মতামত ও বিশ্লেষণ

এম এন লারমার সংসদীয় সংগ্রামের কিছু অনালোচিত পাঠ ও বর্তমান বাস্তবতাঃ মঙ্গল কুমার চাকমা

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম অধ্যায় হচ্ছে তাঁর দূরদর্শীসম্পন্ন, নির্ভীক ও প্রাজ্ঞ সংসদীয় সংগ্রাম। তাঁর সংসদীয় সংগ্রামের অনেক দিক নিয়ে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। তবুও তাঁর সংসদীয় জীবন ও সংগ্রামের বিশ্লেষণের অন্ত নেই। বস্তুত তাঁর সংসদীয় জীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে জয়যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ভূমিধস জয় হলে ’পরে পাকিস্তানের তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সেই নির্বাচনী ফলাফলকে মেনে নেয়নি এবং আওয়ামীলীগকে সরকার গঠন করতে দেয়নি, সেহেতু প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য হিসেবে সে সময় এম এন লারমার পার্লামেন্টারী জীবন বাস্তবিকভাবে শুরু হয়নি বলে বলা যেতে পারে। প্রকৃত পক্ষে তাঁর সংসদীয় সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গঠিত গণপরিষদের অধিবেশন শুরুর মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদ গঠিত হয়।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন পাকিস্তানের ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জনসংখ্যার অনুপাতে জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছিল ১৬২টি আসন এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০০টি। সেসব আসনের মধ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদের ১৬০টি আসনে ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের ৭টিতে এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। জাতীয় পরিষদের অপর দুইটি আসনে স্বতন্ত্র সদস্য যথাক্রমে তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদীব রায় (পার্বত্য চট্টগ্রাম আসন থেকে) এবং ন্যাপের এ্যাডভোকেট সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নির্বাচিত হন। আর প্রাদেশিক পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এম এন লারমা ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে সাবেক বোমাং রাজা অংশৈ প্রু চৌধুরী মুসলিমলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় পরিষদে ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত উল্লেখিত ৪৬৯ জন সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে গঠিত হয়েছে ৪০৪ জন সদস্য নিয়ে (অপর সদস্যদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুবরণ করেন, অনেকে আওয়ামীলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন বা পাক বাহিনীর পক্ষ নিয়ে দুই/একজন পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করেন)। গণপরিষদের ৪০৪ জন সদস্যের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এম এন লারমা। আর ছিলেন ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। গণপরিষদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ ১৯৭২ এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য আইন জারি করে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। বস্তুত তখন থেকেই এম এন লারমার সংসদীয় জীবন শুরু হয় বলে বলা যেতে পারে। এরপর সদ্য প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সমর্থনে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল থেকে এম এন লারমা এবং দক্ষিণাঞ্চল থেকে চাইথোয়াই রোয়াজা স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সেই প্রথম জাতীয় সংসদ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সপরিবারে হত্যা করা পর্যন্ত বলবৎ ছিল। বলা যায় ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন বছর ছিল এম এন লারমার সংসদীয় জীবন। এম এন লারমার সংসদীয় জীবনের মেয়াদ মাত্র সাড়ে তিন বছর হলেও তার তাৎপর্য ছিল ব্যাপক ও অসীম। এম এন লারমার সংসদীয় বিতর্ক গণপরিষদ এবং প্রথম জাতীয় সংসদের ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাস খুঁজতে গেলে উইকপিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন তথ্যভান্ডারে এম এন লারমার নাম ঘুরেফিরে উঠে আসে। সেসব ইতিহাসে এম এন লারমার সংসদীয় বিতর্কগুলো নানাভাবে উদ্ধৃত থাকে।
এম এন লারমার সংসদীয় সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামের চারদফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংবিধানে জুম্মদেরকে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও ওয়ার্কআউট করা, সংবিধান বিলে স্বাক্ষর না করা ও বাঙালি হিসেবে পরিচয় না দেয়া, সংবিধানে দেশের শোষিত-বঞ্চিত কৃষক-শ্রমিক-মাঝিমাল্লা-কামার-কুমার-জেলে-তাঁতী-পতিতাদের মৌলিক অধিকার, স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর গভীর স্বপ্ন ও ভাবনা, দেশরক্ষা ও ডিফেন্স বাজেট, পবিত্র কোরান পাঠের পাশাপাশি গীতা-ত্রিপিটক-বাইবেল পাঠের দাবি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নানা আঙ্গিকে অনেক আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এম এন লারমার সংসদীয় জীবন ও সংগ্রাম সম্পর্কে জানা অনেক বাকি রয়েছে বলে বলা যেতে পারে। তৎকালীন আওয়ামীলীগের একাধিপত্য গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে একা যেভাবে অকুতোভয় চিত্তে সরকারের গণবিরোধী ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে এবং বঞ্চিত ও প্রান্তিক মানুষের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন সে বিষয়ে আরো গভীর গবেষণা ও পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে বলে বিবেচনা করা যায়। জাতীয় সংসদে তিনি জাতীয়-স্থানীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন, যেগুলোর মধ্যে এখনো অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনালোচিত রয়েছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তেল-গ্যাস। এই তেল-গ্যাস বিষয়ে এম এন লারমার চিন্তাভাবনা ও মতামত সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই মূল্যবান খনিজ সম্পদ সম্পর্কে এম এন লারমা জাতীয় সংসদে আলোকপাত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২১ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম বিল, ১৯৭৪’ আলোচনা করতে গিয়ে তিনি এসব গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন। জাতীয় সম্পদ রক্ষার জন্য এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন করার জন্য তিনি জোরালো মতামত রেখেছিলেন। “পেট্রোলিয়ামের আহরণ, উন্নয়ন, কাজে লাগানো, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিশোধন ও বাজারজাতকরণ সম্পর্কে বিধিবিধান-প্রণয়নকল্পে আনীত বিলটিকে ১৯৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর তারিখের মধ্যে জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রচার করা হোক” মর্মে এম এন লারমা জাতীয় সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রস্তাব সে সময় প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পেট্রোলের জন্য আজকে সারা বিশ্বে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেছে। সেই পেট্রোল যদি আমাদের দেশে পাওয়া যায়, সেটাকে সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রের হাতে না নিয়ে যদি আমরা ব্যক্তিগত মালিকানার অর্থনীতির পদক্ষেপ গ্রহণ করি, তাহলে সেটা আমাদের সংবিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হবে। এটা করা আমাদের পক্ষে উচিত হবে না।” এজন্য তিনি আপামর দেশবাসীর মতামত গ্রহণের নিমিত্তে জনমত যাচাইয়ের জন্য অধিকতর প্রচারের প্রস্তাব করেছিলেন।
এম এন লারমা দেশের তেল-গ্যাস প্রভৃতি মূল্যবান জ্বালানী সম্পদ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে কতটা জরুরী তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন, যা তাঁর উল্লেখিত বক্তব্য থেকে বুঝা যায়। দেশের তেল-গ্যাস হচ্ছে জাতীয় সম্পদ, জনগণের সম্পদ। এ সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন করতে হবে বলে তিনি জোরালো অভিমত দিয়েছিলেন। কোনক্রমেই এই জাতীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত মালিকানায় নিয়ে লুন্ঠন করতে দেয়া যায় না বলে তিনি মনে করতেন। তিনি সে সময় যে আশঙ্কা করেছিলেন বর্তমানে সেসব আশঙ্কা প্রতিফলিত হচ্ছে। বর্তমানে সেই তেল-গ্যাস রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আহরণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিশোধন ও বাজারজাতকরণ না করে বিদেশী কোম্পানীর কাছে পানির দরে বিকিয়ে দেয়া হচ্ছে।
স্বাধীনতা-উত্তর কালে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানীর কাছে যেভাবে সহজ শর্তে গ্যাস অনুসন্ধান, আহরণ, উত্তোলন ও বাজারজনকরণের জন্য লীজ দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করলে তেল-গ্যাস নিয়ে এম এন লারমা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন তা আজ বাস্তবে প্রতিফলিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে দেশে একাধিক সংখ্যক আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানে নিয়োজিত রয়েছে। এ সকল কোম্পানির সঙ্গে পেট্রোবাংলার আওতাভুক্ত এবং দেশের একমাত্র তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স-এর সাথে চুক্তি রয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে নিক্ষেপ করে এসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির মতে, গত ১৬ জুন ২০১১ জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে নিক্ষেপ করে বাংলাদেশ সরকার বঙ্গোপসাগরের দু’টো গ্যাস ব্লকের (১০ ও ১১) গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য কনোকোফিলিপস নামের একটি মার্কিন কোম্পানির সাথে চুক্তি সম্পাদন করেছে। এই চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে শুধু যে এই দু’টি ব্লকের উপর মার্কিন কোম্পানির দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাই নয় বরং এরই পথ ধরে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদের উপর মার্কিনসহ আরও অন্যান্য দেশের বিভিন্ন কোম্পানির দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করার পথ পরিষ্কার করা হয়েছে। এভাবে তেল-গ্যাস সম্পদ বিদেশী কোম্পানীর কাছে বিকিয়ে দেয়া হয়েছে এবং দেশি-বিদেশি লুটেরাদের স্বার্থে একের পর এক সরকার গ্যাস-কয়লা সম্পদ পাচারের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে বলে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি অভিযোগ করেন।
এম এন লারমা যথার্থই বলেছেন যে, “আমাদের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, সম্পূর্ণ শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্ত করে গড়ে তোলা হবে। কিন্তু এই ভিত্তি গড়ে তোলার মূলে এই পেট্রোল যেখানে প্রধান ভূমিকা নেবে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে যদি এই পেট্রোল সত্যি আমাদের দেশে পাওয়া যায়। তখন আমাদেরকে আর কোন ব্যাপারে বিদেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না। এটা সত্যি অত্যন্ত সুখের কথা। কিন্তু পেট্রোল আহরণের জন্য যে নীতি নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নীতি হয়ে যাচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এটা নয়।” সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল কিন্তু বাস্তবে তেল-গ্যাস রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আহরণ ও উত্তোলন না করে বিদেশী কোম্পানীকে দিয়ে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরিপুষ্ট করা হচ্ছে। এটা জাতীয় স্বার্থে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি আরো বলেছিলেন, “সংবিধানে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, সেই ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে ১৯১৩ সালের সেই কোম্পানি এ্যাক্ট, যে এ্যাক্ট দ্বারা সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ প্রভুরা তাদের উপনিবেশিক শাসন ও শোষণ বজায় রাখার জন্য প্রবর্তন করেছিল, সেই আইন এখানে আবার কেন প্রবর্তন করা হবে?” বস্তুত এদেশের একের পর এক সরকার উপনিবেশিক ধারণা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। উপনিবেশিক কায়দায় দেশের শাসকশ্রেণি এদেশের মানুষকে শাসন ও শোষণ করে চলেছে।
এম এন লারমার দেশের অন্যতম জাতীয় সম্পদ বিদ্যুৎ সম্পর্কে জাতীয় সংসদে আলোচনা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৩ জুলাই কর্ণফুলী উৎপাদিত বিদ্যুৎ এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন সম্পর্কে জাতীয় সংসদে তারকা চিহ্নিত প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেন, “কর্ণফুলীতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিড লাইনে সরবরাহ করা হলেও এর কোন আলাদা হিসাব রাখা হয় না।” বলাবাহুল্য, কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ দেয়ার সময় বলা হয়েছে বাঁধে উদ্বাস্তু ও ক্ষতিগ্রস্তরা বিনামূলে বিদ্যুৎ পাবেন। কিন্তু বাস্তবে কর্ণফুলীতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাঁধে উদ্বাস্তু ও ক্ষতিগ্রস্ত কেউই পায় না। কর্ণফুলীর বিদ্যুৎ সরাসরি জাতীয় গ্রেডে চলে যায়।
“কাপ্তাই ড্যামে জেনারেটর চালু রাখার জন্য সেখানে যে পানি রয়েছে, বর্ষাকালে সেই পানির লেভেল একশ’ ফুটের উপর চলে যায়, তারপর আস্তে আস্তে সেই লেভেল কমতে কমতে কোন সময় ৯০ ফুট, কোন সময় ৮৭ ফুট, কোন সময় ৮৫ ফুট হয়ে যায়” এর কারণ সম্পর্কে তৎকালীন জ্বালানী মন্ত্রীর কাছে এম এন লারমা তারকা চিহ্নিত প্রশ্ন উপস্থাপন করেছিলেন। বলাবাহুল্য, কাপ্তাই হ্রদে ডুবে যাওয়া অনেক জমি শুস্ক মৌসুমে ভেসে উঠে, যেগুলোকে জলেভাসা জমি বলা হয়। সেই জলেভাসা জমিতে স্থানীয় অধিবাসীরা প্রধানত একফলসী ধান চাষ করে থাকে। কিন্তু এটা অনেকাংশে নির্ভর করে শুস্ক মৌসুমে পানির লেভেল কমানোর উপর বা বর্ষা কালে পানির লেভেল বাড়ানোর উপর। শুস্ক মৌসুমে যথাসময়ে পানির লেভেল কমিয়ে দেয়া হলে কৃষকরা অনেক জমি চাষ করতে পারে। আবার বর্ষা মৌসুমে চাষকৃত ধান পাকা পর্যন্ত পানির লেভেল বাড়িয়ে না দিলে ঠিকভাবে কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতে পারে। তার বিপরীত হলে কৃষকদের কপালে হাত দেয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকে না। এভাবেই জলেভাসা জমির উপর কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে বসবাসকারী (যারা কাপ্তাই বাঁধে উদ্বাস্ত হয়েছিল) হাজার হাজার পরিবারের জীবনজীবিকা নির্ভর করে। অথচ কর্ণফূলী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ সে বিষয়টির প্রতি তেমন একটা সংবেদনশীলতার সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করে না।
তারকা চিহ্নিত প্রশ্ন করে যখন জেনেছিলেন যে, সে সময় “সরকার পল্লী বিদ্যুতায়নের অংশ হিসেবে ৩০০টি গ্রামে বিদ্যুৎ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছিল।” কিন্তু “সেই ৩০০টি গ্রামের একটি গ্রামও পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিল না” তখন এম এন লারমা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হচ্ছে সবচেয়ে বিদ্যুৎ বঞ্চিত এলাকা। এই বিদ্যুৎ-ব না পার্বত্যবাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করে। সরকারের এ ধরনের অপরিকল্পিত ও বৈষম্যমূলক বিদ্যুতায়ন সংবিধান পরিপন্থী বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। বলাবাহুল্য, শাসকশ্রেণির সেই বৈষম্যমূলক, পরিবেশ বিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করার একটি মহাপরিকল্পনা করেছে বর্তমান মহাজোট সরকার। কিন্তু সম্পূর্ণ বিদেশি একটি টিম দিয়ে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সহযোগিতায় এই মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎ তৈরি করছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সরকার দেশের গ্যাস বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে দেশকে যে পথে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ আরও নাজুক অবস্থায় পড়বে, জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির কারণে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে, ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাড়বে, ক্রমাগতভাবে বিদ্যুতের দামও বাড়বে বলে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আরেকটি অন্যতম সম্পদ হচ্ছে রেলওয়ে। বাংলাদেশ ছোট হলেও জনসংখ্যা বিরাট। ১৬ কোটি মানুষের পরিবহন ও মালামাল পরিবহনের জন্য সড়ক ও জলপথের পাশাপাশি রেল পথ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন খাত। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে রেলওয়ের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ আজকে সেই রেলওয়ে চলছে ধুঁকে ধুঁকে। রাষ্ট্রীয় তহবিলের অন্যতম লোকসানী খাত হিসেবে পরিণত হয়েছে। রেলওয়ের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধির পরিবর্তে দিন দিন রেল লাইন ও রেলের বগি ক্ষয় হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। টেকসই ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব, দুর্নীতি ও অনিয়মের ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ের আজকে এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই রেলওয়ে খাতকে উন্নয়নের জন্য এম এন লারমা তৎসময়ে জাতীয় সংসদে বার বার তুলে ধরেছিলেন।
১৯৭৪ সালের ১৬ জুলাই রেলওয়ের ব্যয় বরাদ্দের দাবি মঞ্জুর সম্পর্কে এম এন লারমা বলেছিলেন যে, “রেলওয়ের সব কিছুর উন্নতির মূলে হল সাধারণ ব্যবস্থাপনা। …সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উপর দেশের এই বৃহত্তম যোগাযোগ-ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভরশীল। বাংলাদেশের এত বড় যোগাযোগ-ব্যবস্থার সাফল্য যাদের মস্তিস্ক এবং দরদের উপর নির্ভর করে, বিচার করে দেখতে হবে, মাননীয় স্পিকার, স্যার, তারা কতটুকু দরদ এবং সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করেছেন। সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করে যে কার্যক্ষমতার সৃষ্টি হয়, সেই কার্যক্ষমতার ভিত্তির উপরে নির্ভর করে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সাফল্য বা ব্যর্থতা।”
এম এন লারমা আরো বলেছিলেন, “রেলের যে কোন রকম উন্নতি সাধন হয় নাই, সে কথা আমি বলছি না। রেলের কিছু কিছু উন্নতি সাধন করা হয়েছে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সেতু এবং কালভার্ট এবং অনেক রেল স্টেশন মেরামত করা হয়েছে। অনেকগুলি স্বল্পকালীন করা হয়ছে এবং অনেকগুলি স্থায়ীভাবে করা হয়েছে। কিন্তু এটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল যে, রেলের সামগ্রিক উন্নতি, রেলের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। প্রকৃতপক্ষে, রেলই দেশের যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। তাকে সফলভাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে রেল প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রশাসনের যিনি কর্তাব্যক্তি, তিনি রেলব্যবস্থাকে সুন্দর করতে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। যাত্রীদের জন্য রেল-স্টেশনে বিশ্রামাগার, ট্রেনে উঠানামার স্থান, প্লাটফর্ম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দিকে কারও দৃষ্টি নাই। আরও কত গলদ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে। আগে রেল-বাজেট আলাদা থাকাকালে রেল সম্বন্ধে বিস্তারিত বলার সুযোগ পেতাম। এখন একে তো রেলকে সাধারণ বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তার উপর আবার গিলোটিনের ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং সব কথা বলার সুযোগ হবে না।”
বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান অবস্থা দেখলে এম এন লারমা যে আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছিলেন তার বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই। বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না রেলওয়ে। গত সাত বছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও গতি বাড়েনি রেলের। সেবা না বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফা ভাড়া বেড়েছে। এরপরও বাড়ছে লোকসান। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছে ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এ সময় শুধু রেল পরিচালনার জন্য ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে পরিচালন লোকসানই হয়েছে ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। আর প্রকল্পের ব্যয় ধরলে লোকসান বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। সরকার রেলকে সেবামূলক বললেও সেবা বাড়েনি মোটেও। রেলের এই দুরবস্থার পেছনে তিনটি বড় কারণ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ (প্রথম আলো, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭)।
এম এন লারমা রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য যে ‘সহযোগিতামূলক কাজ’-এর কথা বলেছিলেন তা হচ্ছে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক কর্র্মকর্তা-কর্মচারি সম্বলিত রেলওয়ের টেকসই ব্যবস্থাপনা। অথচ তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর এম এন লারমার কোন মতামত বা তাঁর উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে বিবেচনায় নেয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গোড়া থেকে যদি সঠিক ও নির্ভুল নীতি ও পরিকল্পনা নেয়া যেতো তাহলে বাংলাদেশ রেলওয়েকে বর্তমানে এরূপ নাজুক অবস্থায় পড়তে হতো না। অন্যদিকে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-রেলওয়ের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের সঠিক ও টেকসই ব্যবহার করা সম্ভব হতো, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অধিকতর অবদান রাখতে সক্ষম হতো বলে বলা যেতে পারে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সুশাসন, সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা, আইনের শাসন ইত্যাদি। দেশের গণতান্ত্রিক শাসন না থাকলে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হলেও প্রকৃত উন্নয়ন অর্জিত হয় না বা সেই উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। মানুষের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে কোন উন্নয়ন কার্যক্রম সফল হতে পারে না। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে দিচ্ছে বলে প্রায়ই মন্ত্রী-আমলা উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। কিন্তু নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার অধিকার যদি না থাকে, সেই জনগোষ্ঠীর উপর অপারেশন উত্তরণের মতো সেনাশাসন যদি বলবৎ থাকে, তাদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম কখনোই সেই জনগোষ্ঠীর উপকারে আসবে না। বর আরো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অবস্থাও তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার স্পিরিট তথা স্বশাসনের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রবর্তিত হলেও সেসব পরিষদসমূহকে অর্থব অবস্থায় রাখা হয়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অনিয়ম ও দলীয়করণ। অপরদিকে দেশের মানবাধিকার বিষয়ক সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো হচ্ছে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকা-, সরকারি বাহিনীর নির্বিচার বা বেআইনি আটক এবং গুম, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন-নির্যাতন ইত্যাদি। নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নেই বললেই চলে। দুঃশাসনের বিষাক্ত ছোবলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা, লেখক, কবি-সাহিত্যিক, মানবাধিকার কর্মী, শ্রমিক নেতা, পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, অদৃশ্য হয়ে গেছে অন্ধকারের অতলে অথবা গোপন স্থানে বছরের পর বছর আটকিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে কিছুদিন পর কারো কারো লাশ মিলেছে খালে-বিলে-নালা-ডোবায় কিংবা রাস্তার ধারে- এমনিতর অবস্থা বিরাজ করছে বর্তমানে।
এ ধরনের বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ড, নির্বিচার বা বেআইনি আটক, গুম ইত্যাদি মৌলিক অধিকার পরিপন্থী নিপীড়নের মূল সূত্র হচ্ছে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বা ‘স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট’। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৪ সালে এ ধরনের কালো আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে এম এন লারমাসহ অনেক সংসদ সদস্য তার বিরোধিতা করেছিলেন। এম এন লারমা বলেছিলেন যে, “স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট-এর আওতাভুক্ত আসামীদের কঠোর সাজা দেওয়ার জন্য স্পেশাল ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে এবং সেই স্পেশাল ট্রাইবুনাল-এর আসামীদের দোষ প্রমাণিত হওয়ার জন্য পুলিশ কর্তৃক যে মাল-মাসলা পাওয়া যায়, সেটা আসামীর পক্ষেই হোক অথবা বাদীর পক্ষেই হোক অথবা স্পেশাল ট্রাইবুনালের পক্ষেই হোক- সেটাকে অগ্রাহ্য করে নতুন করে পুনর্বিবেচনার জন্য স্পেশাল ট্রাইবুনালকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে আজকের এই সংশোধনী আনা হয়েছে। মাননীয় স্পিকার সাহেব, এটা সেই ‘স্পেশাল পাওয়ারস এ্যাক্ট’, যেটাকে অত্যন্ত শক্ত আইন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। এটা সম্বন্ধে সরকার-পক্ষের ভাষায় ছিল যে, যারা দুর্নীতিপরায়ণ, যারা দেশের শত্রু, যারা দেশের ভিত্তিকে নষ্ট করে দিতে চাই তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য হল এই কঠোর আইন। অথচ আজকে আবার পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে সেটাকে শিথিল করে দেওয়ার জন্য যে সংশোধনী আনা হয়েছে, এটাকে একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এটা বিরোধী দলগুলোর কণ্ঠরোধ করার জন্যই শুধু আনা হয়েছে।”
বস্তত এম এন লারমা যে আশঙ্কার কথা ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন তা আজ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হচ্ছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ব্যবহার করে সারা দেশে বিরোধী মতকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে আন্দোলনরত শক্তিকে দমন করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী লীগ এই আইনটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সংসদ নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে ওয়াদা করেছিল যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করা হবে। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে তারা প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে যেতে বেশি সময় লাগেনি। তাদের দুঃশাসন বিরোধী আন্দোলন যাতে সংগঠিত হতে না পারে তার জন্য কৌশলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আইনের নজিরবিহীন অপব্যবহার শুরু করে। এক্ষেত্রে প্রথমে বিরোধী দলে নেতা-কর্মীকে গ্রেফতারের জন্য ‘নাশকতামূলক কাজে জড়িত’-কাহিনী প্রচার করে দমন অভিযানের সুচনা করে। প্রথম থেকেই সরকার রাজনৈতিক আক্রোশ মেটাবার হাতিয়ার হিসেবে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে আইনটির অপপ্রয়োগ করা আব্যাহত রাখে।
এম এন লারমা যথার্থই বলেছিলেন যে, “আমরা এটাকে ‘কালোতম আইন’ বলেছিলাম, আমাদের সেই কালোতম আইন কথাটি ঠিকই ছিল। যারা চোরাকারবারী, যারা দেশের শত্রু, তাদেরকে এইভাবে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংশোধনীটি যদিও ছোট, কিন্তু এর বাস্তব প্রতিক্রিয়া খুবই ভয়াবহ।” যাদেরকে টার্গেট করে এই কালো আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেসময় তাদেরকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে সে সময়ে যেমনি, বর্তমান সময়েও তেমনি বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে, অধিকারকামী প্রান্তিক মানুষের আন্দোলনের বিরুদ্ধে এই আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের অনাচার, অবিচার, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নসহ আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো সেনা-পুলিশের যোগসাজসে ও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক লংগদুতে জুম্মদের ২৫০টি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা এবং তাতে ঘটনায় জড়িত আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদেরকে নির্লজ্জ দায়মুক্তি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে সরকার জনসংহতি সমিতির সাথে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত করলেও পরবর্তী শেখ হাসিনা অনেকটা ইউ-টার্ন দেয়। চুক্তিতে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান থাকলেও ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে এক প্রকার সেনাশাসন পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রাখে। বিশেষ ক্ষমতা আইন থেকে অধিকতর ভয়াবহ এই ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসনের বদৌলতে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন কার্যক্রমসহ সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে জড়িত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও সহযোগী সংগঠনের সদস্য ও সমর্থকসহ অধিকারকামী জুম্ম গ্রামবাসীদের দমন-পীড়নের জন্য ‘অপারেশন উত্তরণ’কে সেনাবাহিনী-বিজিবি ব্যবহার করছে। বিশেষ করে সেনা-বিজিবি-পুলিশ কর্তৃক জনসংহতি সমিতির অফিস তল্লাশী ও ভাঙচুর, সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতার, তাদের ঘরবাড়ি তল্লাসী ও তছনছ, জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের তালিকা ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করা ইত্যাদি তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে জনসংহতি সমিতির সদস্যসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের, নিরীহ গ্রামবাসী ও জনসংহতি সমিতির সদস্য-সমর্থক ৩০ জনকে গ্রেফতার, ৫৯ জনকে সাময়িক আটক ও হয়রানি, ৮৯ জনকে মারধর এবং জনসংহতি সমিতির প্রায় দেড় শতাধিক সদস্যকে এলাকাছাড়া করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। স্বশাসনের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা, জান-মালের নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। এ ধরনের আশঙ্কার কথা এম এন লারমা বহুবার তুলে ধরেছিলেন তাঁর সংসদীয় বিতর্কে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তৎকালীন সরকার মুদ্রণালয় ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও রেজিস্টারীকরণ সংশোধনী) আইন প্রণয়নের মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার প্রক্রিয়া শুরু করে। তাই ১৯৭৪ সালের মুদ্রণালয় ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও রেজিস্টারীকরণ সংশোধনী) আইনের বিরোধিতা করে এম এন লারমা জাতীয় সংসদে প্রতিবাদ জানান। মুদ্রণালয় ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও রেজিস্টারীকরণ সংশোধনী) বিল ১৯৭৪ সম্পর্কে মতামত তুলে ধরতে গিয়ে এম এন লারমা বলেছিলেন যে, “বাংলাদেশের সংসদ গঠিত হবার পর এমনি করে গতানুগতিকভাবে তাই একটার পর একটা বিল উপস্থাপিত হচ্ছে এবং সেই বিল আইনের আকারে দেশের মানুষের উপর প্রয়োগের জন্য সংসদে গ্রহণ করা হচ্ছে। আজকেও ঠিক তদ্রুপ একইভাবে এই বিল আনা হয়েছে আমাদের সামনে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এমনি একটা ভয়াবহ আইন সংসদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন। এই আইনের ফলে, মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমাদের মুখের ভাষা খুলে বলার উপায় থাকবে না। এর ফলে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পূর্ণরূপে হরণ করা হবে। আজকে দেশের যে অর্থনৈতিক দুর্ভোগ, সেই দুর্ভোগ-এর জন্য দায়ী কে? দায়ী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। সবাই আশা রাখে যে, সরকার তার সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের মানুষকে নিশ্চয়তা দান করবে অথচ সেই নিশ্চয়তা দান না করে মানুষের কন্ঠকে, মানুষের বাক-স্বাধীনতাকে হরণ করে নিচ্ছে। একের পর এক কালা-কানুন ও গণবিরোধী আইন করে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের বাক-স্বাধীনতাকে হরণ করে, বাংলাদেশের মানুষের এগিয়ে চলার পথ সম্পূর্ণরূপে স্তব্দ করে দিয়ে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত “আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও বাক-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে”⎯এই মৌলিক অধিকারকে খর্ব করেছে।”
এম এন লারমা আরো বলেছিলেন যে, “এই স্বাধীন বাংলাকে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে গড়ে তোলার দায়িত্ব অপরিসীম। সেই দায়িত্ব পালনে সংবাদপত্রের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কারণ সংবাদপত্রে মানুষের বাক-স্বাধীনতা প্রতিফলিত হয়। এই বাক-স্বাধীনতা যদি না থাকে, তাহলে আজকে মানুষ তার মনের কথা কিভাবে জানাবে? কিভাবে জানবে সরকার কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে, কোথায় কোথায় অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে, কোথায় কোথায় গলদ দেখা দিয়েছে? সেজন্য তার বাক-স্বাধীনতা যদি না থাকে, সরকারকে এইগুলি দেখিয়ে দেবে কিভাবে? সরকারের ব্যর্থতা যদি সংবাদপত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব না হয়, তাহলে সরকার কিভাবে তার ভুল সংশোধন করবে? আজকে বাংলাদেশের দুর্নাম পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। টোকিওতে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট-এ যে কনফারেন্স হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে এমন একটা রূঢ় মন্তব্য করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। আজকে তদ্রুপ এমন একটি আইনে শুধু সংবাদপত্রের নাম করে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের অধিকারকে খর্ব করা হল। এর জবাব সরকারের নিকট চাই।”
এম এন লারমার তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেদিন সেই মুদ্রণালয় ও প্রকাশনা সংক্রান্ত কালো আইন জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছিল। সংবাদ মাধ্যমগুলোকে শৃঙ্খলা ও রেজিস্ট্রেশনের মধ্যে আনার পরিবর্তে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করার জন্যই সেসময় তৎকালীন সরকার উক্ত আইন প্রণয়ন করে। বর্তমান সরকারও তাদের পূর্বসূরীদের মতো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০১৩ প্রণয়ন করে প্রতিনিয়ত মানুষকে হয়রানি করছে। বিশেষ করে এই আইনের ৫৭ ধারা আপত্তিজনক। এই ধারার মাধ্যমে পুলিশ যে কাউকে যে কোন সময় গ্রেপ্তার করতে পারে। ঠুনকো অভিযোগ হলেও এটা করতে পারে পুলিশ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে পছন্দ না হলে এই ধারায় যে কাউকেই দমনপীড়ন চালানো যাবে। এই অর্থে আর যাই হোক চিন্তার স্বাধীনতা থাকে না। যা দেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ৫৭ ধারার কারণে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত হতে পারছে না। মানুষ অবাধে তার মতামত ব্যক্ত করতে পারছে না। তাদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। কি বলে আবার কোন বিপদে পড়বে। এসব কিছু বিবেচনায় বলা যায় তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে এই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা সাংঘর্ষিক। ইতিমধ্যে এই তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অনেক সাংবাদিক, লেখক, আইনজীবীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। এই ধারা বাতিল বা শিথিল করার জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠলে পূর্বসূরীদের মতো যেভাবে এম এন লারমার মতামতকে হেলায় উপেক্ষা করা হয়েছিল বর্তমান সরকারও সেই গণদাবি অবহেলা করে চলেছে এবং এসব কালাকানুন অপপ্রয়োগ করে চলেছে।
অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাক-স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতাকে নানাভাবে রুদ্ধ করা হচ্ছে। সেনা ক্যাম্প থেকে প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয়া হয় যে, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে টু শব্দও করা যাবে না; করলেই নির্যাতন অবধারিত। এভাবে সেনাবাহিনী কর্তৃক অবাধ নিপীড়ন-নির্যাতন ও যত্রতত্র অবৈধ গ্রেফতারের মাধ্যমে জনগণকে আতঙ্কের মধ্যে রাখা হচ্ছে এবং বাক-স্বাধীনতা ও সভা-সমিতির স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করা হচ্ছে। জুম্মদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের সংবাদ এবং আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদের আহুত জনসভা, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ, নানা কর্মসূচির সংবাদ প্রকাশের উপর সরকারি বাহিনী থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়ে থাকে। ফলে নিপীড়ন-নির্যাতন এবং আন্দোলনরত সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূূচির সংবাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় না। এ ধরনের মৌলিক স্বাধীনতা পরিপন্থী কার্যকলাপের কথা এম এন লারমার তাঁর সংসদীয় জীবনে প্রায়ই তুলে ধরেছিলেন এবং জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তার বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠস্বর ছিল বরাবরই সোচ্চার।
বস্তুত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আশা করেছিলেন, জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী শাসকশ্রেণি দেশের আপামর জনগণের শোষণ ও ব নার বেদনা বুঝবে। তারই আলোকে তিনি তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-রেলওয়ে ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রক্ষা ও সুষম ব্যবহারসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নে অনেক বিষয় জাতীয় সংসদে তুলে ধরেছিলেন। রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে আওয়াজ তুলেছিলেন গণমানুষের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার পক্ষে। মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার স্বার্থে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন শাসকশ্রেণির কালা-কানুন প্রণয়নের অপচেষ্টাকে। কিন্তু শাসকশ্রেণির তৎকালীন সাংসদ ও সংবিধান প্রণয়নকারীরা তাঁর দাবির আসল মর্মার্থ বুঝতে পারেননি এবং তাঁর ন্যায্য দাবিতে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার হীন উদ্দেশ্যে শাসকগোষ্ঠী তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, দেশদ্রোহী ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত করার অপচেষ্টা চালায়। এমনকি সংসদীয় বিতর্কের সময় শাসকমহলের তৎকালীন অনেক আইনপ্রণেতা এম এন লারমাকে হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করতেও কাপুর্ণ্য করেননি। বর্তমানে সারা দেশে জাত্যাভিমান, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দলীয়করণ ও দুর্বৃত্তায়নের হীন তৎপরতা এখন চরম আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি আসেনি। গণপরিষদে ও জাতীয় সংসদে মহান নেতা এম এন লারমার উত্থাপিত মতামত, চিন্তাধারা ও বিতর্ক বিবেচনায় নিলে দেশে বিদ্যমান বর্তমান অনেক অগণতান্ত্রিক ও উপনিবেশিক ধারা থেকে দেশবাসী রেহাই পেতো বলে বিবেচনা করা যায়।


তারিখ: ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

Back to top button