জাতীয়

উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

আইপিনিউজ ডেস্ক (গাইবান্ধা):  উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা শীর্ষক এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে আদিবাসী গণমাধ্যম আইপিনিউজ বিডি। সভাটি গত ১৬ জুন ২০২৫, গাইবান্ধা জেলার সুখনগরস্থ চৌবুত্রা কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত হয়।

আইপিনিউজ বিডি’র যুগ্ম-সম্পাদক অমর শান্তি চাকমার সঞ্চালনায় ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আন্তনী রেমার সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবের সভাপতি অমিতাভ দাশ, সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিসউজ্জামান মোনা, দৈনিক সময়ের আলোর সিনিয়র সাংবাদিক কায়সার রহমান রোমেল, ফোকাস বাংলার ফটো সাংবাদিক কুদ্দুস আলম, সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে, আদিবাসী-বাঙালী সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক গোলাম রাব্বানী মুসা, গাইবান্ধা জেলা বার এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু, বেসরকারী সংস্থা অবলম্বন এর নির্বাহী পরিচালক প্রবীর চক্রবর্তী, ছিন্নমূল এর মুর্শিদুর রহমান খান, এসকেএস এর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর জেভিয়ার স্কু, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি টনি ম্যাথিউ চিরানসহ স্থানীয় বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ।

আলোচনা করছেন গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবের সভাপতি অমিতাভ দাশ

আলোচনায় অংশ নিয়ে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি অধিকার কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও গাইবান্ধায় আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে এখনো একটিও সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। উপরন্তু সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ভূমি অবৈধভাবে দখল করার জন্য বিভিন্ন পাঁয়তারা করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের ভূমি বেদখল করার জন্য প্রশাসনের সহযোগিতায় আদিবাসীদের ঘড়বাড়িতে আগুন ও তিন সাঁওতাল হত্যার মতন ঘটনা ঘটে। উক্ত ঘটনায় জড়িতদের এখনো পর্যন্ত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি। উপরন্তু নতুন করে আদিবাসীদের ভূমিতে ইপিজেড স্থাপনের পাঁয়তারা শুরু করা হয়েছে। এমনতর অবস্থায় আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশার মধ্যে দিনাতিপাত করছি। তিনি রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে বলেন, দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কি কখনো নিরাপদে, নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারবো না? তিনি উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের প্রতি সরকারকে আরও আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান এবং সমতলের আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও মন্ত্রণালয় গঠন করারও দাবি জানান।

বেসরকারী সংস্থা অবলম্বন-এর নির্বাহী পরিচালক প্রবীর চক্রবর্তী বলেন, সরকার এবং রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব হলো সংখ্যায় কম এমন জনগোষ্ঠীসমূহকে নিরপত্তা প্রদান ও সকল বৈষম্যের বিলোপ করা। অথচ উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের সাথে নানা ধরণের নিপীড়ন চলমান রয়েছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষই আদিবাসী তথা প্রান্তিক মানুষের উপর এ ধরণের নিপীড়নের ঘটনা দেখতে চায় না। অল্প কিছু সংখ্যাক খারাপ মানুষের কারণেই এ ধরণের ঘটনাগুলো সংঘটিত হচ্ছে। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে গণমাধ্যম। এ ধরণের ঘটনাগুলোকে গণমাধ্যম বস্তুনিস্তুভাবে প্রকাশ ও প্রচারের মাধ্যমে প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরতে পারে। এক্ষেত্রে আদিবাসীদেরকেও যথা সময়ে সঠিক তথ্য দিয়ে গণমাধ্যমের বন্ধুদের সহযোগিতা করতে হবে। সঠিক তথ্য প্রকাশ না পেলে এ ধরণের ঘটনাগুলোর যথাযথ বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আলোচনা করছেন এ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু

আদিবাসী-বাঙালী সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক গোলাম রাব্বানী মুসা বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটি আজকে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পরে এসেও সেই পুরনো বৈষম্যকেই অনুভব করছি। এজন্য নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরো সুসংগঠিত হওয়া উচিত। নিজেদের কথা নিজেদের বলার সক্ষমতা অর্জন করা প্রয়োজন।

সিনিয়র আইনজীবী এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, বাগদাফার্ম আন্দোলন পুরো বাংলাদেশের আদিবাসীদের আন্দোলন থেকে ভিন্ন। সবখানে আদিবাসীদের আন্দোলন হলেও এখানে আদিবাসী ও বাঙালীর যৌথ আন্দোলন পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সাঁওতাল আদিবাসীদের জায়গায় ইপিজেড স্থাপন করার যে ষড়যন্ত্র চলছে তার বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আজ পর্যন্ত সারা দেশে ৪০ বছরে সমস্থ ইপিজেডে মাত্র ৪ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে সেখানে কিভাবে এখানে ইপিজেড হলে ২ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে যে বয়ান দেওয়া হচ্ছে? এটি আসলে লোক দেখানো ভাওতাবাজী ছাড়া কিছু নয়।

গাইবান্ধার প্রেস ক্লাবের সভাপতি অমিতাভ দাশ বলেন, বাগদাফার্মের ঘটনায় স্থানীয় সাংবাদিকেরা নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। কিন্তিু নিজেদের মধ্যে আন্দোলনকারীদের নিজেদের মধ্যে নানাবিধ বিরোধ তৈরী হওয়ার কারণে এ আন্দোলনে স্থবিরতা এসেছে। তিনি বলেন, তথ্যের প্রবাহ বাড়লে আমাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করতে সুবিধা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দ্রত ও যথাযথ তথ্য না পাওয়ার কারণে গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশে সময়ক্ষেপণ হয়। কোন ঘটনা ঘটলে দ্রত গণমাধ্যমগুলোকে জানানোর জন্য তিনি স্থানীয় আদিবাসীদেরকে আহ্বান জানান। একই সাথে কোন আদিবাসী যদি সাংবাদিকতা পেশায় আসতে চায় তাহলে সাংবাদিকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেন।

আলোচনা করছেন আন্তনী রেমা

সভাপতির বক্তব্যে আইপিনিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আন্তনী রেমা বলেন, উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের উপর সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো দেশের সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাইবান্ধা জেলার গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই ধারা যেন অব্যাহত থাকে সেজন্য উপস্থিত সংবাদমাধ্যম কর্মীদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। সেই সাথে তরুণ আদিবাসী বন্ধুদেরকে তথ্য প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে মোবাইল জার্নালিজমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সবার সামনে তুলে ধরার জন্যও তিনি আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য যে, সভাপতির বক্তব্যের আগে মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন দৈনিক সময়ের আলোর সিনিয়র সাংবাদিক কায়সার রহমান রোমেল, ফোকাস বাংলার ফটো সাংবাদিক কুদ্দুস আলম, মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহনকারী লিখন রবিদাস, গৌড়চন্দ্র পাহাড়ী, বিটিশ সরেনসহ বিভিন্ন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ।

Back to top button