অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সমতলের আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতসহ ১১ দফা দাবি
আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন এবং আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশ ও মিছিল করেছে আদিবাসীরা।
সমতলের ছাত্র-যুব ও সাধারণ জনগণের ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করেছে আদিবাসী নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশে লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, বাংলাদেশ বহুত্ববাদী দেশ। এ দেশে বাঙালি ছাড়াও বহু ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের বসবাস। বিভিন্ন স্থানে উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের হত্যার বিচার করতে হবে। আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশনসহ ন্যায্য দাবিসমূহ না মানলে সমতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবেনা।
কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এর সদস্য ফারহা তানজিম তিতিল বলেন, সংখ্যালঘু শব্দ একটি বৈষম্যমূলক শব্দ। সংখ্যা দিয়ে মানুষকে বিচার করা যাবেনা। আদিবাসী কিংবা প্রান্তিক মানুষ প্রত্যেককে তার সকল নাগরিক অধিকার এবং মর্যাদা দিতে হবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন, সরকার বিভিন্ন সময় আদিবাসীদের জন্য নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটেনি। আমরা আর কোন প্রতিশ্রুতি চাইনা, আমরা চাই বাস্তবায়ন। নতুন যে বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্ন দেখছি সেখানে সমতলের আদিবাসীদের বাদ দিয়ে কখনো সম্ভব নয়। বর্তমান আন্তর্বতীকালীন সরকারে সমতল থেকে একজন প্রতিনিধি রাখতে হবে এবং আজকের ১১ দফা দাবি মানতে হবে। না হলে অতীতের মত সমতলের আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা হবেনা।
কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী আদিবাসীদের উপর হুমকি ও হামলার ঘটনা ঘটছে। দিনাজপুরে সিধু কানুর ভাস্কর্য ভাংচুর করা হয়েছে। আমরা এসকল ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। সমতার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক পরিচয়সহ ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠিত না করলে আদিবাসীরা আগের মতই বঞ্চিত থেকে যাবে। এ বঞ্চনার অবসান হোক।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল আজিম বলেন, আদিবাসীরা সুদীর্ঘকাল ধরে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। আদিবাসীরা দীর্ঘদিন শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। যার ফলে আদিবাসীদের নিজস্ব রীতিনীতি ও সংস্কৃতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পরেছে। আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি সহ প্রথাগত অধিকার দিতে হবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট প্রভাত টুডু বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি হলো সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন। আন্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে দেশের আদিবাসীদের উপর ঘটে যাওয়া সকল হত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদের সকল ঘটনার সুষ্ঠু বিচার প্রত্যাশা করছি।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় তথ্য প্রচার সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা, আদিবাসী ফোরামের ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং, আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য রিপন চন্দ্র বানাই, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য বিষুরাম মুর্মু, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি আন্তনী রেমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সদস্য শান্ত সরেন, গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রতিনিধি সতীর্থ চিরান, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন এর ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি ডন যেত্রা, গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশন এর কেন্দ্রীয় সদস্য ব্রলিন দফো প্রমুখ।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, বায়ন্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলনে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত পঞ্চাশ বছরে সরকার বদল হলেও আদিবাসীদের ভাগ্যের বদল ঘটেনি। আমরা আদিবাসীদের সকল শোষণ ও বঞ্চনার অবসান চাই।
সমাবেশে সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি টনি চিরান। মূল বক্তব্য ও দাবিসমূহ পাঠ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সদস্য টুম্পা হাজং।
সমাবেশ শেষে আদিবাসীরা একটি মিছিল রাজু ভাস্কর্য থেকে শাহবাগ মোড় হয়ে স্বৌপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে এসে শেষ হয় এবং আগামী ১৬ আগস্ট রোজ শুক্রবার বিকাল ৩ টায় আদিবাসী সাংস্কৃতিক শোভাযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
সমাবেশ থেকে নিম্বলিখিত দাবিসমূহ জানানো হয়-
১। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
২। অন্তর্বতীকালীন সরকারে সমতল অঞ্চলের আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৩। বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
৪। আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৫। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করতে হবে।
৬। সমতলের আদিবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থ-সামাজিক ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রেখে বিশেষ ব্যাবস্থা (মনিটরিং সেল অথবা বোর্ড গঠন) করতে হবে।
৭। সমতলের আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার্থে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৮। উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের ভূমি অধিগ্রহণ, বেদখল ও উচ্ছেদ বন্ধ, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, সকল আদিবাসী হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৯। সমতল অঞ্চলের আদিবাসী ছাত্র-যুবদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১০। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
১১। আদিবাসী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং ১৯২৭ সালের বন আইন সংশোধন করতে হবে।