জাতীয়

আদিবাসী যুব ফোরামের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত: নেতৃত্বে টনি চিরান, মনিরা ত্রিপুরা ও চন্দন কোচ

আজ ২৫ অক্টোবর, ২০২৫, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় আদিবাসী যুব সম্মেলন। তিন শতাধিক আদিবাসী যুব এর অংশগ্রহনে এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম এর সভাপতি আন্তনী রেমা। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মনিরা ত্রিপুরার সঞ্চালনায় সম্মেলনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিরেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজোয়ানা, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, বাংলাদেশ যুব ফোরাম এর সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন প্রিন্স প্রমুখ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের যুবকদের এখন আপনি গ্রামে দেখবেন না। তারা জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন শহরে গমন করছে তা নয়, নিরাপত্তার কারনেও তারা গ্রাম ছাড়ছে। অনেক আদিবাসী যুবরা এখন পোষাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। সমতলের আদিবাসীরা আরো বেশি নিপীড়িত। তারাও অনেকেই এই ঢাকা শহরে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অসহনীয় জীবন এবং শ্রেণীগত ও জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আদিবাসী যুবদেরকে সঠিক প্রগতিশীল আদর্শের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করছেন সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার।

তিনি অরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা চুক্তি করেছি। কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা দেখি ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু থেকে বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিক ইতিহাসের ক্রমধারায় তারা নিজেদের সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ করেছে। এমনকি বাঙালিরাও ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব সুনিশ্চিত করেছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ আর সহ্য করতে পারছে না। এত নিপীড়ন ও অবিচারের মধ্যে রুখে না দাঁড়ালে আমাদের অস্তিত্ব আর থাকবে না। কাজেই তরুণদের এগিয়ে এসে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়া বৈ আর কোনো উপায় নেই। আমি এসব কথা বলছি ভয় ভীতি প্রদর্শনের জন্য নয়। তরুণদেরকে সতর্ক করার জন্যই এসব বলছি। কাজেই আপনারা সংগঠিত হোন এবং রুখে দাঁড়ান।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে কিছু সংগঠন ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়েছে। তারা দাবি করে পাহাড়ে আদিবাসী বলা যাবে না। সেটলার বলা যাবে না। পার্বত্য চুক্তি বাতিল করতে হবে। এরা আসলে টোটাপাখি। তারা যাদের দ্বারা পরিচালিত হয় তারা যেভাবে শেখায় সেভাবেই এসব কথা বলে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আমি মনে করি আমাদের আন্দোলন এগিয়ে গেছে এবং তরুণরা এগিয়ে নিবে। আগে আমরা গারো, সান্তাল, চাকমা, মারমা, খাসি যুব’দের মধ্যে কোনো আলোচনা করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম এর মাধ্যমে আদিবাসী যুবরা এগিয়ে যাচ্ছে, একত্রিত হচ্ছে। কাজেই আমাদের সংগ্রাম এগিয়ে যাবে। আমরা গণঅভ্যুত্থান দেখলাম। কিন্তু এক বছরের মাথায় এসে সে স্বপ্ন আমরা ভেঙে যেতে দেখছি। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বহু দেশের মানুষ তাদের পূর্ব পুরুষদের কৃত কর্মের জন্য আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এই বাংলাদেশেও একদিন শাসকদের বোধদয় হবে এবং আদিবাসীদের সাথে একদিন মানবিক, গণতান্ত্রিক আচরণ করবে এবং আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিবে। তার জন্য আমাদের সংগ্রাম নিয়ত জারি রাখতে হবে

এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, আমরা একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছ্।ি কিন্তু আসলেই কী আমরা সমাজের সব মানুষের কথাগুলো সংস্কার কার্যক্রমে তুলে ধরতে পেরেছি। বিচার বিভাগ কী স্বাধীন হতে পেরেছে? আমার তো মনে হয় না। তা না হলে কেন এখনো বম আদিবাসী নাগরিককে বিনা বিচারে দিনের পর দিন আটক রাখা হবে। কেন নারী, শিশু ও সাধারণ নাগরিকদেরকে বন্দী রাখা হচ্ছে। কাজেই আমাদের লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের এ লড়াই দীর্ঘ এবং এ লড়াইয়ে বাঙালি-আদিবাসী সবাইকে একসাথে পথ চলতে হবে।

বক্তব্য রাখছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজোয়ানা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজোয়ানা বলেন, বাংলাদেশে কে আদিবাসী, কে আদিবাসী নয় সেটা একটা কুতর্ক। আপনি যদি আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রে যে অধিকারগুলো আদিবাসীদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে সেটা স্বীকার করে নিলেই তো হয়। আসল কথা হচ্ছে আমরা আদিবাসীদের অধিকার দিচ্ছি কী না। এখন আমরা দেখি বাংলাদেশে মৌলবাদিতার নামে, ধর্মান্ধতার নামে সমস্ত ধরণের সৃজনশীল চর্চা, সাংস্কৃতিক আলাপ শেষ করে দেয়া হয়েছে। আদিবাসী যুবদেরকে নিজেদের মেধা, মনন ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের যে শক্তি সেটা নিয়ে লড়াইকে বেগবান করতে হবে। আমি চাই আমাদের শিশুরা স্কুলে চাকমা’দের সংস্কৃতি জানুক। সান্তালদের ইতিহাস জানুক। বাঙালি বনাম আদিবাসী এই বৈপ্যরীত্য টিকিয়ে রাখতে চাই রাষ্ট্র। এই বৈপ্যরীত্য যদি ঘুচাতে চাই তাহলে আমাদেরকে এই বাইনারী ভাঙতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই জারী রাখতে হবে।

লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, বাংলাদেশে আদিবাসী কারা এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আমাদেরকে এই ভূমিতে কে আগে এসেছে, কে পরে এসেছে এই বাইনারীর মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। আমরা যদি ইতিহাস দেখি ১৯৬২ সালে মধুপুর জাতীয় উদ্যান ঘোষণা, প্রায় একই সময়ে কাপ্তাই বাঁধ, গাইবান্ধায় গোবিন্দগঞ্জে সান্তালদের জমিতে চিনিকল ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে আদিবাসীদের জমিতে আদিবাসীদেরকেই সংখ্যালঘুকরণের এক ধরণের নীতি গ্রহন করা হয়েছে। এভাবে ক্রমাগত প্রান্তিকতার মধ্যে ঠেলে দিতে দিতে আজকে তাদেরকে আরো দুর্বল করা হয়েছ্। এসবের বিরুদ্ধেই আদিবাসী যুবদের সংগ্রাম খুবই জরুরী এবং সেটা ক্রমাগত জারী রাখতে হবে।

বাংলাদেশ যুব ফোরাম এর সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম বলেন, জাতীয় যুব দিবস। পাহাড়ের কাছাকাছি থাকি বলে আমি জানি যে পাহাড়ের আদিবাসীরা কীরকম প্রান্তিকতার মধ্যে রয়েছে। তাদের উপর নিপীড়নের যে গল্প সেগুলো শুনলে আমাদের আত্মগ্লানি হয়। কারণ, এই আদিবাসীদের উপর যে নিপীড়ন সে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে আমার মত বাঙালিদের সেখানে সেটলার হিসেবে নিয়ে গিয়ে। তারা সেখানে আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ করছে। জমি দখল করছে। বাংলাদেশের ৬১ জেলা চলছে এক শাসনে আর এই তিন পার্বত্য জেলা চলছে সেনাশাসনে। সেখানে ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে প্রতিনিয়ত চলতে হচ্ছে। এই জায়গাগুলো আমাদেরকে পীড়া দেয়। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকারসহ অস্তিত্ব রক্ষার যে সংগ্রাম সেটা বাঙালি এবং আদিবাসী সকলের। সে লড়াই সকলকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিতে হবে।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, আমাদের আদিবাসীদের উপর নিপীড়ন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে আদিবাসী নারীদের উপর নিপীড়ন যেমন বেড়েছে তেমনি ধরণও পাল্টেছে। আগে কেবল মাত্র শারিরীক নিপীড়ন করা হতো। এখন শারিরীক, মানসিক ও অনলাইন বুলিং এর মাধ্যমে নানাভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে। এই ভয়াবহ নিপীড়নের বিরুদ্ধে আদিবাসী যুব’দেরকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সামনের দিনগুলো আরো ভয়াবহ। সামগ্রিকভাবে আমাদেরকে আরো বেশী নিপীড়ন করার জন্য শাসকগাষ্ঠী পরিকল্পনা করছে। কাজেই এসব জেনে বুঝেই আদিবাসী যুবদেরকে প্রস্তুত হতে হবে।

সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উপস্থিত আদিবাসী যুব নেতৃবৃন্দ।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন প্রিন্স বলেন, বাংলাদেশ একটি বহু জাতির ও বহু ভাষার রাষ্ট্র। কিন্তু এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্রমাগত এই বৈচিত্র্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে আদিবাসীদেরকে নানাভাবে প্রান্তিকতার মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। সমতলের আদিবাসী ক্রমাগত ভূমি হারাচ্ছেন। খাসিয়াদের পান জুম কেটে দেয়া হচ্ছে। পাহাড়ে বারংবারং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরী করা হচ্ছে। এমনি একটা বাস্তবতায় আদিবাসী তরুণদেরকেই সংগঠিত হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদেরকে আদিবাসী যুব ও বাঙালি যুব সম্মিলিতভাবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নিতে হবে।

এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক চন্দন কোচ, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা। এদিকে প্রথম অধিবেশনের পর শুরু হয় বিকেলের দ্বিতীয় অধিবেশন। এই অধিবেশনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সাংগঠনিক সম্পাদক এন্ড্রো সলোমর, সংগঠনটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিরন মিত্র চাকমা, ক্রিড়া, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক উজ্জল আজিম, কেন্দ্রীয় সদস্য রিপন চন্দ্র বানায় প্রমুখ।

উক্ত অধিবেশনে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন আদিবাসী যুব ফোরাম এর সাংগঠনিক সম্পাদক চন্দন কোচ এবং আর্থিক প্রতিবেদন পেশ করেন সংগঠনটির অর্থ সম্পাদক অনন্যা দ্রং। এ অধিবেশনে পর্যবেক্ষকের বক্তব্য পেশ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক অন্তর চাকমা, গাসু’র সাংগঠনিক সম্পাদক সতীর্থ চিরাণ। পরে টনি চিরানকে সভাপতি, মনিরা ত্রিপুরা সাধারণ সম্পাদক ও চন্দন কোচকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট পরবর্তী দুই বছরের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা ও অনুমোদন করা হয়।

Back to top button