আমি দুঃখি মানুষের জন্য লিখি: কবি মৃত্তিকা চাকমার একান্ত সাক্ষাৎকার
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সাহিত্য জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তী কবি মৃত্তিকা চাকমা। দীর্ঘ সময় ধরে এই খ্যাতিমান সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিজ ভাষা ও বাংলা ভাষায় কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ লিখে চলেছেন। প্রকাশনার সাথেও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন ছড়াথুম পাবলিশার্সের মাধ্যমে।
কবি মৃত্তিকা চাকমা জন্মগ্রহন করেন ১২ জানুয়ারী ১৯৫৮ খ্রি: রাঙ্গামাটি জেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের মৃগাছড়িতে (বর্তমানে কাপ্তাই বাঁধের জলমগ্ন কাবত্যাদ্যেরে)। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নি:স্ব করেছে রাঙ্গামাটির হাজার হাজার মানুষকে যা থেকে বাদ পড়েনি কবির পরিবারও। এ বাঁধের ফলে রাঙ্গামাটির বন্ধুকভাঙ্গা ত্যাগ করে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি থানার লোগাং এ চলে যেতে হয় কবির পরিবারকে। কবি মৃত্তিকা চাকমার শৈশব কাটে লোগাং এর মাটি ও মানুষের সাথে। লোগাং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করে শেষ হয় চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ(স্নাতক) এম.এ(স্নাতকোত্তর) ডিগ্রী অর্জনের মাধ্যমে। কবি মৃত্তিকা চাকমা মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে ১৯৮৫ সাল থেকে এখনো শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন। স্ত্রী শৈব রানী চাকমা দুই সন্তান ড্যানিস চাকমা ও নিসা চাকমাকে নিয়ে ছোট পরিবার। পিতা যুবনাশ্ব চাকমা ও মাতা রাজলক্ষী চাকমা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন জুম ইসথেটিক কাউন্সিল জাক এর নীতি নির্ধারক ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি জাক-এর সাথে সম্পৃক্ত থেকে এবং নিজ উদ্যোগে জুমিয়া সাহিত্য সংস্কৃতির অগ্রগতি সাধনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া আদিবাসী কবিতা পরিষদ, হিল চাদিগাং থিয়েটার সহ কয়েকটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে থেকেছেন। এ পর্যন্ত ১২ টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে কবিতা ছয়টি, নাটক চারটি, প্রবন্ধ ২টি। এ ছাড়াও প্রকাশনায় অপেক্ষায় রয়েছে বেশ কয়েকটি। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-মেঘ সেওে মোনো চুক(কবিতা), মন পরানী(কবিতা), এখনো পাহাড় কাঁদে(বাংলা ভাষার কবিতা), দিকবন সেরেততুন(কবিতা), একজুর মান্নেক(ম নাটক), বান(ম নাটক) ইত্যাদি। সন্মাননা পেয়েছেন দেশে ও দেশের বাইরে। তার মধ্যে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও তোলবিচ সাহিত্য পুরস্কার(১৯৮১), জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা(২০০৩), স্বাধীনতা সংসদ সন্মাননা, ঢাকা(২০১০), আন্তর্জাতিক জলঙ্গী কবিতা উৎসব সন্মাননা, নদীয়া ভারত(২০১০) উল্লেখযোগ্য।
আইপিনিউজের পক্ষ থেকে কবি মৃত্তিকা চাকমার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইন্টু মনি তালুকদার।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ নমস্কার স্যার, কেমন আছেন ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ আপনাকেও নমস্কার, কোন রকমে আছি।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ লেখালেখির শুরুটা কিভাবে হলো এবং কি লিখছেন সেটা যদি বলতেন?
মৃত্তিকা চাকমাঃ আমার লেখালেখি শুরু হয় কাঠালতলী হাই স্কুলে থাকাকালীন কোন এক সময়। দেয়ালিকার জন্য লেখা ছোট একটি কবিতা লিখে জমা দিয়েছিলাম পরে ওটা প্রকাশ হয়েছিলো কি না জানি না। শুধু লিখেছিলাম তা মনে আছে। পরে সাপ্তাহিক বনভূমি পত্রিকা আর চট্টগ্রামের সাপ্তাহিক যুগরবি পত্রিকার মাধ্যমে লেখালেখিতে আসি। বলা যায় ওই দুটো পত্রিকাতেই আমার লেখালেখির শুরু। আমার প্রথম লেখার মাধ্যমে ছিল কবিতা। দ্বিতীয় মাধ্যম নাটক। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে যখন পড়াশুনা করি তখনই জানতে পারলাম সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যম। নাট্য সাহিত্যে আমাকে অনুপ্রেরণা যোগিয়েছিলেন জিয়া হায়দার স্যার। তিনি আমাকে খুব ¯েœহ করতেন। গল্প, প্রবন্ধ আর গানও লিখেছি। উপন্যাসে হাত দিয়ে রেখেছি, তবে ভয় হয় পৌঁছাতে পারবো কিনা! তাই সে বিষয়টা আপাতত বিরত রেখেছি।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ যদি প্রশ্ন করি, কাদের জন্য লিখেন ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ মূলত আমি দুঃখি মানুষের জন্য লিখি। নাটকে বলেন, গল্পে বলেন, কবিতায় বলেন সবখানে কিন্তু দুঃখি মানুষের জন্য আমার মন প্রাণ নিবেদিত।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ বর্তমানে আপনার সাহিত্য চর্চা কেমন চলছে ?। বয়স তো ৬০ বছর পেরুলো, এই দীর্ঘ জীবনের অনুভূতি আমাদের জানাবেন কি ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ বর্তমানে আমার সাহিত্য চর্চা খুবই মন্দভাব! পেশাগত কারনে হতে পারে, আবার বয়সের কারনেও হতে পারে। ঐ যে বললেন, ৬০ বছর তো পূর্ণ করেই ফেলেছি। স্কুলের সার্টিফিকেট থেকে আমি আসলে অনেক বড়। তবে এ দীর্ঘ জীবনে অনুভূতি কি বিষয় নিয়ে জানাবো। এখানে জড়িয়ে আছে অনেক সাহিত্যে, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক, শিক্ষাগত, পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়। এগুলো আজ বললে শেষ করা যাবেনা। কোন এক সময় না হয়ে বলা যাবে। আজ থাক।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ শুনেছি আপনি চাইলে সরকারী উচ্চপদস্থ চাকুরী করতে পারতেন। সেটা বাদ দিয়ে শিক্ষকতা এবং সাহিত্য চর্চাকে বেছে নিয়েছেন, কেনো?
মৃত্তিকা চাকমাঃ কথাটা সত্য বটে। আমার এক মামা দেব সিংহ চাকমা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ভাগ্নে লেখাপড়া শেষ করে কি করবে? আমার উত্তর শিক্ষকতা। মামা শুনে খুশি হয়েছিলেন। আমাকে আশির্বাদ করেছিলেন, তুমি যেন একজন ভাল শিক্ষক হও। জানিনা আমি হতে পেরেছি কিনা। তবে শিক্ষক হয়েছি একটি এতিমখানা শিক্ষক হিসেবে। হয়তো ঐ সরকারী চাকরীতে যোগদান করলে ঢাকা-চট্টগ্রাম কথা বাদ, অন্তত রাঙ্গামাটিতে একটি ছোট খাটো বিল্ডিং এর মালিক হতে পারতাম। এখন যেমন ভাঙ্গা ঘরে জীবন যাপন বর্ষা আসলে পানি নিষ্কাশনের জন্য বেলচা, গামলা, ফাটাছেড়া কাপড় নিয়ে পানি নিষ্কাশন করতে হয়। আর চিন্তা করলাম সাহিত্যে পড়াশুনা করে শুধু শিক্ষকতা নিয়ে জীবনটা শেষ করে দিলে সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করায় অনর্থক। ভাবলাম জাতিকে কিছু দেওয়ার সুযোগ তো রয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যটাও চালিয়ে যাওয়ার দরকার। কারণ আমার এ জুম্ম জাতির যে সাহিত্যে, সংস্কৃতি বিশাল ভান্ডার ছড়িয়ে ছিঠিয়ে রয়েছে এগুলো তো উদ্ধার করতে হবে। একজনের না হয় একজনের রাস্তা তো দেখিয়ে যেতে হবে। মূলত এ ভাবনা থেকে আমার সাহিত্যে চর্চা বেঁচে নেওয়া।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন কখন থেকে শুরু হয়? বর্তমান বাস্তবতায় ভবিষ্যৎ করনীয় কি হতে পারে বলে মনে করেন?
মৃত্তিকা চাকমাঃ এখানে সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে শুরুর কথা বললে কৃতিত্বের দাবীদার নিশ্চয় গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী, এদের কথা বলতে হবে। আর সাহিত্যের কথা বলতে গেলে “জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর” এর কথায় বলতে হবে। মূলত: এ দুটি সংগঠনই সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলন প্রথম শুরু করেছে বলতে হবে। এরপর প্রতিষ্ঠিত হয় জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক)। বনযোগিছড়া কিশোর কিশোরী কল্যাণ সমিতি, পুলক সাহিত্যে সমিতি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম আর আদিবাসী লেখক ফোরাম এ ছাড়াও আরো ছোটখাটো কিছু সংগঠন এগিয়ে আসছে এই কাজে। আমার দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ করনীয় হল এসব চর্চার ক্ষেত্রে প্রচার করতে হবে। দেশ বিদেশের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। তাদের আনতে হবে, প্রয়োজনে আমাদের ও যেতে হবে। এভাবে আদান প্রদানের মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার গুলোরও একটা বাৎসারিক কাজের মধ্যেই এগুলো রাখা দরকার।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র এবং নাটক চর্চা সর্ম্পকে আপনার অভিমত কি ? আদিবাসী চিত্র শিল্পীদের কাজ কিভাবে দেখেন?
মৃত্তিকা চাকমাঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র চর্চা হল দেখে শুনে যা নিজে ধারনা হয়েছে বা অর্জন হয়েছে সেগুলো পরিচালক বা নির্দেশক কাজে লাগিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী করে। ঐ শিল্পটাকে অর্জন করতে গেলে কর্মশালার মাধ্যমে অর্জন করতে হবে। কারণ এটি একটি শিল্প। সুতরাং শিল্প সম্মত হতে হবে। শুধু হাত পা নাড়লাম, কিছু ভাড়ামি দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে মানুষ হাসালাম, এটি শিল্প নয়। আমাদের এখানে নাট্যকাররা যা নির্মাণ করছে এটি সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব। শৈল্পিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে নয়। চিত্র শিল্প কিছুটা উন্নত হয়েছে। তবে যারা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিত্র শিল্পে জড়িত তাদের একটু নান্দনিকতার অভাব। তারা আলো-আঁধার, কাছে ও দুরে ব্যবধান সহজে বুঝতে পারে না। এ রকম অনেক ছবি দেখা যায়। একটা সাঁকোরদৃশ্য এই দৃশ্যের মধ্যে সাঁেকার সিড়িটা মানে পাদানিটা উল্টো করে ছবিতে বসানো হয়, সুতরাং এটি অবাস্তব। আবার যারা প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাতে চিত্র কলাকে অর্জন করেছে তাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। এ অভাব হওয়ার কারণে আমাদের চিত্রশিল্প এগিয়ে যেতে পারছে না। আমার দৃষ্টিটা অনেকটা সে রকম।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ আপনি বিভিন্ন সময় নানান ধরণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে। কবি সাহিত্যিক হিসেবে আপনার দৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের এই সমাজের একটা সার্বিক চিত্র তুলে ধরবেন কি ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ এখানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে খুব ছোট করে দেখা হয়। এক সময় আমাদেরকে পাগল বলা হতো। বাপের পয়সায় দিয়ে নাটক করি, কবিতা লেখি, বই প্রকাশ করি, লেখা পড়া করি না। কিন্তু কবি সাহিত্যিক ছাড়া তো একটা দেশ চলতে পারে না। নেপালে গিয়েছিলাম একটা কবিতা অনুষ্ঠানে ওখানে দেখি শুধু কবিতা শুনার জন্য মানুষ পাগল। খোলা মে অসংখ্য দর্শক অপেক্ষায় আছে কবিতা শুনার জন্য। আমাদের এখানে বনরূপা পেট্রোল পাম্পে বা অন্য কোন খানে কবিতা পাঠের আয়োজন করে দেখিতো দর্শক স্রোতা পাই কি না? পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া গেলাম সেখানে দেখি কবিদের ভিড় কবিতা পড়ার জন্য। রাস্তায় দেখি কবিতা পাঠ শুনছে। আবার দেশের মধ্যে ঢাকায় বই মেলায় বা বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠান দেখি। কবিতা আবৃত্তি শুনার জন্য চেয়ার ভর্তি দর্শক বসে রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে বিপরীত। সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করলে যার পালা শেষ সে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান মাঠ ফাঁকা বা অনুষ্ঠান ছাটাই করে শেষ করতে হয়। এই হলো আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সার্বিক চিত্র।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ যে কোন জাতির উন্নতি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ সমানভাবে এগিয়ে যেতে হয়। আদিবাসী নারীদের সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অংশ অথবা অবদান কতটুকু ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী। তবে ফেইসবুক কেন্দ্রীক হলে উন্নতি হবে না। সমালোচনা করা যাবে না। যদি সমালোচনা করা হয় তাহলে যে সমালোচিত হচ্ছে সে মনে ক্ষুন্ন অথবা সে গ্রহণ করতে পারছে না। তার মানে তারটা সঠিক। তোমার টা বেঠিক। যেমন একজন কথা কে কথা লিখলো, আবার আরেকজন কথাকে হদা লিখলো তারপর বাংলা হয় শব্দটি চাকমা লিখলো অর্য়/অহ্য় । আবার অন্য জন লিখলো হয়। এই নিয়ে টানাটানি/সমালোচনাতে সাহিত্য আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে না। অন্যদিকে মেয়েদেরকে যদি উৎসাহ দেওয়া হয় পিনন খাদি পরিধান করতে তখন মেয়েদের পক্ষ থেকে পাল্টা জবাব আসবে ছেলেরা কেন তেন্যাকানি পড়ে না। তারা কেন প্যান্ট-শার্ট পড়ে? সবটাই মিলে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হলে নারী পুরুষের উভয়ের সমন্বয় দরকার। শুধু সাহিত্য ক্ষেত্রে ছেলেরা আর নারীদের ক্ষেত্রে মেয়েরা হলো আমাদের উন্নতি হবে না। ছেলেদের ও নাচ গানে এগিয়ে যেতে হবে আর নারীদের ও সাহিত্য ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হবে।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ আদিবাসীদের নিজস্ব মাতৃভাষা চর্চার জন্য সরকার বাংলাদেশের পাঁচটি ভাষায় চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরা ও সমতলের দুইটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা পাঠ্য পুস্তুক প্রণয়ন করে পাঠদান চালু করেছেন। এই বিষয়ে একটু বলবেন কি?
মৃত্তিকা চাকমাঃ এ বিষয়ে আমার মূল্যায়ন হল স্থানীয় সরকারের জোড়ালো ভূমিকা থাকা দরকার। শুধু ফাইল ভর্তি কাগজ রেখে কাজ হচ্ছে মনে করলে ভুল হবে, যথাযথ মনিটরিং করতে হবে। যারা পুস্তুক প্রণয়ন করতেছে তাদের উচিৎ স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের সাথে বিষয় গুলি নিয়ে আলাপ বা কর্মশালা আয়োজন করা। এখানে পান্ডিত্য প্রদর্শনের কোন প্রয়োজন নেই। কারন এটি একটি ভাষা শিক্ষা, এবং শিশুতোষ এবং সামগ্রিক অর্থে তার জাতিসত্ত্বার সম্পত্তি। এটাকে হেয় করে দেখা কোন ভাবে কাম্য নয়। সরকার টাকা খরচ করছে এ টাকা যেন যথাযথভাবে খরচ হয় জাতির যেন উন্নতি হয়, দেশের যেন উন্নতি হয়, সে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ সাহিত্য ও সংস্কৃতি জায়গা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতীয়বাদী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের সকল আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সম্পর্কে আপনার বক্তব্য?
মৃত্তিকা চাকমাঃ উভয় ক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কারণ সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়টি একটা জাতি না বুঝলে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন না করলে সেই জাতি অতলেই থেকে যাবে। যেমন চীনারা আন্দোলন করেছেন সংস্কৃতিকে সাথে নিয়ে তেমনি রুশরাও।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ এবং সংস্কৃতি উন্নয়নে ক্ষেত্রে কারা বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মৃত্তিকা চাকমাঃ এটাতো যার যার অধিকার তারাই সংরক্ষণ করবে। অন্য কেহ সংরক্ষণ করে দেবে না। জাতিসংঘের সদস্যভূক্ত রাষ্ট্র অনেক আছে কিন্তু তারা কি জাতিসংঘের নীতি অনুসরণ করছে ? না, তারা করছে না। আর সদস্যভূক্ত রাষ্ট্রও সেগুলি তদারকি করতে পারছেনা। ফলে সেই দেশের সরকার মূখ্য ভূমিকা পালন না করে উল্টো পথে হাটে। তাই আমার মন্তব্য হচ্ছে অধিকার বলি সংস্কৃতি বলি নিজেদের থেকে আদায় করে নিতে হবে।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ বাংলাদেশ একটা বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি, বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণ বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ কিন্তু দেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ কি সমানধিকার ভোগ করে? আপনি একজন সচেতন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে বর্তমান দেশের এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বিক অবস্থা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মৃত্তিকা চাকমাঃ আমরা হলাম শিয়াল আর কুমীরের গল্পের উপমা। যেমন কুমীর দিয়েছিল তার ছেলেদেরকে শিক্ষিত করার জন্য শিয়ালের পাঠশালায়। সেখানে কুমীর মাঝে মধ্যে ছেলেদের দেখতে যায় এবং শিয়াল ও তার ছেলেদেরকে এক এক করে কুমীরকে দেখায় এই যে তোমার ছেলে খুব সুখে আছে সুন্দর করে আছে লেখা পড়া শিক্ষায় সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠছে। শিয়াল মহা খুশি হয়ে বাড়িতে ফিরে যায়। তেমনি ভাবে দেশ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কোন ইভেন্ট হলে আগে প্রদর্শন হবে আদিবাসীদের বিশাল নৃত্য কারো মাথায় মুরগীর পালক উলংঙ্গ দেহ মুখে নানা দোরা কাটা স্পট বা রেখাচিত্র। মেয়েদের দেখা যাবে অঙ্গ ভরণ গয়না। দর্শকরা করতালি দেবে, তারা বলবে আমার আদিবাসীরা সুখেই আছে। অপর দিকে সাহিত্য সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বা অন্যান্য ক্ষেত্রে মূল্যায়নের কথা মনেই থাকেনা, থাকলেও সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। তাই এ ক্ষেত্রে মূল্যায়নও বা কি করবো।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ ৭০ দশকে জুমিয়া জাগরনের আন্দোলন এবং ১৯৯৭ সালের সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বর্তমান বাস্তবতা এই চলমান প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ ঐ সময়ের আন্দোলন রক্তের টান জাতির টান ছিল মনে হয়। চুক্তির মধ্যে দিয়ে সবাই আশা করেছিল জুম্মজাতির সুদিন ফিরে আসবে। কিন্তু অদৃশ্য হাতের কালো ছায়া কোথায় থেকে নেমে এলো কেউ টেরই পেলনা। একুশটি বছর অপেক্ষা করলাম। সুদিনের জন্য। কিন্তু সুদিনতো না, ধেয়ে আসছে কালো দিন। এই কালোটাই আমাকে গ্রাস করে ফেলছে সবখানে।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ জাতির এই সংকটময় মুহুর্তে বুদ্ধিজীবিদের তো এগিয়ে আসতে হয়, আপনি কি মনে করেন?
মৃত্তিকা চাকমাঃ বুদ্ধিজীবিরা কার ডাকে এগিয়ে আসবে। আবার বুদ্ধিজীবিরা যদি নিজেদের তাগিদে ডাকা ডাকি করে জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কথা বলে তখন বসতে না বসতে শুরু হবে নানা প্রতিক্রীয়া। ফলে ওখানেই তখন অংকুরে বিনষ্ট। তবে আমি মনে করি আর নয়, চলুন না এগিয়ে যায়।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ ১৯৬০ সালে নির্মিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মরনফাঁদ বলে খ্যাত কাঁপ্তাই বাঁধ এই বিষয়ে আপনার কোন লেখা আছে কি ? এই বিষয়ে আপনার মতামত।
মৃত্তিকা চাকমাঃ কাপ্তাই বাঁধ নিয়ে প্রথমে কবিতা লিখি। কবিতাটি লিখে লিটল ম্যাগে ছাপা হয় এবং পরে কবিতা গ্রন্থে সংযোজন করি। এটা করে আমার মনের তৃপ্তি হয় নি মানে পাঠকের পাশে পৌছাতে পারিনি বলে আমার মনে হলো। কারণ কবিতা কয়জন পড়ে আর কয়জনেই বা আত্তস্থ করে। ভাবলাম নাটক লিখবো প্রথমে ছোট এক অংশের একটি নাটিকা লিখলাম। পরে দেখছি এটাকে ম নাটকে নিয়ে আসলে বোধ হয় ভালো হবে। তাই সে নাটিকাটিকে ম নাটকে রূপদান করলাম। সেটির নাম দিলাম “বান”। নাটকটি ম ায়ন করে রংধং থিয়েটার। যারা দেখেছে নাকটটি তারা প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছে এবং নাটকটি ঢাকাসহ রাঙ্গামাটি বহুবার ম ায়ন হয়েছে। মতামত আর কি বলবো পানি, পাহাড়, রাঙ্গামাটি শরীর আমার চোখে সুন্দর বা কোমলীয় নয়। আমার চোখে লক্ষ মানুষের জমাবদ্ধ চোখের জল।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ মুক্তিযুদ্ধ কালে আপনার বয়স কত ছিল? কিভাবে দেখেন মুক্তিযুদ্ধকে? বঙ্গবন্ধু এবং এম এন লারমাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ মুক্তি যুদ্ধকালে আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ছিলাম। আমার সেই সময়ের কার্যাবলীর মধ্য আমি যা বুঝি, আমার দৃষ্টি খুবই ইতিবাচক ছিল। তারিখ এবং মাসটা মনে নেই, আমরা লোগাং বাজারে পুলিশ ক্যাম্পের পাকিস্তানির পতাকাটি নামানোর জন্য শ্লোগান দিয়ে গেছিলাম একেবারে পুজগাং হাই স্কুল থেকে পায়ে হেটে। তখন ক্যাম্পে একজন বাঙ্গালী হাবিলদার ছিলেন। তার নামটা এখনো মনে আছে, নাম ছিল একলাস মিঞা। উনি আমাকে খুব দেখতে পারতেন কারণ লোগাং সরকারী প্রাইমারি স্কুল থেকে আমি পুজগাং হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ছিলাম। সে ক্ষেত্রে তার সাথে আমার একটা সখ্যতা ছিল। কিন্তু পতাকাটি যখন শ্লোগানে আর দেন দরবারের সহিত নামাতে চেয়েছিলাম ঐ হাবিলদারের সাথে সখ্যতা কোন কাজ করেনি। উনি একটি মাত্র অনুরোধ করেছিলেন তাকে চাকুরী বাঁচাতে হবে। সুতরাং তিনি পাকিস্তানের পতাকা নামাতে পারবেন না। আবার তাই বলে আমাদের দাবী তিনি সমর্থন করছেননা তা না, শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো আমাদের জয় বাংলা পতাকাটি উপরে থাকবে। যখন মানামানি হলো তখন আমাদের যে আনন্দ। আর পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে আমরা জয়বাংলা পতাকাটি উপরে বেঁধে দিলাম। আর পাকিস্তানের পতাকাটি নিচে বেঁধে দিয়ে আমরা শ্লোগানের সহিত স্থান ত্যাগ করলাম। এ ছাড়া স্কুলের মাঠে এবং রাস্তায় কতবার শ্লোগান দিয়ে ছিলাম আমার এখনো মনে পড়ে। সেই সব স্মৃতিগুলো। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ ৯ মাস পর ভারত থেকে মুক্তি বাহিনী যখন ফেনী হয়ে পানছড়ি বাজারে প্রবেশ করলো (সে দিন বুধবার) তখন একচেটিয়ে চাকমাদের ধর মার গুলি কর। তারিখটি মনে নেই। যারা সেখানে বয়স্কজন এখনো আছে তাদের মধ্যে ঘটনার কথা মনে থাকবে। তবে দূর সম্পর্কের আমার মামা একজন ঐ ঘটনায় মারা যান। সেই থেকে আমার মনে বড় আঘাত লাগলো এবং নিজের কাছে প্রশ্ন জাগলো, কেন? কী দোষ? তাহলে লোগাং ক্যাম্পে পাকিস্তানের পতাকাটি নামিয়ে অপরাধ হল? আমাদের লোগাং এলাকা দিয়ে শরনার্থীদেরকে পারাপারে সহযোগিতা করাটা অপরাধ ছিল ? সেই থেকে প্রশ্ন থেকে গেল। বঙ্গবন্ধু আর এমএন লারমাকে মূল্যায়ন করা আমার এতটুকু দৃষ্টাতা নেই। বঙ্গবন্ধুর জন্য শ্লোগান দিয়েছি “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো”। আমার কাছে এ একটি খুবই পবিত্র বাক্য বা শ্লোগান। আর এমএন লারমাকে জীবনে কখনো দেখিনি। তবে সে সময় তার নির্বাচনী প্রচারনা সম্পর্কে জানতাম। জানতাম তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য লড়তেন। তবে কী অধিকার তখন এতটুকু বুঝার বয়স ছিল না। পরে বয়সের — জানলাম তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতো তার পার্বত্য অ লের নিপিড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য বঙ্গবুন্ধ যেমন আমাদের একজন মহান নেতা, ঠিক তেমনি এমএন লারমাও আমাদের একজন।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ আপনার ফেলে আসা ছোট বেলার স্মৃতি মনে আছে কি ? শৈশব যৌবন কৈশোবের কথা বলবেন কি ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ তাতো আছে ছোট বেলার তিনটি স্মৃতির কথা বলতে চোঁখের জল আসে। যেমন একটি একদিন শৈশব কাল চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। বাবার সাথে একটি পানছড়ি বাজারে বুদ্ধ মেলায় গিয়েছিলাম। সেই ১৯৬৯ খ্রি. বাবার সাথে অনেক ঘুরছিলাম। এক সময় বাবাকে বললাম আমি এক জোড়া কাপড়ের জুতা নিবো। বাবা বললো কি করবে ? আমি চিন্তা করলাম মানুষের পায়ে দেখি কি সুন্দর মানায় আমি ও পায়ে দেবো। বাবা বললেন থাক দরকার নেই। আমার প্রতিবাদের ভাষা নেই বাবা রাজি না হওয়ায়। এক সময় হঠাৎ আমার মনে শয়তানি মনোভাব এলো বাবা যখন আমার ইচ্ছাটা পূরণ করে দিচ্ছে না সেই বদলে বাবাকে একটু শাস্তি দিই। বাবা এটা ওটা দেখছে এ ফাঁকে আমি আড়াল হয়ে দেখলাম। তবে আমিও যেন বাবা থেকে হারিয়ে না যাই সদা সর্বদা সতর্ক রইলাম। এরই মধ্যে বাবা আমাকে না দেখে অস্থির হয়ে গেলেন। আমি দূর থেকে মানে মানুষের ভিড়ের মধ্যে থেকে দেখছি বাবা আমাকে খুঁজতেছে, অনেকক্ষন কষ্ট দিলাম। পরে বাবাকে দেখে কষ্ট লাগলো। মনে মনে বললাম বাবা যেন মনে না করে জুতা না কিনে দেওয়ার কারণে আমি রাগ করে অন্য কোথাও হারিয়ে গেছি। সেটা চিন্তা করে বাবার কাছে আস্তে করে গেলাম। তখন বাবা বললেন জুতা কিনবে ? আমি মাথা নেড়ে বললাম হ্যাঁ। বাবা আমার কাপড়ের জুতা কিনে দিলেন। সেই জুতা জোড়াটি অনেক বছর যতœ করেছি। নোংড়া হলে পায়ের গন্ধ হলে পরিস্কার করে রঙ করে রৌদ্রে শুকায়, যখন শুকিয়ে উধবে কি উজ্জ্বল সাদা ধবদবে হয়ে উঠে। স্কুলের যাওয়ার সময় জুতা যেন নষ্ট না হয় সাবধানে হাজার চেষ্টা করতাম। প্রয়োজনে পা থেকে বের করে ঝলাতে করে নিতাম। বাবা দিবস আসলে সেই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। ইচ্ছে করে বাবাকে যে কষ্ট বা মনের দুঃখ দিয়েছি সেটি ক্ষমা চেয়ে নিতে। কারণ আজ বুঝতে পেরেছি বাবা একজন যে চাষী আর আমি এখন একজন শিক্ষক। এই সুযোগে বলবো বাবা তুমি যেখানে থাকো আমাকে ক্ষমা করে দিও।
তার পর আরো শৈশবকালে একটি কাজ সেটি হচ্ছে কাপ্তাই বাঁধের পর আমরা যখন লোগাং সেটেলার হলাম আমি তখনও খুব ছোট মোটামুটি মানুষের ভাষা বা মুভমেন্ট বুঝতে শিখেছি। বাবা বাজার দিনে আমাকে নিয়ে বাজারে যাওয়ার সময় বলে, তোকে এই স্কুলে ভর্তি করে দেবো, তুই স্কুলে আসবি। আমি কিছুই বলতাম না। কারণ সেই আগে আমাদের গ্রাম থেকে আসা ছেলেদের থেকে শুনেছি বাঙাল মাষ্টার খুব রাগী। পড়া না পাড়লে মারে। আমি তাদের কথা শুনে মনে মনে বলি ওরে বাবা স্কুলে না যাওয়াই ভালো। একদিন বাবা সব ঠিক করে আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সঙ্গে থাকবে আমার জেঠা মহাশয়ের বড় ছেলে শান্তি রঞ্জন চাকমা সে অল্প আয়ুতে মারা যায়। আর আমার জ্ঞাতি রক্ত সর্ম্পকিত ভাইপুত হয় জগদীশ চাকমা। সে এখন ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী নিয়ে গ্রামে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে। অভাবের কারণে লেখা পড়া এগোতে পারেনি। এখন দিনে এনে দিনে খায়। আর আমি মাঝে মধ্যে ওদের প্রচন্ড মিস করি।
আরেকটা হল যৌবন কালে আমার প্রেমিকা ছিল না। বন্ধুদের মস্কারি করে বলে দিলাম আমি প্রেম চাই, প্রেম। একদিন সুহৃদ, চিরজ্যোতি গেলো একটি মেয়ের কাছে ওকে আমার জন্য বৌ ঠিক করবে। সেটা আবশ্যই সবই শিশির বাবুর কেরামতি। সুহৃদ বাবু সেখানে গিয়ে মেয়েটিকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে, অয়নি তুই মৃত্তিকারে কোচ পাচ্ছ্যে আর কি ? সেই থেকে অদ্যাবধি।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ আপনি তো জাক ও মনোঘর সাথে সম্পৃত এর শুরুর দিন গুলোর কিভাবে হলো বিস্তারিত জানাবেন কি ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ জাক আমার মনের সংগঠন এবং জন্ম দেওয়া সংগঠন। আর মোনঘর এটি একটি জুম্ম জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় রমজান বা ঈদের ছুটিতে আমাদের বলা হতো বাড়িতে না গিয়ে মোনঘরে কিছু সহযোগিতার হাত প্রসার করার জন্য। এমনি পাহাড়ে পরিস্থিতি ভালো নয়। সব দিক বিবেচনা করে কিছু সংগী সাথি নিয়ে একমাসের জন্য সময় দিয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতাম। এভাবেই হয়তো মোনঘরে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠা।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ আপনি তো বিভিন্ন প্রকাশনার সাথেও সর্ম্পৃক্ত এবং কাজ করেছেন। এই পর্যন্ত কয়টি প্রকাশনা সম্পাদন করেছেন এবং কোন কোন সংগঠনের সাথে জড়িত ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ বিভিন্ন প্রকাশনার সাথে সর্ম্পৃক্ত বললে ভুল হবে যারা লেখা চায় তাদেরকে যত সম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করি। অন্য লেখকরাও আমার কাছে তাদের লেখাগুলো পাঠায় এবং সেগুলো বিভিন্ন প্রকাশনাকে ভাগ করে দেওয়ার চেষ্টা করি। প্রকাশের পর সংকলন -গুলো তারা আমাকে দেয়। অথবা আমি খুঁজে নিয়ে সে গুলো তাদেরকে কুরিয়ার যোগে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। যথাসময়ে তারা পেলো কিনা। যতক্ষণ পায়নি ততক্ষণ মনটা অসুস্থিতে থাকে। আবার পাওয়ার পর লেখকরা যখন বলে ভুল হয়েছে শব্দ বদল করেদেওয়া হয়েছে। যতœ করে ছাপার কাজ করা হয়নি তখন মনটা খারাপ হয়। কারণ এগুলো প্রকাশক বা সম্পাদকরা শুনে না শুনি আমি। অনেক সময় মনে মনে বলি নিজের ভাত খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কি দরকার। কিন্তু পারি না আমার চিন্তা হলো আমার মাধ্যমে অন্য একজন লেখার উৎসাহ পেলে মন্দ কি। তাই ভেবে কাজটি করি। সম্ভবত আগামীতে এ কাজে জড়িয়ে না যাওয়াটাই ভালো হবে। প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জুন্ম ছাত্র-ছাত্রীদের একটি সাহিত্যে সংগঠন করি। হিল্লো লিটোরেচার গ্রুপ, ঐ সংগঠনের প্রথম সংখ্যা সম্পাদনার কাজটি আমার করতে হয়েছে। সালটি ছিল ১৯৮১ খ্রি. বই এর নাম “বিজু ফুল”। দ্বিতীয় বার প্রকাশনার সাথে জড়িত ছিলাম “জাক” তৃতীয় বার ছিলাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী ফোরাম এর বেশ কয়েকটি সংকলনে। এছাড়া সরাসরি নয় সে রকম কয়েকটি সংগঠনের সাথে ও জড়িত ছিলাম। আমার হিসাব মতে এ পর্যন্ত ১৬টি প্রকাশনার সাথে জড়িত ছিলাম।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ আপনার ছড়াথুম প্রকাশনা সংস্থা বর্তমান কি অবস্থা আছে ?
মৃত্তিকা চাকমাঃ আমার ছড়াথুম এটি আমার একটি খেলা ঘর। ব্যবসায়িক নয়। ব্যবসায়িক ভাবে চিন্তা করলে ভুল হবে। আমার ওখানে একটি জেদও রয়েছে। সেটা হল, আমি লিখে যাচ্ছি, বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কিছু সাময়িকিতে। লেখাগুলি একদিন হারিয়ে যাবে। সময় থাকতে গুচ্ছিত অবস্থায় রেখে দিলে খারাপ তো হবে না। তবে সাহিত্যের বিচার পাওয়া আমার আশা নয়। খেলার মনে লিখছি এবং খেলার ছলে প্রকাশ করে যাচ্ছি, এই যা।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ শিশু কিশোরদের ঘিরে আপনার স্বপ্ন কি ? তরুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
মৃত্তিকা চাকমাঃ শিশু কিশোরদের বিষয়ে আমার স্বপ্ন শিশুতোষ জাতীয় একটি ছড়া বই লেখা, ওখানে প্রতিটি ছড়ায় ছবি থাকবে। সে জন্য আমি কোন লিটল ম্যাগের সম্পাদনার কাজে জড়িত হলে আগে তাদের অংশগ্রহণ মূলক চিন্তাটা প্রাধান্য দিয়ে থাকি। তারা লিখবে, লিখতে লিখতে একদিন তাদের হাত পাকা হয়ে উঠবে। আমি এটা আশা করবো।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ আপনি দীর্ঘ সময় ধরে সাহিত্য চর্চা করেছেন আপনার এমন কোন স্বপ্ন আছে কি ? যা বাস্তবায়নের অপেক্ষা আছে।
মৃত্তিকা চাকমাঃ সে ক্ষেত্রে আমার স্বপ্ন আমি এ পর্যন্ত যতগুলো লেখা লিখেছি সব গুলো মিলে একটা রচনা সমগ্র করার। কিন্তু স্বপ্নটাই মনে হয় সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে, যেখান থেকে এসেছি সেখানে। কারণ অমার শিক্ষকতা বয়স এখন শেষ প্রান্তে। এ দীর্ঘ বয়সের মধ্যে করতে পারিনি, অবসরে গিয়ে কি করবো? যা জ্ঞান দান করলাম এইটুকু প্রশান্তি।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ আপনাকে ধন্যবাদ।
মৃত্তিকা চাকমাঃ আপনাকে ও আইপিনিউজকে ধন্যবাদ।