জাতীয়

আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭ – নারী সহিংসতা ৪৮, হত্যা ১০, সাম্প্রদায়িক হামলা ৫

বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৭ প্রকাশ করেছে কাপেং ফাউন্ডেশন। এ উপলক্ষে আজ ডেইলি স্টারের তৌফিক আজিজ খান সেমিনার হলে এক মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত এক বছরে বাংলাদেশের আদিবাসীদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশে কাপেং ফাউন্ডেশনের সহযোগী ছিলো বেসরকারি সংস্থা অক্সফাম।

সকাল ১০ টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামাল। তিনি তার আলোচনায় বলেন, আদিবাসীদের মানবাধিকার যে পরিস্থিতি, যে সমস্যা তা কেবল আদিবাসীদের নয়। এ সমস্যা বাংলাদেশের, আমাদের সবার সমস্যা। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের জনগন তাদের উপর ঘটা মানবাধিকার লংঘনের বিচার পাবেনা তা হতে পারেনা। দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চলছে তা চলতে দেয়া যায়না। মানুষ মনে করছে কিছু করার নেই কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমাদের এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। সুলতানা কামাল মনে করেন, মানবাধিকার লংঘন, বিচারহীনতা, প্রান্তিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর ঘটা অন্যায় এর জন্য আওয়ামীলীগ, বিএনপির মত রাজনৈতিক দল দায়ী থাকবেনা ইতিহাসে, জাতি হিসেবে আমরা দায়ী থাকবো।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সন্মানিত সদস্য ও এমপি ঊষাতন তালুকদার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সার্বিক ভাবে এগিয়ে যাওয়ার সব উপাদানই বিদ্যমান। কিন্তু কোন এক কারনে আমরা কেবল পিছিয়ে যাচ্ছি। দেশে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় বাংলার জাগ্রত বিবেক আজ যেন ঝিমিয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যুক্ত থাকে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজ করতে কিছু সীমাবদ্ধতার থেকে যায় বলে জানালেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বাঞ্ছিতা চাকমা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করা যাবেনা মানবাধিকার কমিশনে এমন ধারা রয়েছে এবং তিনি এমন ধারার পরিবর্ত করলে কাজ করতে সুবিধা হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া সাম্প্রতিক মায়ানমার থেকে আসা রোহিংগাদের কারনে পার্বত্য অঞ্চলে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে পারে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং তার বক্তব্যে বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে কিন্তু তা স্বীকার করা হয় কি না তার থেকে প্রতিকার বা বিচারের মাধ্যমে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয় কি না সেটাই বড় কথা। যদি তা করা না হয় তবে সেটা রাষ্ট্রের জন্য কলঙ্কজনক। বাংলাদেশে আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেন এ রাষ্ট্র আদিবাসীদের দেখেনা, এ রাষ্ট্র অসুখে ভুগছে তাকে সারিয়ে তোলা দরকার।

বাংলাদেশের আদিবাসীদের মুক্তি এখনো আসেনি বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সাদেকা হালিম। আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের যে ঘটনা ঘটছে তার প্রতি সরকারের সদয় দৃষ্টি দেবার আহবান জানান তিনি।

বেসরকারি সংস্থা অক্সফামের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এমবি আক্তার তার বক্তব্যে বলেন, আমরা উগ্র জাতীয়তাবাদ ও উগ্র মৌলবাদের সময়ে বাস করছি। এ দুটো ঘরানার মানুষ তাদের মতের বাইরের মানুষদের সংখ্যালঘু বানিয়ে ফেলে। আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের গত তিন বছরের কোন ঘটনারই সমাধান হয়নি বলেও জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন। তিনি সভাপতির বক্তব্যে বলেন, পাহাড়ে-সমতলে আদিবাসীদের উপর সমানতালে নির্যাতনের ঘটনা, মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। তিনি আরো বলেন, যে দেশে গণতন্ত্র নাই, যে দেশ কতিপয় লুটেরাদের, সে দেশের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারেনা।

রিপোর্টে দেখা যায় ২০১৭ সালে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে শারীরিক নির্যাতন ও মৃত্যু, আদিবাসী কর্মীদের নানা অজুহাতে গ্রেফতার করা, বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত করে সাজানো মামলা দায়ের করা, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নিয়ে অমানুষিক মারধর করা, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে জেলে প্রেরণ করা ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন উদ্বেগজনকভাবে অব্যাহত রয়েছে। ২০১৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭ জন সহ ১০ জনকে হত্যা করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪১ জন আদিবাসী কর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসী গ্রেফতার ও সাময়িক আটক, ১৬১ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা হয়। পাহাড়-সমতল মিলে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে ৫ টি। এ সময়কালে আদিবাসীদের প্রায় ২০ হাজার একর জমি অধগ্রহন বা অধিগ্রহনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলেও রিপোর্টে জানানো হয়। নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে কোন কার্যকরী ভূমিকা গ্রহন করা হয়নি। ২০১৭ সালে আদিবাসী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৪৮ টি। যার মধ্যে ধর্ষণের শিকার ১২, হত্যা ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৯ জনকে এবং ৯ জনকে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের চেষ্টা ও ৮ জন নারী ও কিশোরীকে অপহরন করা হয় বলে রিপোর্ট থেকে জানা যায়। তাছাড়া পার্বত্য চুক্তির পুরোটা বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধ্বসের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের অমানবিক জীবন যাপন বিষয়ে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৭ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মানবাধিকার প্রতিবেদন উপস্থাপন ও স্বাগত বক্তব্য রাখেন কাপেং ফাউন্ডেশনের সম্পাদক ও নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সোহেল হাজং। বক্ত্যবের ফাঁকে আগত অংশপগ্রহনকারীদের সাথে এক মুক্ত আলোচনা হয়। সেখানেও বাংলাদেশের আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের নানান ঘটনার কথা আলোচিত হয়।

Back to top button