মতামত ও বিশ্লেষণ

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০১৮ উপলক্ষে আদিবাসী ফোরামের সংবাদ সম্মেলন

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। প্রতি বছরের মতো এবারও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে আগত আপনাদের সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আপনারা জানেন, আগামী ৯ আগস্ট বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দিবস উদযাপিত হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজুলেশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করে ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ও তা যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আহ্বান জানায়। তারপর থেকে দুই যুগ ধরে বৈশ্বিক পর্যায়ে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তন্মধ্যে ২০০০ সালে জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম গঠন, ২০০১ সাল থেকে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোটিয়ার নিয়োগ, ২০০৫-২০১৪ সালের সময়কালকে দ্বিতীয় আদিবাসী দশক হিসেবে পালন, ২০০৭ সালে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র গ্রহণ, ২০০৭ সালে আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কর্মব্যবস্থা প্রণয়ন, ২০১৪ সালে সাধারণ পরিষদের বিশ্ব আদিবাসী সম্মেলন আয়োজন এবং এ সম্মেলনে ঐতিহাসিক ‘আউটকাম ডকুমেন্ট’ গ্রহণ এবং ২০১৫ সালে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল – এসডিজি ২০৩০ বিশেষভাবে উল্লেখযাগ্য। উল্লেখ্য, এসডিজি-তে আদিবাসীদের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আপনারা জানেন, আদিবাসী দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য হলো- আদিবাসীদের জীবনধারা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, আদিবাসী জাতিসমূহের ভাষা ও সংস্কৃতি তথা আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ অ-আদিবাসী জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করে তোলা এবং আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করা।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বিশ্বের ৯০টি দেশের প্রায় ৪০ কোটির অধিক আদিবাসী জনগণের মতো বাংলাদেশে বসবাসকারী ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ এবারও জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস জাতীয়ভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ২০১৮ সালের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় “ওহফরমবহড়ঁং চবড়ঢ়ষবং’ গরমৎধঃরড়হ ধহফ গড়াবসবহঃ” এই মূলসুরের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে, “আদিবাসী জাতিসমূহের দেশান্তর ঃ প্রতিরোধের সংগ্রাম”। কেননা আপনারা জানেন, আদিবাসীদের ইতিহাস জোরপূর্বক দেশান্তরকরণের ইতিহাস। বিশ্বের দেশে দেশে আদিবাসী জনগণ নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন। আদিবাসীদের উপর ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে। কোথাও কোথাও আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। শোষণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ফলে আদিবাসী মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে দেশান্তরিত হয়েছেন, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কখনও কখনও জমিজমা হারিয়ে, আদিবাসী টেরিটরি বা অঞ্চল হারিয়ে, সহায় সম্পদ ও বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে আদিবাসী মানুষ নিরাপত্তার সন্ধানে এবং ভবিষ্যৎ উন্নত জীবনের আশায় অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন। বর্তমানে দেখা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের খোঁজে আদিবাসী পাহাড়ি মানুষ তাদের গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে শহরে নতুন পরিবেশে তারা সংগ্রাম করছেন। আদিবাসী অঞ্চলে নিরাপত্তার অভাব, জীবনের হুমকি, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানান চাপ ও অনিশ্চয়তার কারণেও আদিবাসীরা দেশান্তরিত ও স্থানান্তরিত হচ্ছেন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণেও আদিবাসীরা তাদের এলাকা ছাড়ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ পরিস্থিতির কারণেও আদিবাসী মানুষ দেশান্তরিত হচ্ছে। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে বহিরাগত সেটেলার অ-আদিবাসীদের আধিপত্য ও অত্যাচারের কারণেও আদিবাসী মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী আদিবাসী মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে আদিবাসী জীবনধারা, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ছে। ল্যাটিন আমেরিকায় শতকরা ৪০ ভাগ আদিবাসী জনগণ এখন শহরে বাস করছে। ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশে এমনকি শতকরা ৮০ ভাগ আদিবাসী শহরে বসবাস করছে। যে সব আদিবাসী নিজেদের অঞ্চল ছেড়ে ভালো থাকার আশায় অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা হতাশ হয়েছে, অন্যদিকে তারা নিজেদের বাড়িঘর-জমিজমা চিরতরে হারিয়েছে, আবার নিজস্ব পরিচয়, ভাষা, রীতিনীতি, প্রথা সব হারিয়েছে। শুধু তাই নয়, নতুন অঞ্চলে নতুন পরিবেশে আদিবাসী মানুষ নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। সামাজিক সেবা ও অন্যান্য খাতে তারা প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। যে সব আদিবাসী ট্রান্স-বর্ডার অঞ্চলে বসবাস করছে, তাদের ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বা বন্ধন ছিন্ন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের জন্য জাতিসংঘের এই মূলসুর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশে আদিবাসী মানুষের ইতিহাস নিজভূমি থেকে উচ্ছেদের ইতিহাস, জোরপূর্বক দেশান্তরের ইতিহাস, নির্মম দেশান্তরকরণের ইতিহাস। এখানে ১৯৪৭ সালের পর বার বার আদিবাসীদের দেশান্তরী হতে বাধ্য করা হয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে, সিলেট অঞ্চলে, উত্তরবঙ্গে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে আদিবাসী জনগণ দেশান্তরিত হয়েছেন। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে প্রায় লক্ষাধিক আদিবাসী উচ্ছেদের শিকার হন এবং তাদের মধ্যে ৬০ হাজারের অধিক আদিবাসী মানুষ ভারত ও মায়ানমারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সেখানে এই আদিবাসী মানুষেরা পরিণত হন দেশহীন নাগরিক হিসেবে। অনুমান করা হয়, দেশভাগের পর বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ গারো জন্মভূমি ত্যাগ করে ভারতের মেঘালয় ও আসামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। অন্যান্য সংখ্যাল্প জাতির মধ্যে হাজং, কোচ, বানাই, হদি, ডালু ইত্যাদি জাতির শতকরা ৯০ ভাগের বেশি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হন। তাঁরা তাদের বাড়িঘর, জমি, ভিটামাটি চিরতরে হারান। উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা ও অন্যান্য আদিবাসীদের অবস্থাও আরো শোচনীয়। জমিজমা হারিয়ে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা এখন নিজভূমে পরবাসীতে পরিণত হয়েছেন। উপনিবেশিক আমল থেকেই এই আদিবাসী জাতিসমূহের জীবনের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে জোরপূর্বক দেশান্তরেরই ইতিহাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৭ বছর পরও আদিবাসী মানুষের জীবনে জাতিগত, অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ ও অত্যাচারের অবসান হয়নি। এখনও আদিবাসী অঞ্চলের মানুষ নীরবে দেশত্যাগ করছেন। আদিবাসীরা রাষ্ট্রে এতটাই উপেক্ষিত যে, এই দেশান্তরের ইতিহাসও জানা যায় না। এই নিয়ে নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া সব সময় নীরব অথবা উদাসীন। ইতোমধ্যে, দেশে কয়েকটি আদিবাসী জাতির পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিলুপ্তপ্রায়। কোনো কোনো আদিবাসী জাতি কোনরকমে টিকে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক সময়ের প্রভাবশালী হাজং জাতি এখন অদৃশ্যপ্রায়। অনেকেই ভারতে চলে গেছেন। এক সময় বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় ৫০ হাজারের অধিক রাখাইন আদিবাসীর বসতি ছিল, দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে, সেখানে বর্তমানে রাখাইন জনসংখ্যা ৫০ হাজার থেকে নেমে উল্টো মাত্র ২,২০০ জন। অনেকেই দেশান্তরিত হয়েছেন অথবা অন্যত্র চলে গেছেন নিরাপত্তার কারণে। আগামী কয়েক দশক পর এই অঞ্চলে রাখাইন অস্তিত্ব হয়তো হারিয়ে যাবে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা জানেন, কেন মানুষ দেশান্তর হয়। স্ব-ইচ্ছায় জন্মভূমি ছেড়ে যেতে কেউ চায় না। জন্মভূমি হলো মায়ের মতো। তারপরও আদিবাসী মানুষকে প্রিয় দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। স্বাধীনতার পর অনেক গণহত্যা হয়েছে আদিবাসী অঞ্চলে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচ লক্ষাধিক সেটেলার বাঙ্গালীকে অবৈধভাবে পূনর্বাসন দিয়ে সেখানকার জুম্ম আদিবাসীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। নানান কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার আদিবাসী এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বাস করছে। গারো, সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসীরাও ব্যাপকহারে শহরমুখী হয়েছেন। আদিবাসীদের এই স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পুশ ফ্যাক্টর ও পুল ফ্যাক্টর উভয়েই কাজ করেছে। আদিবাসী অঞ্চলসমূহ ক্রমান্বয়ে নিরাপত্তাহীনতাসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে জর্জরিত হচ্ছে। এখানে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, উন্নত বাসস্থানসহ নানা চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে। আবার, যেসব আদিবাসী স্ব-ইচ্ছায় উন্নত দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, তাদের ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় এটি বলা যায় যে, ‘মাইগ্রেশন’ আদিবাসীদের জীবনে অভিশপ্ত হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বিশ্বব্যাপী আদিবাসী জনগণ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার, অঞ্চল বা টেরিটরির অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতি চায়। কিন্তু আদিবাসী অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সংঘাত ও নিয়ন্ত্রণহীন উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে আদিবাসীরা নিজ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। মানবাধিকার লংঘন, গণহত্যা, হুমকি, নারী নির্যাতন, ভূমি দখল, অপমান ও লাঞ্ছনার কারণে দেশান্তরের প্রবণতা বাড়ছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উপর ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘন ও হত্যার পর কোনো বিচার না হওয়ায় অনেক আদিবাসীর নীরবে দেশান্তরের খবর আমরা পেয়েছি। খাসিয়া আদিবাসীরা এখনও শ্রীমঙ্গলের নাহার ও কাইলীন পুঞ্জি, কুলাউড়ার ঝিমাই পুঞ্জিতে অনিশ্চিত জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। যেকোনো সময় তাদের উচ্ছেদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মিথ্যা মামলা ও হয়রানি তারা মোকাবেলা করছেন। শ্রীমঙ্গল উপজেলার নাহার খাসিয়া পুঞ্জির ৮৫ পরিবারকে উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। আইন ও রীতি লংঘন করে চা বাগানের পক্ষে প্রশাসন এই অবৈধ কাজ করেছে। খাসিয়ারা বিভাগীয় কমিশনারের নিকট আপিল করার পর সিলেট বিভাগীয় কমিশনার উচ্ছেদ নোটিশটি বাতিলের রায় দিয়েছেন। এবারে খাসিয়ারা উচ্ছেদের হাত থেকে রক্ষা পেলেও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া ও গারোদের ভূমি সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। মধুপুর গড় অঞ্চলের ২০ হাজারের অধিক আদিবাসী রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা জানেন, স্বাধীনতার ৪৭ বছরে দেশের ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক সময় যেসব অঞ্চলে আদিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, সেখানে পপুলেশন ট্রান্সফারের ফলে আদিবাসী জনগণ নিজভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, গারো পাহাড়, উত্তরবঙ্গ, গাজীপুর, মধুপুর বনাঞ্চল, পটুয়াখালী-বরগুনা, খাসিয়া অঞ্চল সর্বত্র আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি হারিয়েছে। আদিবাসীদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, আত্ম-পরিচয় ও নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও আদিবাসী জনগণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। এবার আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে তাই আমরা আদিবাসীদের জোরপূর্বক দেশান্তরকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাই।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। গত কয়েকদিন আগেও খাগড়াছড়িতে ১০ বছরের একটি ত্রিপুরা শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। লংগদু হত্যা ও সাম্প্রদায়িক হামলার কোনো বিচার হয়নি। কাপেং ফাউন্ডেশনের মতে, বান্দরবান জেলার আলিকদম-থানচির মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকার কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক আদিবাসী নিরাপত্তার অভাবে মায়ানমারে দেশান্তরিত হয়েছেন। অনেকে নীরবে, সপরিবারে চলে যাচ্ছেন। উত্তরবঙ্গে কয়েকশত আদিবাসী, সাম্প্রদায়িক হুমকি ও আক্রমণের কারণে এবং ভূমিদস্যুদের ভয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা আরও সংকটজনক। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক আশা নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মৌলিক বিষয়গুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। দেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সমাজ আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় ও জনসচেনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আজ আদিবাসী দিবসে আপনাদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, সংগ্রামের পথেই আদিবাসীরা একদিন না একদিন তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদিবাসীদের মতো বাংলাদেশের আদিবাসীরাও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে। এ দিবসটি আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের পথে নতুন চেতনায় উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন।
আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে এবারও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও অন্যান্য সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে-
# ৭ আগস্ট মঙ্গলবার দিনব্যাপী বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র (্চীন মৈত্রী ) মিলনায়তনে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস ও আরডিসি’র অনুষ্ঠান;
# ৮ আগস্ট বুধবার সকালে এএলআরডি ও অন্যান্য সংগঠন মিলিতভাবে আদিবাসী দিবসের মূলসুর নিয়ে সেমিনার আয়োজন করবে সিরডাপ মিলনায়তনে; সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (গাসু)-এর উদ্যোগে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন।
# ৯ আগস্ট সকাল ১০টায় আদিবাসী দিবসের দিনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মূল অনুষ্ঠান- অনুষ্ঠানে থাকবে সমাবেশ, র‌্যালী ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল উদ্বোধক এবং হাসানুল হক ইনু, এমপি, মাননীয় মন্ত্রী, তথ্য মন্ত্রণালয়, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়াও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ উপস্থিত থেকে সংহতি জানাবেন।
এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় ও উপজেলায় যেমন- রাজশাহী, দিনাজপুর, নাটোর, মাগুরা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নেত্রকোণা, সিলেট, মৌলভীবাজার, শেরপুর, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে আদিবাসী দিবস উদযাপন করা হবে।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিতব্য এসব কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আপনাদের সকলকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আহ্বান-
১.আদিবাসী জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ আদিবাসীদের উপর সকল প্রকার নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করার লক্ষ্যে একটি আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা;
২.মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করে আদিবাসীদের জোরপূর্বক দেশান্তরকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
৩.আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা;
৪.পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অবিলম্বে যথাযথ বাস্তবায়ন করা এবং এ লক্ষ্যে সময়সূচি-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করা। ভূমি কমিশন আইন অবিলম্বে কার্যকর করা;
৫.জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন করা। আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন ও ১৬৯ নং কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করা;
৬.সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য ভূমি কমিশন গঠন করা। মধুপুর গড়ে গারো ও কোচদের ভূমিতে ঘোষিত রিজার্ভ ফরেস্ট বাতিল করা;
৭.মৌলভীবাজার জেলার ঝিমাই ও নাহার খাসিয়া পুঞ্জির খাসিয়াদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা এবং চা বাগানের লীজ বাতিল করা;
৮.আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং তাদের ওপর এ পর্যন্ত যে সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনা (ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ, বৈষম্য-নির্যাতন ইত্যাদি) ঘটেছে সেসব ঘটনার পূর্ণ তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।

সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বর্তমান সরকার বলছে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম জোর দিয়ে বলতে চায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত হাজার হাজার আদিবাসী মানুষের জীবনে এ কথার প্রতিফলন নেই, এর সত্যতা নেই। মানবাধিকার লংঘন, ভূমি দখল, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ফলে আদিবাসীদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে কবলিত। মাথাপিছু আয়ের যে হিসাব দেখানো হয়, সেখানেও আদিবাসীদের প্রতিফলন নেই। দেশে যখন জবাবদিহিতা, আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতার অভাব প্রকট হয়, তখন আদিবাসীসহ দেশের গরিব ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ পরিস্থিতি। তারা আরো বেশি প্রান্তিক অবস্থানে চলে যায়। সরকার আদিবাসীদের আত্ম-পরিচয়ের সংকট তৈরি করেছে। রাষ্ট্র এত যে দায়িত্বহীন আচরণ করছে আদিবাসীদের সঙ্গে, তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি-তে জাতিসংঘ আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নের কথা বলছে। আর এ দেশে আদিবাসীদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে কবলিত।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
দিনে দিনে আজ এদেশের আদিবাসী জাতিসমূহকে ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়েছে। তারা সর্বস্বান্ত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য- জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং এদেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন, বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন ও মিডিয়া আদিবাসী জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে বিভিন্নমুখী ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু জাত্যাভিমানী, অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও মানবতাবিরোধী শাসকগোষ্ঠীর কারণে এসব ভূমিকাসহ আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংগ্রাম তাদের অধিকার সংরক্ষণে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আজ তাই আদিবাসীদের জীবনধারা দেশান্তরিত, বিপর্যস্ত ও বিলুপ্তপ্রায়। তাই আদিবাসীদের যেন আর কোনো অপশক্তি জোরপূর্বক দেশান্তরের দিকে ঠেলে দিতে না পারে তজ্জন্য আদিবাসী জনগণের প্রতিরোধের সংগ্রাম জোরদার করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

আপনাদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ।

জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা
সভাপতি
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
আগস্ট ৬, ২০১৮

Back to top button