আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভা
সতেজ চাকমা: আগামী ৯ আগষ্ট ২০১৯ ইং আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এই দিবসকে উপলক্ষ্য করে বাংলাদেশে বসবাসকারী ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী মানুষের নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এবং বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের আয়োজনে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। উইমেন ভলান্টিয়ারী এসোশিয়েশনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হওয়া এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমার পরিচালনায় আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য তুলি লাবণ্য ¤্রং বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এ সহিংসতার মাত্রা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের হলেও ধরণগুলো প্রায় একই। কিন্তু এ সহিংসতার মাত্রা আদিবাসী নারীর উপর আরো বেশী। আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা মানে পুরো ধরিত্রি, ভাষা, সংস্কৃতি’র উপর আঘাত বলেও উল্লেখ করেন এই আদিবাসী নারী নেত্রী। তিনি আদিবাসী নারী তথা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে উপস্থিত সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের স্বমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা মূল আলোচনাপত্র উপস্থান করেন। উক্ত আলোচনাপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, আদিবাসী নারীরা বৈষম্যের শিকার হন প্রথমত নারী হিসাবে, দ্বিতীয়ত আদিবাসী হিসাবে এবং তৃতীয়ত আদিবাসী নারী হিসাবে। বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতি এবং সমাজের বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক বাস্তবতার কারণে আদিবাসী নারীদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রাখা হয় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা,চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও আদিবাসী নারীরা খুব কমই সুযোগ পেয়ে থাকে বলেও অভিযোগ এই নারী নেত্রীর।
আদিবাসীদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের মানবাধিকার রির্পোট উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন,কেবল ২০১৮ সালেই সারাদেশে আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি প্রায় ৪৫ টির অধিক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে। পুরো বছর ধরে ৪৫ টি ঘটনায় প্রায় ৫৪ জনের অধিক আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যার মধ্যে ১২ জন আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুকে হত্যা ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ঐসব ঘটনাগুলো সংঘটনের পেছনে ৮৫% অ-আদিবাসীরা জড়িত বলেও তিনি মূল বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
তিনি আরো অভিযোগ করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলের আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতা যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, হত্যা ও অপহরণের বিরুদ্ধে যতগুলো মামলা হয়েছে তার কোনোটার কোনো অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে বলে নজির নেই । আইনরক্ষাকারী বাহিনী, চিকিৎসক ও স্থাানীয় প্রশাসনের অসহযোগীতা আদিবাসী নারী ও শিশুদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসাবে কাজ করে বলেও অভিযোগ তুলেন তিনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা বলেন, সহিংসতা প্রতিরোধে প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে করণীয় নির্ধারণ করা। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর পরই প্রথম কর্তব্য পড়ে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর । কিন্তু উল্টো আইনরক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক এই ধরণের সহিংসতার ঘটনা সংঘটন বেশ দুঃখজনক।আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা এই সহিংসতা সংঘটেনর ঘটনা পাহাড়েই বেশী বলে অভিযোগ এই আদিবাসী নেতার। অন্যদিকে পাহাড়ে আদিবাসী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সংঘটনের দায়ে জড়িত ব্যক্তিরা তো ধরা পড়ছেই না বরং বীরদর্পে বিচরণ করছে এবং মামলায় অভিযুক্ত হলেও এই অপরাধীরা আইনের নানা ফাঁকফোকড় এবং আইনরক্ষাকারী সংস্থার দায়বদ্ধতার অভাবে জামিনে বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম সম্মনিত অতিথির বক্তব্যে বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদেরকে বলতেই হবে। ক্লান্তিহীনভাবে বলে যেতে হবে যতক্ষণ না রাষ্ট্র শুনতে পায়। রাষ্ট্র অঙ্গীকার করার পরেও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে লিঙ্গ, গায়ের রং, ধর্ম ইত্যাদির ভিত্তিতে নানা বিভাজন করার মধ্য দিয়ে শাসন করে। যার ফলে প্রতিবাদ জোড়ালো হয়ে ওঠে না। কাজেই আমাদেরকে অবশ্যই প্রতিবাদের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার মধ্যে যে মানবিকতা’র কথা বলা হয়েছে সেই মানবিক স্বত্তার বিকাশের মাধ্যমেই নারীকে মানুষ হিসাবে তথা আদিবাসী নারীকে মানুষ হিসাবে দেখতে হবে। রাষ্ট্রের সংগে প্রতিনিয়ত ‘এঙ্গেজমেন্ট’ করতে হবে, প্রতিনিয়ত সংগ্রামটা জারী রাখতে হবে বলেও তিনি জোড়ালোভাবে তুলে ধরেন।
এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন‘কনফ্লিক্টিং জোন’ এর নারীরা আরো বেশী সহিংসতার শিকার হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ‘পার্বত্য চুক্তি’ বাস্তবায়ন না করার ব্যাপারে একটা নেতিবাচক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্র পোষণ করে এবং সেই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবী করেন তিনি।‘ অধিকার ও মর্যাদা’র প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্র আরো সচেতন হয়ে প্রত্যেক নাগরিক যেন এইসব ভোগ করতে পারে তার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নিবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিশিষ্ট এই নারীনেত্রী।
যারা সংবিধানে নিজেদের স্বীকৃতির জন্য লড়াই করে তারাই কী বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে প্রশ্ন রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোয়ায়েত ফেরদৌস বলেন, একটা মেয়ে যদি ধর্ষণের শিকার হয়ে যায় তাহলে লজ্জাটা সেই মেয়েটির না, সেই লজ্জা ধর্ষকের। আর ধর্ষণের শিকার হওয়া মানে এই নয় যে, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমাদেরকে একসাথে দাঁড়াতে হবে, কাউন্সেলিং করতে হবে।এছাড়া তিনি আদিবাসীদের সমস্যাকে ‘নিরাপত্তার লেন্স’ দিয়ে না দেখে হৃদয় দেখে দেখারও অনুরোধ করেন তিনি।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই অধ্যাপক আরো বলেন, আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করার জন্য তাঁদেরকে প্রথমে জীবিকার জন্য যে ব্যবসা বাণিজ্য সেখানে আঘাত করা হয়,তাতে কাজ না হলে বাড়ীঘরে আঘাত করা হয় এবং তাতেও না পারলে আদিবাসী মেয়েদেরকেই আঘাত করা হয়। বরগুনার রাখাইন অঞ্চলে আগে যে ৬০ হাজার রাখাইন পরিবার ছিল সেখান থেকে বর্তমানে কেবলমাত্র ২.৫ হাজার পরিবার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আদিবাসীদেরকে ‘আন-পিপলিং’ করা হচ্ছে।
আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং একটি ইংরেজী চলচ্চিত্রের কথোপকথন উল্লেখ করে বলেন, ’সামটাইমস হোয়েন ইউ উইন, ইউ লুজ’। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্র অনেক সময় মনে করে নারীদের অসম্মান করলে, দুর্বলকে অসম্মান করলে, আদিবাসীকে অসম্মান করলে জয়ী হয়। কিন্তু আসলেই রাষ্ট্র জয়ী হয় না, হেরে যায়। আদিবাসী মানুষদের বিভিন্ন মাতৃভাষার মধ্যে ‘ধর্ষণ’ শব্দের প্রতিশব্দ নেই। এছাড়া ‘অপমান’ ‘অমর্যাদা’ শব্দগুলো নেই। আর যাদের জীবনে এই শব্দগুলোর সংগে পরিচয় নেই তাদেরকেই এসবের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এই আদিবাসী নেতা।
সমাপনি বক্তব্যে নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, নারীর বিরুদ্ধে যে সহিংসতা তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমাদেরকে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হবে। কিন্তু সেগুলো অতিক্রম করেই আমাদেরকে একসাথে লড়ে জয় আনতে হবে। তিনি সবাইকে নারী তথা আদিবাসী নারীদের ব্যাপারে ‘পজিটিভ’ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে ‘নারী’ সহিংসতার বিরুদ্ধে স্ব স্ব অবস্থান থেকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আলোচনা সবার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।