সহজ নয়। প্রথমত এম এন লারমার জীবনালেখ্যের বিষয়ে আমার জানা ও বোঝার মধ্যে এখনও অনেক বড় ফাঁক রয়ে গেছে। আজকের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অভিজ্ঞজনের বক্তব্য থেকে আমি শিখেছি। বিগত এম এন লারমা অনুষ্ঠান থেকেও শিখেছি। এখনও সেই শেখাজানা শেষ হয়নি। দ্বিতীয়ত আমি যাকে নিয়ে কথা বলছি, তিনি সম্ভবত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রগতিশীল ধারার নেতাদের মধ্যে অদ্বিতীয়। এই প্রমাণ আমরা পাই সমাজতন্ত্রবাদী একাধিক জাতীয় পর্যায়ের নেতা, শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মীর বক্তব্য ও লেখালেখি থেকে। অনেকেই তাঁকে আদর্শ নেতা ও কর্মী হিসেবে অভিহিত করেন, মান্য করেন ও অনুসরণ করেন। তাঁর নৈতিক চরিত্র, তাঁর জীবনাচার, তাঁর বিলাসবিহীন অভ্যাস এবং সৎ সাহসের জন্য। প্রমোদ বিকাশ কার্বারী, যিনি সাহিত্য জগতে ‘ফেলাযেয়্যা’ নামে পরিচিত, তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন এম এন লারমার ব্যাপারে। তাঁদের মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক, একে অপরকে ‘মাম’ বলে সম্বোধন করতেন। এম এন লারমা তাঁকে একবার বলেছিলেন, তাঁর নীতি-আদর্শ ও সংগ্রামের ব্যাপারে-‘গদ্দনাবো বেলেত্তোই ঘুজিলেও ত-মাম্মো কনদিন ন-খেমিবো’- এই কথাটা বলেছিলেন, অর্থাৎ ব্লেড দিয়ে গলা কেটে দিলেও তিনি তাঁর নীতি-আদর্শ, বিশ্বাস, সংগ্রাম থেকে সরে দাঁড়াবেন না। আরেকটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে তিনি ছিলেন একজন নীতিনির্ধারক। ‘আমি বাঙালি নই, আমি চাকমা’- এটা বলে তিনি গণপরিষদে এবং জাতীয় সংসদে যে বক্তব্যগুলো রেখেছিলেন এবং যে আইনী প্রস্তাবাবলী পেশ করেছিলেন তাতে অন্তর্নিহিত ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-আদিবাসী জাতিসমূহের সামষ্টিক রাজনৈতিক সত্তা এবং একটি বহুমাত্রিক, বহু সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথম তাত্ত্বিক বহিঃপ্রকাশ।
৭৪ সনে, আমি গত বছরও বোধ হয় বলেছি, আমি যখন এসএসসি পরীক্ষার জন্য ফরম ফিলাপ করছিলাম তখন সংবিধানে লেখা ছিলÑ ‘বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় বাঙালি’। আমি তা লেখতে রাজী ছিলাম না। আমরা রাঙ্গামাটি গভর্ণমেন্ট হাই স্কুলে যারা সেবছর ফরম ফিলাপ করেছি, আমার জানামতে যারা পাহাড়ি বা জুম্ম আমরা একজনও ‘বাঙালি’ লিখিনি। আমাদের শিক্ষক আমাদেরকে বললেন, ‘ফরম ফিলাম যদি না হয়, যদি তোমরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পার, তার জন্য আমি দায়ী থাকবো না।’ কিন্তু আমরা সেটা মানতে নারাজ ছিলাম এবং আমরা বাংলাদেশিই লিখেছি এবং আমরা পরীক্ষা দিয়েছি, এসএসসি পাশ করেছি। তখন যদিও বা আমার কৈশোর বয়স, তখন থেকে আমি তাঁর নীতি-আদর্শকে, তাঁর স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে মনেপ্রাণে সমর্থন করতাম। রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরেও তাঁর মানবতাবোধ, প্রতিবেশবান্ধবতা, নারীবান্ধবতা এবং পতিতালয়ের যৌনকর্মীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁকে আমরা স্মরণ করি। মেহনতি মানুষের অধিকারের পক্ষে তাঁর প্রতিনিধিত্বশীল উদ্যোগ বাংলাদেশের সংসদসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল বিরল। দেশের ভেতরে ও বাইরে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকার, আদিবাসী অধিকার, উন্নয়ন, পরিবেশ নিয়ে আমি দু’যুগ ধরে জড়িত ছিলাম। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক আইন, সনদ, চুক্তি ইত্যাদির প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিষয়ে আমার সুযোগ হয় অংশগ্রহণ করার। সেই দিক থেকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে বর্তমানে আদিবাসী অধিকারের জাতীয় পর্যায়ে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে আন্দোলন চলছে, এম এন লারমা যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আন্দোলন করেছেন তার সাথে হুবহু না হলেও অনেকাংশে মিল আছে। এতে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে, তা হলো- পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মসহ পৃথিবীর আদিবাসী জাতি ও তার জনমানুষের এবং মেহনতি মানুষের বর্তমান কট্টর পুঁজিবাদী ধারার তথাকথিত গণতন্ত্রের কাঠামো ও প্রক্রিয়াতে মুক্তির পথ সুগম নয়।
বাংলাদেশের গণপরিষদ ও তৎপরবর্তী জাতীয় সংসদে ১৩ অক্টোবর ১৯৭২ থেকে ২১ নভেম্বর ১৯৭৪ পর্যন্ত এম এন লারমার বক্তব্যের সহজ-সরল পঠন থেকেই আমরা তাঁর সমাজতন্ত্রবাদী মতাদর্শের পরিষ্কার ধারণা পাই। এতে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। আইনগতভাবেও আইনসভাতে তাঁর বক্তব্যের নাড়িভুড়িতে জুড়ে রয়েছে মানবাধিকারের কথা যা বাংলাদেশের সংবিধানের ভাষায় ‘মৌলিক অধিকার’ ও ‘মৌলিক স্বাধীনতা’। তিনি আইনসভাতেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে, স্বৈরাচারী আয়ুব সরকারের ন্যায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সরকারও বাক স্বাধীনতা, সংগঠন করার অধিকার, সমাবেশ ও জনসভা করার অধিকার একদিন ভূলুন্ঠিত করতে পারে। এই সংশয় এখন সত্যে রূপান্তরিত হয়েছে এবং হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে তো বটেই।
দেশের মালিকানা নীতির ব্যাপারে তিনি আইনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। প্রত্যক্ষভাবে না বলে থাকলেও, আমার মনে হয় তিনি সামষ্টিক ও সমষ্টিগত ভূমি ও সম্পদের অধিকারের অস্বীকৃতির বিষয়ে তাঁর সংশয়ের কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন। কারণ বর্তমান বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধানে ব্যক্তিগত অধিকার, সমবায়ের অধিকার ইত্যাদি মালিকানার কথা রয়েছে। কিন্তু সামষ্টিক অধিকার সংবিধানে ৭২-এও স্বীকৃত ছিল না, এখনও নেই। আমি মনে করি, সেই ইঙ্গিত উনি দিয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে তৎকালে যে দ্বিপাক্ষিক স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, তখনকার মানবাধিকারের অঙ্গনে সামষ্টিক অধিকারের ধারণার অবির্ভাব হয়ে থাকলেও তার প্রচার, প্রসার ও বাস্তবায়নে নানা রকমের বাধানিষেধ ছিল; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কারণে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজ এম এন লারমা যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি আদিবাসী অধিকারের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্লাটফরম থেকে জুম্ম ও অন্যান্য আদিবাসীদের অধিকারের জন্য লড়ে যেতেন এবং নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে যেতেন।
এম এন লারমা মার্কসবাদের একনিষ্ঠ ছাত্র ছিলেন এবং লেনিনবাদ ও মাওবাদ দ্বারাও তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে এই অঙ্গনে আমার কিছুটা বিচরণ ছিল। ক্ল্যাসিকেল মার্কসবাদে যে বিশ্বাস রয়েছে যে, শ্রেণিদ্বন্দ্বের কারণে আন্দোলন হবে এবং শ্রেণিবৈষম্যের ডাইনামিক্স এর মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে শাসকগোষ্ঠীর পতন এবং অবশেষে সমাজের বিবর্তনের ফলে শ্রেণিহীন ও রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সুবাদে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্ভবত ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রকে ডিকটেটরশীপ অব দ্য প্রোলেতারিয়েত হিসেবে সম্বোধন করতো। শ্রেণি সংগ্রাম হতে পারে, শ্রেণিদ্বন্দ্ব থাকবে এবং পুঁজিবাদীর বৈপারিত্য ও নৈতিক শূন্যতা- এটাও আমি মানি। মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখার পর এক শতাধিক বৎসরের বিশ্ব ইতিহাসে তাই সাক্ষ্য দেয়।
এখন এম এন লারমার নীতি-আদর্শকে আমরা অন্যভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। বৌদ্ধধর্মের নির্বাণের সাথে যদি আমি কমিউনিজমের একটা তুলনা করি, কমিউনিজমের সেই রাষ্ট্রহীন-শ্রেণিহীন ব্যবস্থা ও বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাণ কিছুটা কাছাকাছি। কিন্তু বিশ্বে, সমাজে এখনো এই দুটো বিষয় রয়ে গেছে সোনার হরিণের মতো। তবে নীতিগত দিক থেকে মার্কসবাদের চেয়ে মানবিক রাজনৈতিক তত্ত্ব আমার জানা মতে এখনও উদ্ভাবিত হয়নি। বর্তমান পুঁজিবাদী ও মুক্তবাজার অর্থনীতি ব্যবস্থায় সত্যিকার গণতন্ত্র তো নেইই।
নেতা মানবেন্দ্র লারমার জীবনাচারের আরো অনেক দিক আমরা লক্ষ্য করতে পারি। যথা তাঁর প্রতিবেশবান্ধবতা, বন্যপ্রাণী, বন ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও মৈত্রী। এ বিষয়ে এম এন লারমা স্মারকগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে তাঁর দলের এক সহকর্মী লিখেছিলেন, হেডকোয়ার্টারে তারা যখন ছিলেন (সম্ভবত তারা তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন), তখন সেই হেডকোয়ার্টারের আশেপাশে বনের কথা, ছড়ার কথা, প্রতিবেশের কথা এবং জীবজন্তুদের না মারার জন্য উনি সহযোদ্ধাদের বলতেন। কেউ কেউ হয়তো এম এন লারমার মানবতাবোধ, প্রতিবেশ ও প্রাণজগতের প্রতি এই অহিংসাকে বৌদ্ধ দর্শন ও আদিবাসী আধ্যাত্মিকতার সাথে মিল দেখতে পাবেন। এতে তাঁর পারিবারিক বা সামাজিক জীবনের প্রভাব যে নেই তা বলা মুশকিল। এম এন লারমার পিতা-মাতা চিত্ত কিশোর চাকমা ও সুভাষিণী দেওয়ানের প্রভাব নিশ্চয়ই তাঁর চরিত্রের বিকাশে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে রয়েছে, এবং তাঁর গ্রামবাসী তৎকালীন মাগুরুমের চাকমা সমাজের প্রভাবও নিশ্চয় আছে। তাঁর পিতার জীবনের শেষ দিকে শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি কাটিয়েছিলেন বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে। আমার বাসস্থান রাঙ্গামাটির রাজবাড়ি দ্বীপের রাজবিহারে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে অনেক দিন অবস্থান করেছিলেন। বর্তমানে মাগুরুমে তাঁর সমাধিস্থলতুল্য একটি বিহার রয়েছে, যা ছিল লারমা পরিবারের আদি আবাসস্থল।
এম এন লারমার দার্শনিক মতবাদকে আমি থাইল্যান্ডের একজন দার্শনিক এবং রাজনৈতিক কর্মী সুলাক শিবরক্ষার সাথে অনেক মিল খুঁজে পাই। আচার্য সুলাক-এর ব্যাপারে তাঁর অনুসারী ও ভক্তরা তাঁকে বলেন তিনি নাকি বৌদ্ধ-সমাজতন্ত্রী-প্রতিবেশবাদী-নারী অধিকার কর্মী, সব দর্শন মিলেই। বাস্তব জীবনে সাদা পোশাক পড়া হাস্যোজ্জল এম এন লারমার সাথে আমার তিন-চারবার দেখা হয়েছে। সব শেষ দেখা সম্ভবত কাপ্তাইয়ে, শ্রীলঙ্কা অথবা ভারত থেকে আসা এক বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মানে দেয়া এক নৈশভোজে। তখন তার সহযোগী ছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা।
এম এন লারমা আমাদের জন্য একটি রোল মডেল। ১৯৬১-৬২-তে আয়ুব খানের সামরিক শাসন শেষ হয়ে যায়। তার আগ পর্যন্ত মার্শাল ল ছিল। এম এন লারমাকে চট্টগ্রামের বান্ডেল রোডের হোস্টেল থেকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনও মার্শাল ল ছিলো কি নাই তা আমি নিশ্চিত নই। তখন ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুল্স নামে এক বিধি ছিল। সেটার অধীনে গোয়েন্দারা, ডিআইবিরা সবসময় তাঁর আচরণ, গতিবিধি লক্ষ্য করতো। তাঁর কার্যক্রমকে ‘কমিউনিষ্ট’ ও রাষ্ট্র বিরোধী কার্যক্রম হিসেবে বিবেচিত করে তাঁকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা হয়। যে কাপ্তাই বাঁধ সবাইকে ডুবিয়ে ভূমিহীন বানালো, চাকমাসহ বিভিন্ন জাতির একসঙ্গে বসবাসের যে একটা সামষ্টিক আত্মা ছিলো তাতে আঘাত দিলো তার বিরুদ্ধে তিনি লিফলেট বিতরণে সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যদিও তখন কেবল কিছু যুব ও ছাত্র ছাড়া বাকীরা সাহস করেননি সেই আন্দোলনে সামিল হতে। দু’বছর জেলে থাকার পর উনি বেরিয়ে এলেন। তারপর উনি বিএ পাশ করলেন, এলএলবি পাশ করলেন।
এছাড়া ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মত ব্যক্তিত্বের সামনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের স্বায়ত্তশাসনসহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে “উপজাতীয় স্বায়ত্তশাসিত এলাকা” হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। তিনি মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করতেন। বঙ্গবন্ধুর মত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদে সাহসিকতার সাথে কথা বলার মতো বুকের পাটা কয়জনের ছিল তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের উদাহরণ ছিল বিরল। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ যখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে চার দফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা পেশ করেছিলেন, এতে ছিল ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের কথা, উপজাতীয় প্রধানদের দপ্তর সংরক্ষণের কথা, আইন পরিষদসহ স্বায়ত্তশাসনের কথা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্ভবত তিনিই প্রথম আইনজীবী বা এডভোকেট। সাংবিধানিক আইন সম্পর্কে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা ছিল। গণপরিষদ ও আইনসভায় সাংবিধানিক আইনের উপর তাঁর অনেক আলোচনা আপনারা পড়ে দেখতে পারেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ও প্রশাসনিক মর্যাদার বিষয়ে, ভারত শাসন আইন ১৯৩৫, ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধান, ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের সংবিধান ইত্যাদির ব্যাপারে তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিলো।
২০১১ সনে যখন সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সরকার আলোচনা শুরু করে। তৎকালীন আদিবাসী সংসদ সদস্যদের অনুরোধে একটি কমিটিতে আমি নেতৃত্ব প্রদান করি, সাংবিধানিক সংস্কারে আদিবাসী অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ অধিকার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। সেই কমিটিতে অন্যান্যের সধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নেতা গৌতম কুমার চাকমা, আজকে উপস্থিত মঙ্গল কুমার চাকমা ও সঞ্জীব দ্রং ছিলেন। আমরা যখন প্রস্তাব প্রণয়ন করি, সে সময় আমরা বাহাত্তরে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যে তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক প্লাটফরম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের অধিকারকে তুলে ধরেছিলেন, তার আলোকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন ভাষায় প্রতিফলন করতে আমরা চেষ্টা করেছি। সেই প্রস্তাবাবলীর সামান্য অংশ সংবিধানের ২০১১-এর সংশোধনীতে এসেছে। সেটা হলো নতুন ২ক অনুচ্ছেদে ‘প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এর সাথে “তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন” মর্মে সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মৌলিকভাবে আমাদের দাবিনামাগুলো সংশোধনীতে আসে নাই। ভবিষ্যতে যদি কোনদিন আবারও সাংবিধানিক পরিবর্তনের সুযোগ আসে, তখন আমাদের একইভাবে চলে যেতে হবে সেই ১৯৭২ সালে, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রস্তাবাবলীতে, যেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি দেখেছিলেন। উনি উনার আইনী দৃষ্টিকোণ থেকে, উপলব্ধি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০-কে রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন এবং ১৯০০ সনের রেগুলেশনকে তিনি কেবল ডিসি বা সরকারের অতিক্ষমতা বা অপকৌশল বা অপপ্রশাসন বলে দেখেননি। এতে তিনি জুম্মদের স্বকীয়তা ও বিশেষ আবাসভূমির ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিলেন।
২০১৭ সনে যখন সুপ্রিম কোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের মামলার অন্তিম শুনানি গৃহীত হয় এবং অবশেষে রায় প্রদান করা হয়, তখন এই রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন প্রণীত হওয়ার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই অঞ্চলের আদিবাসীদের সত্তা ও অধিকারকে সংরক্ষণ করা এবং এ রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে, এই রেগুলেশন সংবিধান পরিপন্থী নয়। এই রেগুলেশনের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি বিশেষ প্রশাসনিক ও আইনগত মর্যাদা রয়েছে, যদিও সংবিধানে প্রত্যক্ষভাবে সেটা লেখা নেই। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে হলেও সেটার একটা সাংবিধানিক মর্যাদা রয়েছে। রায়ে এমনও বলা হয়েছে যে, এই রেগুলেশনের মূল স্পিরিটের পরিপন্থী কোন আইন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রয়োগ করা হলে সেটা আইন বিরোধী এবং সংবিধান বিরোধী হবে। আগামী ১৭ অক্টোবর আঞ্চলিক পরিষদের সাংবিধানিক বৈধতা ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর কিছু ধারার বৈধতার উপর শুনানী হবে আপিল বিভাগে। জানি না কী হবে সেখানে। আজকের নেতা জেবি লারমা মহোদয়ের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি এই মামলায় পক্ষভুক্ত হয়েছে, চাকমা সার্কেলও পক্ষভুক্ত হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে, আইন-আদালতেও আমাদের লড়ে যেতে হবে আমাদের অধিকারের জন্য।
সে যাই হোক, এম এন লারমার আদর্শকে ধরে রাখতে হলে তাঁর মতবাদ ও জীবনাচার থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের প্রেক্ষাপট অনুসারে আমাদের সংগ্রামে এগুতে হবে। এতে কৌশলী হতে হবে অবশ্যই এবং এখানে আমাদের যে সহিংসতা চলছে এটা আমাদের পরিহার করতে হবে। এম এন লারমার সেই কৌশলগুলো আমাদের অবলম্বন করতে হবে। আমি আজকে এই বিশেষ দিনে এম এন লারমার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আজকের আয়োজক সংগঠনের সদস্যদেরকে এই উদ্যোগের জন্য এবং আমাকে আমন্ত্রণ করার জন্য, এবং কিছু বলার সুযোগ দেয়ার জন্য, আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই বিশেষ দিন উদযাপন সফল হোক এবং এম এন লারমার স্মৃতি ও আদর্শ দীর্ঘজীবী হোক।

Back to top button