জাতীয়

আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে: ঢাকায় আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আলোচনা সভায় বক্তারা

আন্তর্জাতিক নারী দিবস (৮ মার্চ)- উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও কাপেং ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে আজ ৯ মার্চ ঢাকায় উইমেন্স ভলান্ট্যারি এসোসিয়েশন (ডব্লিউভিএ) অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন কাপেং ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক ও ক্রীড়া শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ¦ল আজিম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য লুনা নূর, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের শাহনাজ সুমি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হোসেন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও জাতীয় নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য নিরুপা দেওয়ান প্রমুখ।
বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সদস্য অনন্যা দ্রং এর সঞ্চালনায় ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য সুলেখা ম্রংয়ের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ঢাকা মহানগরের সদস্য কলি চাকমা। তিনি বলেন বাংলাদেশের আদিবাসী নারীরা আজও সকল ক্ষেত্রে শোষণ, বঞ্ছনা ও বৈষম্যর শিকার হচ্ছে। তিনি আদিবাসী নারীসহ সমগ্র নারীদের সংগ্রামের ইতিহাস ও ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছিল, আমরা সেই বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে পারিনি। বরং জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে আদিবাসীদের উপর আরও বৈষম্য, শোষণ-নিপীড়ন বেড়েছে। তিনি আরও বলেন বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল নারীদের আন্দোলন নয়, নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি এনসিটিবি কর্তৃক আদিবাসী সংবলিত গ্রাফিতি বাতিলের প্রতিবাদ মিছিলে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমনের ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন দেশে আদিবাসীরা আজও কোথাও নিরাপদ নয়। তারা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তার হুমকির মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, আমরা এমন একটা সময়ে নারী দিবস পালন করছি যে, দেশের ক্রান্তিলগ্নে আজ সারাদেশে নারীদের উপর সহিংসতা তীব্র আকার ধারন করেছে। শিশু থেকে বৃদ্ধা মহিলা কেউই রেহাই পাচ্ছেনা। নিউজ দেখলে প্রতিনয়ত ধর্ষণের সংবাদ দেখতে পাই। অথচ, বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রে নারীদের অবদান ব্যাপক থাকলেও নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যর শিকার হতে হয়।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক শাহনাজ সুমি বলেন, নারী কিভাবে চলবে, কি পড়বে,কোথায় যাবে সকল কিছু ঠিক করে দিচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। অথচ এই সমাজ ব্যবস্থায় নারীরাও অর্ধেক অংশ। আজকে নারীদের উপর ধর্ষণ, নিপীড়ন, বাল্য বিবাহ এখনও চলমান রয়েছে। আদিবাসী নারীদের উপর সহিংসতা ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারীদের উপর প্রতিনিয়ত সহিংসতা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ্বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, দেশের মৌলবাদের উত্থানের ফলে নারীদের আজ সকল ক্ষেত্রে অনিরাপদ অবস্থায় আছে। ধর্মের নামে নারীদেরকে তাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও বর্তমান জাতীয় নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য নিরুপা দেওয়ান তার বক্তব্যে বলেন আদিবাসীরা যুগের পর যুগ ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। আমাদের আদিবাসী নারীরা পদে পদে সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে।
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা। তিনি তার বক্তব্যে ১২টি সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন-
১. আদিবাসী নারীর সকল মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
২. আদিবাসী নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা বন্ধে দ্রুত ও কার্যকর হস্তক্ষেপ, ব্যবস্থা গ্রহন ও নিরাপত্তা জোরদার করা।
৩. আদিবাসী নারী ও শিশুর উপর সহিংসতার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি প্রদান করা।
৪. সহিংসতার শিকার আদিবাসী ও শিশুদের উপর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা প্ৰদান করা।
৫. নারী উন্নয়নের নীতিমালায় আদিবাসী নারীদের জন্য আলাদা একটা অধ্যায় রাখা এবং সকল ধরনের নীতিমালা গ্রহনের পূর্বে আদিবাসী নারী নেতৃবৃন্দের পরামর্শ গ্রহন করা ।
৬. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা এবং সময়সূচি ভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
৭. আদিবাসী নারীদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা।
৮. ভূমি ও সম্পত্তির উপর আদিবাসী নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং বন, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের ভূমিকা স্বীকার করা।
৯. আদিবাসী মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যু কমানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা।
১০. শিক্ষা কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের জন্য কোটা নিশ্চিত করা এবং বিধবা ও বয়স্ক ভাতা নিশ্চিত করা।
১১. জাতীয় সংসদে অঞ্চল ভিত্তিক এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আদিবাসী নারী প্রতিনিধি নিশ্চিত করা।
১২. সমতলে আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও মন্ত্রণালয় গঠন করা।

Back to top button