অন্যান্য

উ সুয়ে হাওলাদারঃ ৫২’র আদিবাসী ভাষা সৈনিক

সূচি মারমাঃ ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি আসলেই আমরা সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেক ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের নাম স্মরণ করি। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে বাঙ্গালীদের পাশাপাশি সক্রিয় কর্মী ছিলেন আদিবাসী ভাষা সৈনিক উ সুয়ে হাওলাদার। তিনি একজন আদিবাসী ভাষা সৈনিক এবং সক্রিয়ভাবে কৃষক আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। আদিবাসী এই ভাষা সৈনিকের জন্ম ১৯৩২ সালের ৭ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের ফেলাবুনিয়া গ্রামের এক সভ্রান্ত রাখাইন পরিবারে। দুরারোগ্য পিত্তথলির ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ করার পর ২০১৫ সালের ১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তার পিতার নাম ফ্রুলাউ হাওলাদার এবং মাতার নাম চাঁনতাফ্রু হাওলাদার।

চিরবিপ্লবী এই মানুষটির শিক্ষা জীবন শুরু হয় গ্রামের স্কুলে। তারপর চলে যান বরিশাল। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মিছিল মিটিংয়ে শরীক করতেন নিজেকে। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভাষা আন্দোলনের কর্মী এবং যোগদান করেছিলেন গণতান্ত্রিক যুবলীগে। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে এক বছর শিক্ষা জীবন ব্যাহত হয়। ফলে ১৯৫২-র পরিবর্তে তিনি ১৯৫৩ সনে ব্যাপটিস্ট মিশন স্কুল থেকে এস.এস.সি পাশ করেন। এরপরে ১৯৫৪-তে ব্রজমোহন কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ভাষা আন্দোলনের ছোঁয়ায় তার আর ক্লাসে মন বসেনি। সারাদিন রাজনীতি আর মানুষের মুক্তির সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ায় তাই আর পড়াশোনাও করা হয়নি। দেশ তখন স্বায়ত্ত্বশাসন ও ভাষার দাবিতে উত্তাল, যুবক উসুয়ে হাওলাদার নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন রাজনীতির সঙ্গে।

জীবিত অবস্থায় এক সাক্ষাৎকারে উসুয়ে হাওলাদার জানিয়েছিলেন- ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান এবং আদিবাসী সকলে একত্রিত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এ দেশ আমার। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং বহু মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। অনেক বছর অতিক্রান্ত হলো, স্বাধীন রাষ্ট্রে আদিবাসীরা এর সুফল অর্জন করতে পারেনি। তারা দীর্ঘদিন থেকে অবহেলিত, নির্যাতিত। বর্তমান মহাজোটের সরকার আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন, আদিবাসীদের প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রতি দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়েছে। তবে সমতলের আদিবাসীদের জন্য মন্ত্রণালয় হওয়া প্রয়োজন। বিগত সময়ে সরকার পটুয়াখালী জেলার দক্ষিণাঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু এতে কোন উন্নয়ন হয়নি। আদিবাসীরা চেয়েছিল জমি ক্রয় করে সমবায় সমিতিভিত্তিক পরিচালনা করতে। সে ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকা করে গরু-ছাগল ক্রয় করে আদিবাসীদের সামাজিক উন্নয়নে বরাদ্দ দিয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের বন্যায় ও জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার আদিবাসীর ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গিয়েছে। ভয়াবহ সে জলোচ্ছ্বাসে পটুয়াখালী জেলার ৮০ ভাগ আদিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। বন ও ভূমি হারিয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল। দক্ষিণ অঞ্চলের আদিবাসীদের যেটুকু জমি আছে তাও গত কয়েক বছরে হারিয়ে যাবে। সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিটি আংশিক সফল হয়েছে, অবিলম্বে শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন কামনা করছি। সর্বোপরি, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।’

কথা হলো উ সুয়ে হাওলাদারের ভাতিজি মেইনথিন প্রমীলার সাথে। যিনি একজন মানবাধিকারকর্মী এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয়  সদস্য।

তিনি জানালেন, তিনি শুধু রাখাইন নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন পুরো দক্ষিণ অঞ্চলের নেতা। মৃত্যুর সময়ও তিনি বারংবার বলে গেছেন আদিবাসীদের অধিকারের কথা।

Back to top button