জাতীয়

আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

সতেজ চাকমা: ৯ আগষ্ট ২০১৯ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের আদিবাসীদের ছাত্র সমাজের সম্মিলিত ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ছাত্র সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার মামুনুর রশীদ।এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিণ সহ জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।উক্ত অনুষ্ঠানে উদ্ধোধক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞানের শিক্ষক বিশিষ্ট আদিবাসী ভাষা গবেষক অধ্যাপক ড. সৌরভ শিকদার।
সংগঠনটির সভাপতি ছাত্রনেতা সুলভ চাকমার সভাপতিত্বে এবং সাধারন সম্পাদক অলীক মৃ’র সঞ্চালনায় উদ্ধোধনী বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৌরভ শিকদার বলেন, বিশ্বব্যাপী আদিবাসীরা দিন দিন তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি হারাচ্ছে। বাংলাদেশে যদিও পাঁচটি আদিবাসী জাতিসত্ত্বার মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু যারা শিক্ষা দেবে তাদেরকে এখনো প্রশিক্ষিত করতে পারেনি। তারা তাদেরকে আদিবাসী বলতে চাই কিন্তু রাষ্ট্র তাদেরকে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বলে আরো ক্ষুদ্র করে উদ্ভাসিত করছে।

মাতৃভাষা শিখে যদি কেউ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন এবং অর্থনৈতিক বাজারমুল্য তৈরী করা যায় তাহলেই আদিবাসীরা আরো বেশী নিজস্ব ভাষা চর্চা করতে মনোযোগী হবে। তাই আদিবাসীদের ভাষা চর্চাকে রক্ষার জন্য অর্থনৈতিক মূল্য তৈরী করতে হবে। এজন্য যেসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়েছে সেইসব স্কুলে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করার দাবী জানান বিশিষ্ট এই আদিবাসী ভাষা গবেষক।
তিনি আরো বলেন, ভাষা রক্ষা করতে হয় মানুষের মুখে মুখে, জাদুঘরে নয়। চর্চার মধ্য দিয়ে ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে বলে মত দিয়ে আদিবাসী মানুষদের নিজেদের স্ব স্ব মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাঙালিরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল সেই রাষ্ট্রে অন্য ভাষা-ভাষী মানুষ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে তা হতে পারেনা বলেও মত দেন ভাষা বিজ্ঞানী।

স্বাগত বক্তব্যে আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, আমাদের চর্চার অভাবে এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। এসডিজির চার নম্বর লক্ষ্যমাত্রা মানসম্মত শিক্ষা। আদিবাসীদের জন্য এই মানসম্মত শিক্ষা হতে হবে নিজস্ব মাতৃভাষায়। বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে সেখানে আদিবাসীদেরকে সম্পৃক্ত করতে হবে বলে দাবী করেন এই আদিবাসী ছাত্র নেতা।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিণ বলেন, আদিবাসী বিষয়ে আমাকে প্রথমে চোখ খুলে দেন অপহৃত নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা। আমরা যারা লেখালেখি করি বারবার আমাদেরকে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আদিবাসী বিষয়ে লেখা লিখলেই আমাদেরকে ‘আদিবাসী ’ শব্দ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বারণ করা হয়।

ইংরেজী ভাষা বিষয়ে বাংলাদেশীদের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, আমরা ‘কলোনিয়াল’ একটি ভাষাকে রপ্ত করার জন্য কত কী না করি কিন্তু আমাদের দেশে যে ৫০ টি’র অধিক আদিবাসী ভাষা রয়েছে তা আমরা কখনো শেখার বা বুঝার চেষ্টা করি না বলেও উল্লেখ করেন বিশিষ্ট এই আদিবাসী গবেষক। তিনি আদিবাসী ভাষা সমূহকে রক্ষার জন্য সরকারকে আরো মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান।

আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসীদের সাথে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হাতে হাত মিলিয়ে চলবে এটাই হোক আদিবাসী দিবসের মূল প্রত্যাশা। রাষ্ট্র কখনো কখনো তার নাগরিকদের অপমান, অবজ্ঞা করে, অসম্মান করে উল্লোসিত হয়।আর আমাদের দেশে ব্যাপক উন্নয়নের গল্প চলছে ঢালাও ভাবে। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও এই রাষ্ট্র সবার হয়ে ওঠে নায়। এই রাষ্ট্রকে তার সঠিক জায়গায় ফিরিয়ে নিতে হবে এবং এই কাজটি তরুণরাই করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই আদিবাসী নেতা। এই রাষ্ট্রকে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে এবং মানবিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্নে সবাইকে এগিয়ে আসার আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিশিষ্ট এই কলামিষ্ট।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মামুনুর রশীদ বলেন, জাতিসংঘ যদি একটি ভালো কাজ করে থাকে তাহলে সেটি হবে এই প্রান্তিক আদিবাসী মানুষের জন্য একটি দিবস ঘোষণা করা।

তিনি আরো বলেন, আদিবাসীরা এক অর্থে ভালো আছে।আমাদের বাঙালিরা দুই বছরের বাচ্চাকে ধর্ষণ করে, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তার ধর্ষণের বিরুদ্ধে দাড়াঁনো ছাত্রীকে পুড়িয়ে মারে যা আদিবাসীরা করে না। গারোদের ‘আচিক’ ভাষায় ধর্ষণের কোনো প্রতিশব্দ নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রের যথেষ্ট অবহেলা আছে বলেও অভিযোগ এই নাট্যকারের।

“বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার বৌদ্ধ- আমরা সবাই বাঙালি।” এই ভূল স্লোগান দেখে আমাদের নতুন প্রজন্ম আরো বেশী বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং আমাদের দেশে বাঙালি ব্যতীত কত জাতি রয়েছে তা আমরা উল্লেখ করি না বলে মত প্রকাশ করেন তিনি। এই বাংলাদেশ বহুজাতির বহুভাষার ও বহু সংস্কৃতির বলে আবারো উল্লেখ করেন বিশিষ্ট এই নাট্যজন।

সমাপনি বক্তব্যে সুলভ চাকমা বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আদিবাসীদের রয়েছে বলিষ্ঠ অবদান এবং ভূমিকা।কিন্তু আদিবাসীদের ঠিকিয়ে রাখার জন্য যে সংগ্রাম চলছে সেখানে রাষ্ট্র নানাভাবে বাধা প্রদান করে আসছে। এই বাঁধা প্রদান করাটা অত্যন্ত দু:খজনক বলে উল্লেখ করেন এই আদিবাসী ছাত্র নেতা।
সমাবেশের শুরুতেই আদিবাসী অধিকার আন্দোলনে এযাবৎকালে আত্মাহুতি দেয়া সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এছাড়া সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’র সাধারন সম্পাদক কাজী আব্দুল মোতালেব, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফন্ট্রের সাধারন সম্পাদক নাসির হোসের প্রিন্স, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি জুয়েল চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য বিশিষ্ট নারী নেত্রী চঞ্চনা চাকমা এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস) এর ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি ডন জেত্রা, বাংলাদেশ ওরাঁও ছাত্র সংগঠনের সুনীল আকড়া । এরপর গারো নাচের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় আদিবাসীদের লড়াই, সংগ্রাম, জীবন ও তাদের সামগ্রিকতাকে গানে গানে তুলে ধরেন আদিবাসী গানের দল মাদল, আদিবাসী নারীদের ব্যান্ড এফ-মাইনর ও ক্রেমলিন এবং রেমিনিসেন্স।

Back to top button