একটি বিজ্ঞাপন ও পাহাড়ের সংস্কৃতিকে ভুলভাবে উপস্থাপনের চেষ্টাঃ মোহাম্মদ জাহেদ হাসান
সম্প্রতি “টেকনো” নামের একটি মোবাইলের বিজ্ঞাপন দেখে আজকের লেখার অবতারনা। “রানিং রাফি” নামক শর্ট ফিল্ম আদলে বিজ্ঞাপনটি তৈরী করেছেন প্রয়াত জনপ্রিয় লেখক, চলচিত্র নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদের ছেলে নুহাশ আহমেদ । যদিও শুরুতে বলা হয়েছে একটি সত্য গল্প অবলম্বনে এটি তৈরী করা হয়েছে, কিন্তু এ বিজ্ঞাপনটি দেখে এ কথার কোন রকম সত্যতা পাওয়া যায়না বরং মনে হয়েছে এটি দেশের আদিবাসী-পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পরিকল্পিতভাবে আঘাত করা এবং বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার একটি প্রচেষ্টা মাত্র।
এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে আসলে কি বুঝানো হয়েছে?
বিজ্ঞাপনটিতে দেখানো হয়েছে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালীরা মাঁচার ঘরে থাকে, যেখানে রাফি নামক এক পাহাড়ী ছেলে (যদিও এ নাম কোন আদিবাসী ছেলের হয় কিনা প্রশ্ন আছে) যার ইহ জগতে কেউ নাই, সে ভোর রাতে কিংবা সন্ধায় দুইবার পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জীবন পণ বাজী রেখে ছোটে চলছে বাঙ্গালী মুসলিম কমিউনিটিতে সেহেরী আর ইফতারের সময় জানাতে ! হায় ! এ কোন পাহাড় যেখানে বাঙ্গালীরা মাচার ঘরে বসবাস করে। এখানে কোন সময়ের কথা বলা হয়েছে যখন স্যাটেলাইট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে,ফোর জি নেটওয়ার্কের পর ফাইভ জি আসি আসি করছে, এফ এম রেডিও শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে, আর ঠিক সেসময় এ বিজ্ঞাপনে দেখানো হচ্ছে পাহাড়ী বালক যে কিনা দৌড়বিদ হিসেবে মেডেল ও পেয়েছে, নিজেও নামাজ পড়ে, রোজা রাখে আবার ভাঙ্গা বাংলা ভাষায় কথা বলে । এখানে দেখানো হচ্ছে বাঙ্গালী কমিউনিটি বান্দরবানের পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করে আছে যেখানে আজানের ধবনি শুনা যায়না, যে কমিউনিটির একটি রেডিও ও নাই, কিন্তু বালক রাফির রেডিও আছে, এবং তা সে শুনে সে ছুটে গিয়ে সবাইকে ইফতারের সময় বলে দেয় ! আমরা যারা বান্দরবান একবার হলেও গিয়েছি তাদের কাছে নিশ্চয় বিষয়টা অবাক করার মতো ! এ কোন বান্দরবান?
আবার একদিন হঠাৎ করে দেখানো হয় বাঙ্গালী মুসলিম কমিউনিটির সবাই একসাথে ইফতার করছে, বয়োজ্যেষ্ঠ এক জন ব্যক্তি বালক রাফিকে দেখে বলেন “চল অনেক দৌড়াস , আজকে বয়, আমগো লগে ইফতার কর” । আবার ইফতারের সময় সে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি যাকে রাফি আগে চাচা সম্বোধন করতো, একটি মোবাইল ( বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত টেকনো মোবাইল) উপহার দিয়ে বলেন – “এখন থেকে দৌড়ানো লাগবেনা”, উপস্থিত আরেকজন বলেন- “ ফোন দিও কিন্তু, শুধু রমজানে না, সবসময়” । এ বার রাফি কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে যাকে এতাদিন চাচা সম্বোধন করতো তাকে ”থ্যাংকয়্যু আংকেল” বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
অনেকে হয়তো বলবেন এ বিজ্ঞাপন করার আগে পাহাড়ী এলাকার (এখানে বান্দরবানকে দেখানো হয়েছে), যেখানে অন্তত ১২ থেকে ১৪টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, তাদের জীবন- ঐতিহ্য -সংস্কৃতি নিয়ে যথেষ্ঠ স্টাডি করার দরকার ছিল । যেখানে জীবন জীবিকার সাথে লড়াই করে হেরে যাওয়া আদিবাসী মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় হয় ধর্মান্তরিত হচ্ছে, নয়তো দেশান্তরিত হচ্ছে, সেখানে এ ধরনের বিজ্ঞাপন পাহাড়ে বসবাসরত সকল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে আরো হুমকীর মুখে ফেলবে। ধর্মীয় আবেগকে পুজি করে করে হয়তো সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়, কিন্ত তা কোন মতেই একটি জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়না। মনোরম কাপ্তাই, মেঘের দেশ সাজেক, চিম্মুক, নীলগিরি, নীলাচল সুন্দর সুন্দর জাযগাগুলো যখন একজন পর্যর দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে যখন দেখবেন তখন হয়তো একধরনের রোমান্টিক অনুভূতি প্রকাশ পায়, কিন্তু এ পর্যটন জায়গাগুলোর ইতিহাস,স্পটগুলো গড়ে উঠার পিছনের তথ্যগুলো কিন্ত ঠিক ততটাই বেদনাদায়ক। ভুমি আগ্রসনের ঘটনায় যখন আদিবাসীরা ক্রমান্বয়ে ভিটে থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে, তখন কোন সম্প্রীতির বন্ধন দেখানোর জন্য এ বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে যেখানে উচু পাহাড়ের আদিবাসী অধুষ্যিত এলাকায় বাঙ্গালীরা বসবাস করছে ! এ বিজ্ঞাপন আদিবাসী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে চরম আঘাত করেছে। কেবল এবারই প্রথম নয়, আমরা কিছুদিন আগেও দেখেছি, রবি মোবাইল অপারেটরের একটি বিজ্ঞাপনে একজন জনপ্রিয় বাঙ্গালী অভিনেত্রীর মাধ্যমে আদিবাসী ভাষা বিকৃত ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
নুহাশ এবং তার টীম যে বিজ্ঞাপন বানিয়েছে তা পাহাড় ও পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সম্পর্কে তার অজ্ঞতারই ফসল। অবিলম্বে এ বিজ্ঞাপন বন্ধ করে নতুন বিজ্ঞাপন তৈরী করুক যেখানে বানিজ্য দৃষ্টি ভঙ্গির বাইরে গিয়ে পাহাড়ের প্রকৃত অবস্থা উঠে আসবে। আর শুধু শান্তি –সম্প্রীতির কথা মুখে বললেই হবেনা, সংশ্লিষ্ট সকলকেই তা যথাযথভাবে অনুভব করতে হবে।
………………………..
মোহাম্মদ জাহেদ হাসান, উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী