অক্টোবর বিপ্লব শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রগতিশীল নারী সংগঠনসমূহের সমাবেশ
১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর মানব জাতির ইতিহাসে এ যাবৎকালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল। এই বিপ্লব পৃথিবীর বুকে সূচনা করেছিল সমাজ বিকাশের এক নতুন পর্যায়। মহামতি কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে সংঘটিত এ বিপ্লবের রাজনৈতিক দার্শনিক ভিত্তি ছিল মার্কসবাদ। এ বছর ২০১৭ তে দুনিয়াব্যাপী কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীদল, কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষের সংগঠন, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহ, নারীমুক্তি আন্দোলনের শক্তিগুলো মহান অক্টোবর বিপ্লবের শততম বার্ষিকী পালন করছে। বাংলাদেশে নারীমুক্তির প্রশ্নে প্রগতিশীল নারীসংগঠনসমূহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এই সকল কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৩ অক্টোবর ২০১৭ সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে ‘ব্যক্তি মালিকানার পৃথিবীকে বদলে দিয়ে সামাজিক মালিকানার মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলুন এবং নারীর প্রতি শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন ও সহিংসতা রুখে দাঁড়ান’ এই দু’টি শ্লোগানকে সামনে রেখে জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে নারীমুক্তির প্রশ্নে প্রগতিশীল নারী সংগঠনমূহের যৌথ উদ্যোগে অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উপলক্ষে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মসুচির উদ্বোধন করেন অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন প্রগতিশীল নারী সংগঠনসমূহের সমন্বয়কারী লক্ষী চক্রবর্তী। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন প্রগতিশীল নারী সংগঠনসমুহের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। উদ্বোধনী সমাবেশ শেষে একটি র্যালি জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে কদম ফোয়ারা হয়ে পল্টন মোড়ে সমাপ্ত হয়
র্যালি ও সমাবেশ শেষে ‘অক্টোবর বিপ্লব ও নারীমুক্তি আন্দোলন: প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য’ শীর্ষক সেমিনার মুক্তি ভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে সকাল ১১ টায় অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন প্রগতিশীল নারী সংগঠনসমূহের সমন্বয়কারী লক্ষী চক্রবর্তী এবং প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শ্রমজীবী নারীমৈত্রীর কেন্দ্রীয় কমিটির আহবায়ক বহ্নিশিখা জামালী। সেমিনার পরিচালনা করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিপিবি কেন্দ্রীয় নারী সেলের সদস্য লূনা নূর, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সীমা দত্ত, নারী সংহতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা চন্দ, বিপ্লবী নারী ফোরামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহবায়ক আনিকা তাসনীম মিতু, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিরূপা চাকমা।
র্যালির উদ্বোধক ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা আজকে যে সমাজে বাস করছি সেখানে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, শিশুরা ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় নারী ও শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন ছিল না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ফলে এখানে যে নারী সর্বোচ্চ পদ লাভ করে সে পিতৃতন্ত্রের শিকার হয়। সমাজতন্ত্র এই পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। আমাদের সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। শোষণ বন্ধ হয়নি। অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষে আমরা শোষণমুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত রাখব, শোষণ মুক্তির লড়াই চলবে।
সেমিনারের প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি আরো বলেন, সমাজবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীদের অবস্থা বিভিন্ন রকম ছিল। আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ছিল। মানুষ ফলমূল সংগ্রহ করে খেত। ব্যক্তিগত কোনো সম্পত্তি তখন ছিল না। অত্যন্ত হীন দারিদ্র্য অবস্থায় তারা ছিল। সে অবস্থা থেকে সমাজ এগিয়েছে। দাস-সামন্ত-পুুঁজিবাদ এই তিনটি সমাজব্যাবস্থার মধ্যে ঐক্য আছে। এই সমাজবস্থাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করে। সম্পত্তি রক্ষার জন্য মানুষের উপর শোষণ-অত্যাচার নির্যাতন করে। এর ভয়াবহ শিকার হয়। সব সমাজব্যবস্থা চলে গেছে, হুকুম চলে গেল, হাকিম চলে গেল কিন্তু শোষণ বহাল থাকল। অক্টোবর বিপ্লব সেই শোষণের বিরুদ্ধে রাশিয়াতে বিপ্লব সংঘটিত করেছিল। ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ করে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিল। সমাজতন্ত্রের পতন হয়নি। সমাজতন্ত্রের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তন করেছে। পুঁজিবাদ ছলে-বলে-কৌশলে কাজ করে। সেখান থেকে তারা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে এসেছে। পুঁজিবাদী দেশগুলো বিভিন্ন দেশ শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। সেই সম্পদ থেকে কিছু উচ্ছিষ্ট শ্রমিকদের দেয়, কিছু সুবিধা দেয়। এই হলো কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ছলে-বলে -কৌশলে পুঁজিবাদ তার শাসকে ঠিকে রাখছে। মায়ানমারের শাসক অং সান সুচি নিকৃষ্টতম শাসক হিসেবে মায়ানমারের সেনাবাহিনীকে মদদ দিচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গা নারীরা গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এই গণধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তার নেতৃত্বে। বাংলাদেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকবাহিনী নারী ধর্ষণ করেছে। দুই লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও আজ নারী ধর্ষণ-গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের নারীরা নির্মম-নৃশংস নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সুরাইয়া জাহান রূপা কিভাবে নৃশংস নির্যাতন-ধর্ষণের শিকার হলো। জীবনযুদ্ধ করে সেই রূপা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাকে কেউ সহযোগিতা করেনি। হেলপার-ড্রাইভার-সুপারভাইজার সকলে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণকারীদের সাহায্য করেছে। জাহাঙ্গীর নগরে শত ধর্ষণের কথা আমরা জানি। এভাবে সারাদেশে ধর্ষণ-নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে।
নারীদেরকে নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। আইনে তাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। দায়মুক্ত হওয়ার জন্য বাবা-মা এই বাল্যবিবাহকে মেনে নিচ্ছে। বাবার সামনে কন্যা খুন হচ্ছে। কিশোরীরা আত্মহত্যা করছে। এই হলো আমাদের দেশের নারীদের পরিস্থিতি। বিউটি কনটেষ্ট হচ্ছে-এটি হলো ভোগবাদ। পুঁজিবাদ এই ভোগবাদকে উস্কে দিচ্ছে। নারীকে কত সুন্দরভাবে পুরুষের সামনে উস্থাপন করা যায় তার জন্য এই প্রতিযোগিতা।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় এসেছে। তারা ক্ষমতাশীল হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে রাষ্ট প্রতিষ্ঠা করলাম সে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। বড় রাষ্ট ভেঙ্গে ছোট রাষ্ট হয়েছে। ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়েছে, পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ হয়েছে। মুক্তিুদ্ধে ২ লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরবর্র্তীতে রাষ্ট্র তাদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছে। সেই উপাধি পরবর্তীতে তাদের জন্য অসম্মানের প্রতীক হয়েছে। এ ছিল ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। এই বীরাঙ্গনা উপাধি প্রমাণ করে তাদের প্রতি রাষ্টের দৃষ্টিভঙ্গি।
আমরা যে লড়াই করছি তা একটি রাজনৈতিক লড়াই। অক্টোবর বিপ্লবও একটি রাজনৈতিক লড়াই। সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল তা ছিল একটি সামাজিক বিপ্লব। বিপ্লব হলো পুরানো রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে চুর্ণবিচূর্ন করা। বিপ্লবের পর লেনিন তাই ক্ষমতার বিকেন্দীকরনের ডাক দিয়েছিলেন। সমস্ত ক্ষমতা ছিল সোভিয়েতের হাতে। সোভিয়েত ছিল জনগণের হাতে। যে সময়ে আমরা অক্টোবর বিপ্লব পালন করছি, সেই সময়ে পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদের রূপ নিয়েছে। এই ফ্যাসিবাদকে উচ্ছেদ করতে হলে রাজনৈতিক লড়াই প্রয়োজন।
রেনেসাঁ মানুষকে মুক্ত করেছিল ধর্মের আধিপত্য থেকে। এই রেনেসাঁর মাধ্যমেও মানবমুক্তি ঘটেছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। ফরাসী বিপ্লব হয়েছে। তাও কার্যকর হয়নি। কারণ শ্রেণি বহাল ছিল। অক্টোবর বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল শ্রেণি ভাঙ্গার জন্য। আর রাষ্ট্র বিপ্লব হলেই বিপ্লব হয়ে যাব না। তাকে ধরে রাখতে হবে। সোভিয়েত তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতা যেন পুঁজিবাদীদের হাতে চলে না যায় তার জন্য সংগ্রাম জারি রাখতে হবে।
সেমিনারের সভাপতি লক্ষী চক্রবর্তী বলেন, আমরা আজ অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদ্যাপন করছি অন্ধকার থেকে আলোরপ থেকে আলোর পথে এগুনোর জন্য। বাংলাদেশের নারীরা যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্রের পথেই নারীমুক্তি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সেমিনারে নারীনেত্রীবৃন্দ বলেন, নারীমুক্তির লড়াই একটি রাজনৈতিক লড়াই। রাজনৈতিক মতাদর্শ, নারীর প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিই মূরত নির্ধারণ করে সমাজে বা রাষ্ট্রে নারীর অবস্থান কি হবে। কাজেই প্রকৃত অর্থে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে । সেই লড়াইকে বেগবান করতে সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে প্রকৃত অর্থে সমাজতান্ত্রিক ধারার নারী আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনায় আজকে আমরা সারা দেশের নারী সমাজকে আহ্বান জানাতে চাই-আসুন, নারীর প্রতি সকল প্রকার শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন সহিংসতা রোধে সমাজতান্ত্রিক ধারার নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হই, নারীমুক্তির পথকে প্রশস্ত করি।