অনগ্রসর শ্রেণী কতটুকু অগ্রসর: কোটা বাতিলের যৌক্তিকতা
মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ১৩ আগস্ট, ২০১৮ একটি সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন দেশের জাতিগত সংখ্যালঘু (ethnic minority) শ্রেণী এখন আর পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে বর্তমানে ২৭২,৫৫৯ জন কর্মকর্তা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কর্মরত। একটি সহজ গাণিতিক হিসাব বলে দেয়, দেশে প্রতি ১০,০০০ (দশ হাজার) জনগোষ্ঠীর জন্য রয়েছে সতের জন প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা । যুক্তির খাতিরে মন্ত্রীপরিষদ সচিব-এর দাবিকে সত্য মেনে নিলে, ২০১১ সালের শুমারি জরিপ অনুসারে দেশের মোট জনসংখ্যার ১.৮% জাতিগত সংখ্যালঘুর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা থাকার কথা। কিন্তু আদতে ৫০০ আছে বলে আমাদের মনে হয় না। একইভাবে, প্রায় চার লক্ষাধিক সান্তাল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ৬৮০ জন প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি অফিসার থাকার কথা । কিন্তু আমাদের জানা মতে সান্তাল জাতিগোষ্ঠী হতে অনোধিক ১৫ জন বিসিএস ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা আছেন। তাই দেশের পিছিয়ে পড়া অবাঙালি জাতিগত সংখ্যালঘু শ্রেণীর মানুষ সরকারি চাকরিতে- বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে মূলধারার জনগোষ্ঠীর তুলনায় এতটাই পিছিয়ে আছে যে মাননীয় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কোটা পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ নিয়ে জনগণ প্রশ্ন তুলতে-ই পারে। আমাদের অবাক করেছে, সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রীপরিষদ সচিব যখন দাবি করেন – তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছেন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এখন অনেক অগ্রসর হয়েছে। উল্লেখিত আনুপাতিক পরিসংখ্যান কোন ভাবেই প্রমাণ করে না যে, জাতিগত সংখ্যালঘু শ্রেণীর মানুষ এখন অগ্রসর। সরকার গঠিত কোটা পর্যালোচনা কমিটি যেহেতু কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ সংক্রান্ত কোটা পর্যালোচনার জন্য আদিষ্ট হয়েছেন, আমরা ধরে নিতে পারি জনসংখ্যার আনুপাতিক বিশ্লেষণ এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভিত্তি। ১৯৮৫ সালে যে সকল আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ৫% কোটা বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা শুরু করা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতেও সে সব সমানভাবে প্রযোজ্য। ১৯৮৮ সালে অবাঙালি জাতিসত্তার একজন ত্রিপুরা ছেলেকে যেভাবে অপরিচয়ের বাধা, ভাষার প্রতিবন্ধকতা আর জানা অজানা সীমাহীন গ্লানি সহ্য করে মূলধারায় আসতে হয়েছিল, আজকে ২০১৮ সালেও একজন গারো ছেলে বা একজন মারমা মেয়ে সীমাহীন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন কাটায়, টিকে থাকার স্বপ্ন দেখে।
ই. ব্রাউন তার “এথনিক মাইনরিটি পাবলিক সেক্টর এম্পয়মেন্ট” নামক প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশ যেমন, ভারত, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির উপর আলোকপাত করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে, ভারতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ৫০ শতাংশ কোটা সরকারি চাকরিতে বরাদ্দ রয়েছে। তফশিলী জাতি বা Scheduled Castes এর জন্য ১৫ শতাংশ, তফশিলী উপজাতি বা Scheduled Tribes এর জন্য ৭.৫ শতাংশ, এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতি বা Other Backward Castes এর জন্য ২৭ শতাংশ। ২০০৩ সালে, ভারতে সরকারি কর্মক্ষেত্রে Scheduled Castes এর হার ছিল ১৭ শতাংশ ও Scheduled Tribes এর হার ছিল ৬.৪ শতাংশ। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৫ সালে একটি শ্বেতপত্র ঘোষণা করে যে, সরকারের সকল অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনার পর্যায়ে পরবর্তী ৪ বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ কালো জনগোষ্ঠীর কর্মী অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। সে অনুযায়ী ২০০৪ সালে দেখা যায় যে, কালো জনগোষ্ঠীর ৬৪ শতাংশ ব্যাবস্থাপকের পদ দখল করে নেয়। তেমনি ভাবে, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও অস্ট্রেলিয়াও নিজ নিজ দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে অগ্রসরতা দান করার জন্য বিভিন্ন নীতি অবলম্বন করে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার সরকার কেবল সরকারি কর্মক্ষেত্রেই নয়, বেসরকারি কর্মক্ষেত্রেও সেখানকার আদিবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করণের জন্য নীতিমালা গ্রহণ করেছে। যেখানে উন্নত দেশগুলোই এখনও তাদের পিছিয়ে পড়া একাংশ জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য এখনও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি চালু রেখেছে, সেক্ষেত্রে আমাদের মত দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠির জন্য এটি কতটুকু প্রয়োজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অনেকেই যুক্তি দিয়ে থাকেন, জাতিগত সংখ্যালঘু কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্র্মকর্তারা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের থেকে কম দক্ষ হয় ও তাদের কারণে সরকারের সেবার মান ভাল হয় না। বিসিএস নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় পাশ করা চাকরীপ্রার্থীদের মেধা তালিকার ভিত্তিতে মৌখিক পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর যারা মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত টিকে যায়, তাদের কোনভাবেই অন্যান্য চাকরীপ্রার্থীদের তুলনায় অযোগ্য বিবেচনা করার উপায় নেই। বরং সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রার্থীরা যে জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাধারণ প্রার্থীদের সাথে পাল্লা দিয়ে বিসিএস সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম লেখায়- তাদের পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী মানসিকতার তুলনা হয় না। ছোটবেলা থেকে যে জীবন দর্শন আর সাংস্কৃতিক আবহের মধ্য দিয়ে একজন খুমি ছেলে বড় হয়, জীবনের প্রয়োজনে মূলধারায় মিশে যেতে গিয়ে তাকে বাঙালি-অবাঙালি জীবনাচরণের গ্রহণ-বর্জনের বিশাল দ্বান্দ্বিক অবস্থার ভিতর দিন পার করতে হয়। এখানে ভাষা, জীবন-দর্শন আর নিয়ম-নৈতিকতার হিসেব- সব কিছু-ই জাতি রাষ্ট্রের; খুমি ছেলেটি নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে কঠোর পরিশ্রম করে টিকে থাকে। এত সীমাহীন বাধার মাঝেও, সেই খুমি ছেলে যখন বিপুল প্রতিযোগিতার পর বিসিএস প্রিলিমিনারি’তে টিকে যায়, লিখিত পরীক্ষায় টিকে গিয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েও যদি বাংলা একটু কম বোঝার কারণে বা বাঙালি জীবণাচরণ কম উপলব্ধি করতে পারার কারণে তার স্বপ্নের সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয় তখন রাষ্ট্রীয় ন্যায় বিচারের ধারণা অমূলক হয়ে যাবে। মানুষে মানুষে সামাজিক- অর্থনৈতিক সাম্য (Equity) প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক ঘোষণা অর্থহীন হয়ে যাবে।
একটি বিষয় হয়ত অনেককে-ই অবাক করে, যে সব যুক্তির উপর ভিত্তি করে আমরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে জএিসপি (Generalised Scheme of Preferences))’এর সুবিধা নিই বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জএিসপি (Generalized System of Preferences)-এর সুবিধা পেতে চাই সেই সব যুক্তি দেশের অভ্যন্তরে চর্চা করতে চাই না। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর দাড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ রাষ্ট্র কোনভাবেই পিছিয়ে পড়া জাতিগত সংখ্যালঘুদের আরো পিছিয়ে রেখে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আশা করতে পারে না। সংবিধানে গৃহীত নির্দেশনা অনুসারে জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ বিধানের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই বিধানের ছোট একটি অংশ সরকারি চাকরিতে ৫% কোটা। সেটিও যদি সরকার কেড়ে নেয় তাহলে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী আরো প্রান্তিক হবে, হাজার হাজার সান্তাল, ওঁরাও মুন্ডা আশাহত হবে।
জাতিগত বৈচিত্র্য কত সুন্দর ও শক্তিশালী হতে পারে তার ভালো একটা উদাহারণ হলো বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৬ মহিলা ফুটবল দল। বলার অপেক্ষা রাখে না একসময় দু-বেলা ভাত খেতে না পারা মারিয়া মান্দা’র নেতৃত্বে অনূর্ধ্ব ১৬ মহিলা ফুটবল দল বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। একদিকে শিউলি আজিম, আনাই মগিনি, মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, আনুচিং মগিনি’র মত কম কথা বলা অবাঙালি মেয়েরা অন্যদিকে তহুরা, মার্জিয়া, সানজিদা’দের যুথবদ্ধতার শৈলী প্রমাণ করেছে বৈচিত্র্য ও সাম্য দলের জন্য শক্তি বাড়ায়, সাফল্য নিয়ে আসে। অন্যদিকে, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এই দেশে কোটা পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ অনুসারে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সরকারি চাকরিতে কোটায় নিয়োগের বিধান বাতিল হলে জনপ্রশাসনে যে পরিমাণ পেশাগত বৈচিত্র্য বিদ্যমান তা আশঙ্কাজনক ভাবে কমে যেতে পারে- যার ফলে সরকারের ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় ‘তুলনামূলক সুবিধা’ পেতে সরকারের নেয়া কৌশল বাধাগ্রস্থ হতে পারে।
কোটা কোন চিরন্তন ব্যবস্থা নয়। কিন্তু কোন প্রকার বিশদ উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদী কোন সরকারি পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া-ই হঠাৎ করে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ঘোষণা মন্ত্রীসভা অনুমোদন করলে, সেটি যেমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিচয় বহন করবে, তেমনি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষকে অতিমাত্রায় বঞ্চিত করবে। তাই কোটা পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ স্থগিত রেখে, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে একটি নির্দিষ্ট সময় (আগামি ২০ বছর বা ৩০ বছর বা ততোধিক) পর্যন্ত জাতিগত সংখ্যালঘু শ্রেণীর জন্য কোটা বহাল রাখার সরকারি ঘোষণা, একটি জনবান্ধব ও সুবিবেচনাপ্রসূত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অনিত্য মানখিন_ উন্নয়ন গবেষক’ ইমেইলঃ- [email protected]
ম্যাগনেট জাম্বিল_উন্নয়ন কর্মী।
বি: দ্র: এক সপ্তাহ আগে লেখা যা দু – তিনটি জাতীয় পত্রিকা অজানা কারণে প্রকাশ করেনি।