জাতীয়

আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা প্রতিবছর আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে

বাংলাদেশের আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সংখ্যায় কম বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী নানান ভাবেই কোনঠাসা হয়ে আছে। প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, নারীদের উপর যৌন সহিংসতা, হত্যা প্রভৃতি কারনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই মানুষগুলো। কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৬ ও ২০১৭ সালের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জানা গেলো আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে দিনকে দিন।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রায় প্রতি বছর সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হতে হয়। কাপেং ফাউন্ডেশনের মানবাধিকার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২০১৬ সালে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে ২ টি আর সমতলে ১ টিসহ মোট ৩ টি। পার্বত্য চট্টগ্রামে সে বছর আলীকদম ও মাটীরাঙায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। তবে গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জে সব থেকে আলোচিত হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে। যে হামলার ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী সরাসরি জড়িত ছিলো। সাহেবগঞ্জে আদিবাসী সাঁওতাল গ্রামে সে হামলায় দুশোর মতন বাড়িঘরে আগুন ও লুটপাট চালানো হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ গুলি চালালে তিনজন মারা যায়। ২০১৭ তে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা আগের বছরের তুলনায় বেশি। এ বছর আদিবাসীদের উপর ৫ টি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে পাহাড়ে ৩ টি আর সমতলে ২ টি। হামলাগুলো লংগদু, লক্ষিছড়ি, রামগড়, মধুখালী-ফরিদপুর আর রাজশাহীর গোদাগারিতে হয়। লংগদুর ঘটনায় আড়াইশটির মতন ঘরবাড়িতে আগুনে জ্বালিয়ে দেয় সেটেলার বাঙালিরা। সেখানে লুটপাট চালানো হয় এবং একজন আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায়। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় প্রশাসনকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় প্রতিবছরই। কোন কোন ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদ দিতে দেখা গেছে এ সব সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায়।
২০১৬ তে হত্যাকান্ডের শিকার হয় ১৭ জন আদিবাসী। যার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১ জন ও সমতলে ৬ জন রয়েছে। সে বছর গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মের আলোচিত হামলার ঘটনায় পুলিশের গুলিতে মারা যায় রমেশ সরেন, মঙ্গল মার্ডি আর শ্যামল হেমব্রম। ২০১৭ সালে হত্যাকান্ডের শিকার হয় ১০ জন আদিবাসী। যার মধ্যে অন্যতম যৌথবাহিনীর অত্যাচারে মারা যাওয়া রাঙামাটির নান্যাচরের এসএসসি পরিক্ষার্থী রমেল চাকমা রয়েছে।
বাংলাদেশে বিশেষভাবে নারীদের উপর যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণের ঘটনা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আদিবাসী নারীদের উপর যৌন সহিংসতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে বলে তাদের মানবাধিকার রিপোর্টে জানিয়েছে কাপেং ফাউন্ডেশন। ২০১৬ সালে আদিবাসী নারীদের উপর যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটে ৫৩ টি। এসব ঘটনায় নির্যাতনের শিকার হন ৫৮ জন নারী যার মধ্যে পাহাড়ে ৩০ জন আর সমতলে ২৮ জন। সে বছর ধর্ষণ ১৬ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৯ টি যার শিকার ২৬ জন আদিবাসী নারী । ৬ জনকে ধর্ষণ পরবর্তীতে হত্যা করা হয়। তাছাড়া ২০১৬ তে ৫ টি ঘটনায় ৬ নারী অপহরনের শিকার হয় বলে রিপোর্ট থেকে জানা যায়। এসব ঘটনায় প্রশাসনের অসহযোগীতার কথা বলা আছে কাপেং ফাউন্ডেশনের মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৬ তে। ২০১৭ তে ৪৮ টি ঘটনায় মোট ৫৮ জন নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়। ১২ টি ধর্ষণ ও ৪ টি গণধর্ষণের ঘটনায় ১৬ জন নারী শিকার হয় তার মধ্যে ধর্ষণের পর ৯ জনকে মেরে ফেলা হয়। এবছর অপহরনের শিকার হয় ৮ জন। ২০১৭র মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয় ধর্ষণের শিকার বেশিরভাগের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের বসত-ভিটা থেকে তাদের আবাদী জমি থেকে প্রতিনিয়িত উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের ১৫৪২৯.৯৮ একরের উপর জমি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নামে, বিশেষ পর্যটন কেন্দ্রের নামে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নামে দখল করে। ভূমি দখলের ফলে ১২১৬ পরিবার উচ্ছেদের শিকার হয়। সে বছর ভূমি দখলের জন্য আদিবাসীদের ১৭ বাড়িঘরে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়, ৩৭ নারী ভূমি সংক্রান্ত ব্যাপারে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু ঘটনার সাথে জড়িত হোতারা শাস্তির বাইরে থেকে গেছে। এছাড়া এ বছর বান্দরবনের লামায় রাবার বাগান ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষের থেকে স্থানীয় আদীবাসীদের জুম চাষে বাধা দেয়া হয়, বগালেক থেকে থেকে ৩১ টি বম পরিবারকে উচ্ছেদের নোটিশ দেয়া হয়। তাছাড়া সীমান্ত রক্ষার নামে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২৫ একরের বেশি ভূমি দখল করে বলে জানা যায় ২০১৬ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে। এদিকে ২০১৭ সালে এসে আদিবাসীদের ১৯,৯৪০ একর ভূমি দখল ও দখলি প্রক্রিয়ায় রয়েছে। যার মধ্যে ১১,৬০০ একর সমতলে আর ৮,৩৩৯ একর পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে বলে জানা যায়। কমপক্ষে ১২,১৯৫ পরিবার ভূমি থেকে উচ্ছেদের আশঙ্কায় রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজিবির জন্য আদিবাসীদের প্রায় ১০৯০.৮ একর ভূমি অধিগ্রহন করা হয় বলে মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৭ তে প্রকাশ করা হয়।
এ বিষয় গুলো নিয়ে কথা আইপি নিউজের সাথে কথা বললেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং । তিনি বলেন, দিনকে দিন আমরা দেখতে পাচ্ছি আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বাড়ছে হত্যা, ভূমিদখল, নির্যাতন, নারী ও শিশুর উপর যৌন সহিংসতা। উদ্বেগের বিষয় হলো আদিবাসীদের উপর হওয়া মানবাধিকার লংঘনের যথাযথ বিচার পাওয়া যাচ্ছেনা। কাপেং ফাউন্ডেশন যে আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট দিচ্ছে প্রতিবছর সরকারের উচিৎ তা আমলে নিয়ে বিশেষ ব্যাবস্থা গ্রহন করা, যাতে আদিবাসীদের মানবাধিকার সহ প্রান্তিক মানুষের মানবাধিকার রক্ষিত হয়। আর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে আহব্বান আদিবাসীদের মানবাধিকার প্রশ্নে বিশেষভাবে কাজ করা।
এ বিষয়ে কাপেং ফাউন্ডেশনের সম্পাদক ও নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় কিছুদিন খুব শোরগোল হয় কিন্তু সে ঘটনার যথাযথ বিচার বা সমাধান পাওয়া যায়না। যারা মানবাধিকার লংঘনের মতন কাজে জড়িত তাদের কোন শাস্তি হয়না তারা আইনের বাইরে থেকে যায়। তারা কোন না কোন ভাবে প্রশাসনিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। আমরা প্রত্যশা করতাম এখনো করি যে আমাদের রিপোর্ট সরকার আমলে নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিবে। কিন্তু বাস্তবে সরকার আমাদের রিপোর্ট আমলে নেন না বলেই মনে হয় যা দুঃখজনক।
তিনি আরো বলেন আদিবাসীদের উপর ঘটা বেশিরভাগ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ভূমি কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। ভূমি থেকে উচ্ছেদের জন্যই হত্যা, নারীদের উপর যৌন সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক হামলা হয়ে থাকে। সরকার যদি ভূমি সমস্যার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় তবে হয়তো আদিবাসীদের উপর হওয়া মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা কমে যেতো।
উল্লেখ্য মার্চের ২৯ তারিখ কাপেং ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৭ প্রকাশ করে।

Back to top button