আদিবাসীদের ভাষা রক্ষার আহবান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক উদযাপন কমিটি
জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক (২০২২-৩২) উপলক্ষে আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক উদযাপন কমিটির উদ্যোগে ২১ মার্চ, সোমবার ঢাকার বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে বিপন্নপ্রায় আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশ ভাবনা বিষয়ক কর্মপরিকল্পনা বিষয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। উক্ত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন উদযাপন কমিটির আহবায়ক এ কে শেরাম এবং সঞ্চালনা করেন সদস্য-সচিব বাঁধন আরেং। সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. সৌরভ সিকদার, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, কবি ও প্রাবন্ধিক থিওফিল নকরেক। প্রধান অতিথি হিসেবে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি রাজশাহীতে একটি বিশেষ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় শেষে অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারেনি।
উপস্থিত বক্তার বলেন এই দশকে আদিবাসী ভাষা রক্ষা ও বিকাশে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সেমিনারে মূল বক্তব্য তোলে ধরেন উদযাপন কমিটির সদস্য সোহেল হাজং তিনি অনুষ্ঠানে উদযাপন কমিটির ১০ বছরের একটি কর্ম-পরিকল্পনা তোলে ধরেন। কর্মসূচিগুলো কয়েকটি উদ্দেশ্য পূরণে করা হয়েছে বলে জানান যার মধ্যে রয়েছে- দেশের বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ আদিবাসী ভাষা রক্ষা; আদিবাসী ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করা; আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় ভাষা, জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সাহিত্যগুলোর চর্চা, সংরক্ষণ ও বিকাশ; আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক ২০২২-২০৩২ এর সময়ব্যাপী আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও বিকাশের অধিকার সুনিশ্চিত করণে পদক্ষেপ গ্রহণ । সরকার ও নীতিনির্ধারকের এ বিষয়ে নীতি নির্ধারণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী করে তোলা; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈচিত্র্যময় আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্যগুলোকে সম্মানজনক ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের (অংশীদারদের) আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবন বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহী করা।
অনেকেই আদিবাসী ভাষা মেলা আয়োজন, ভাষা নিয়ে ক্যাম্পেইন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আদিবাসী ভাষা কোর্স চালু করার পক্ষে অনেকেই জোরালো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বলেন।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য প্রদান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক প্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক উদযাপন কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। তিনি বলেন আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক শুরু হয়ে গেছে আমরা একটু দেরিতে উদ্যোগী হচ্ছি। তিনি এই দশ বছরে দেশের সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আদিবাসী সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে হলেও আদিবাসীদের ভাষা রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণে এগিয়ে আসতে বলেন এবং এই উদযাপন কমিটির সঙ্গে কাজ করার আহবান জানান।
থিওফিল নকরেক বলেন আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এদেশে আদিবাসীদের নানা ভাষাও রয়েছে তাহলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কিভাবে দায় এড়িয়ে যাবে, কেন এই দশককে কেন্দ্র করে এই প্রতিষ্ঠান কোনো কর্মসূচি রাখছে না! সরকারিভাবে মাত্র ৫াট ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও বাকি ভাষাগুলো অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে না । যে ৫টি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়েছে সেটিও ভালভাবে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে না বলেন তিনি। তিনি আরো বলেন, ভাষা নিয়ে এনজিওদের কাজও কমে যাচ্ছে তারা বলছে এখন সব কাজ সরকারকে দিয়ে করানো হচ্ছে!
অধ্যাপক ড. সৌরভ সিকদার বলেন রাষ্ট্র এখনও আদিবাসীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। তিনি প্রশ্ন রাখেন জননেত্রী শেখ হাসিনা যে উদ্দেশ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেটি কি পূরণ হয়েছে? তার কাছে এই প্রতিষ্ঠানকে এখন ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান বলে মনে হয়। কারণ সেখানে মাতৃভাষা ভাষা নিয়ে কাজ করার পরিবেশ নেই বলেন তিনি। এ প্রতিষ্ঠানের নৃবিজ্ঞার সমীক্ষার একটি খন্ডও প্রকাশ করতে পারেনি। তিনি বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডিজেনাস স্টাডি সেন্টার চালু করা প্রয়োজন। ভাষাকে মুখে মুখে চর্চার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ জানান তিনি।
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন রাষ্ট্রকে এটা স্বীকার করে নিতে হবে যে বাংলা ভাষা ছাড়াও এদেশে নানা ভাষা আছে এবং তাদের সংস্কৃতি আছে। আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও তাদের জীবনাচরণ ও জীবন পদ্ধতি রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন রাষ্ট্র যেন আগামীতে আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও শিল্প বিকাশে এগিয়ে আসে।
সভাপতি এ কে শেরাম বলেন বাংলা একাডেমি শুধু বাংলা ভাষার জন্য একাডেমি হয়েছে অন্যান্য ভাষাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ভুলে গেছে। তিনি সকলকে আদিবাসী বান্ধব হয়ে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান।
সেমিনারে নিজ এলাকা ও মাতৃভাষা অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা এবং কর্ম-পরিকল্পনায় পরামর্শ প্রদান করেন যোগেন্দ্র নাথ সরকার, ইয়াংঙান ম্রো, রাজকুমার শাও, রামপ্রসাদ মাহাতো, লিটন দেবসেন, সতেজ চাকমা, মৃদুল সাংমা, সমেন্দ্র সিংহ ও অন্যান্য। অনুষ্ঠানে চাকমা, মারমা, ককবরক, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, মনিপুরী, গারো, হাজং, কোচ, হদি, বর্মন, নাগড়ী, মাল পাহাড়ী, সাদরি, কুড়মালি, তেলি, বাংলা এই ১৭টি ভাষার লোকজন উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে আলোচনা ছাড়াও চাকমা, মনিপুরী, ককবরক ও বাংলা ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করা হয়। থকবিরিম ও আইপিনিজউ অনুষ্ঠানটি সরাসরি ফেসবুক পেইজে প্রচার করে।