জাতীয়

৫২’র ব্যতিক্রমী ভাষা সৈনিক আদিবাসী উসুয়ে হাওলাদার

শ্যাম সাগর মানকিন; ২০ ফেব্রুয়ারি; ঢাকাঃ রক্তের বিনিময়ে মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারী । ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই বঞ্চিত ও শোষিত পূর্ব-পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য ১৯৪৭ সাল থেকে যে সংগ্রাম শুরু করে তা বিভিন্ন চড়াই উতরাই পেরিয়ে চূড়ান্তরূপ লাভ করেছিল ১৯৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারী । পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের ব্যবহারিক ভাষা “বাংলা”র বদলে “উর্দূ”কে রাষ্ট্রীয় তথা দাপ্তরিক ভাষা করার ঘোষণা দেয় পাকিস্তান সরকার। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে পূর্ব বাংলা। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে নামে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের ঢল। পুলিশ-ইপিআর গুলি চালালে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউল প্রমুখ।

এসময় সারা বাংলাতেই ছাত্র-জনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলো । তেমন একজন ভাষা সৈনিক রাখাইন আদিবাসী উসুয়ে হাওলাদার । অভিজাত রাখাইন পরিবারের সন্তান উসুয়ে হাওলাদার কুড়ি বছর বয়সে বাংলার ভাষার স্বীকৃতি দাবীতে জীবন বাজি রেখে বরিশালের রাজপথে নেমেছিলেন। উসুয়ে হাওলাদারের জন্ম ১৯৩২ সনের সাত ডিসেম্বর । বরিশালের পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের ফেলাবুনিয়া গ্রামের ছাতিয়ানপাড়ায় এক অভিজাত রাখাইন পরিবারে । ইউনিয়ন বোর্ড মেম্বার ও তত্কালীন বরিশাল জজ কোর্টের জুরি বোর্ড মেম্বার প্রুহ্লাউ হাওলাদার ও চাঁনতাপ্রু হাওলাদারের চার ছেলে দুই মেয়ে সন্তানের সবার বড় ছেলে ছিলেন তিনি। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ শেষে বরিশাল ব্যাপটিস্ট মিশন স্কুল থেকে ১৯৫৩ সনে মেট্রিকুলেশন (এস.এস.সি) পাশ করেন।

১৯৫২ সালে বরিশাল ব্যাপটিস্ট মিশন স্কুলের মেট্রিকুলেশনের ছাত্র থাকাকালীন আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন । সে সময় স্কুলে কড়াকড়ি থাকা সত্বেও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে জিলা স্কুলের ছাত্রদের সাথে মিছিল সমাবেশে অংশ নিতেন নিয়মিত । বরিশাল অশ্বনী কুমার হলের সামনে বড় বড় সমাবেশ হত । বাঙালি না হযেও মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে এসব প্রতিবাদী মিছিল-সমাবেশে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন । সবার সাথে সমান জোরগলায় স্লোগান তুলেছেন উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করা চলবে না! তোমার-আমার-ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা! সাংবাদিক বিপ্লব রহমানের সাথে এক কথোপকথনে তিনি ভাষা আন্দোলনে তার যুক্ততা নিয়ে কথা বলেন। তার ভাষ্যমতে, “বাঙালি না হয়েও সে সময় রাখাইন আদিবাসী ছাত্র হিসেবে আমি বুঝেছিলাম, উর্দূকে পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হলে শুধু বাঙালিরাই বিপদে পড়বে তাই নয়, এই রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে আমরা আদিবাসীরাও শেষ পর্যন্ত কেউই বাদ যাবো না। তাছাড়া মন থেকে এতো বড়ো একটি নিপীড়নমূলক ষড়যন্ত্র আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই স্কুল পালিয়ে জিলা স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে মিছিল-সমাবেশে নিয়মিত অংশ নিতাম ।“

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে এক বছর শিক্ষা জীবন ব্যাহত হলে ১৯৫২-র পরিবর্তে তিনি ১৯৫৩ সনে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরের বছর সরকারি ব্রজমোহন কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু সারাদিন রাজনীতি আর মানুষের মুক্তির সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ায় পড়াশোনা আর এগোয় নি। যার দেহে ভাষা আন্দোলনের ছোঁয়া তার কি আর ক্লাসে মন বসে? দেশ তখন স্বায়ত্ত্বশাসন ও ভাষার দাবিতে উত্তাল। যুবক উসুয়ে হাওলাদার নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন রাজনীতির সঙ্গে। ১৯৫৬ সালে তার পিতা খেপুপাড়ায় স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি এতে যোগ দিয়ে সরাসরি রাজনীতিতে নাম লেখান। তখন বরিশাল ন্যাপের সভাপতি ছিলেন আ. রব সেরনিয়াবাত ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফ হোসেন। এই সময় তিনি যুবলীগের এমাদুল্লাহ, আ. করিম, নিখিল সেন, মহিউদ্দিন আহম্মদের মত রাজনীতিকদের সংস্পর্শে আসেন এবং নিজের রাজনৈতিক জীবন সমৃদ্ধ করেন। পরবর্তীতে আইউব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর প্রার্থী হিসেবে । ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তালতলীতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে জনমত সংগঠন ও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ সাহায্য সহযোগিতা করেন তিনি।

উসুয়ে হাওলাদার দেশ স্বাধীন পরবর্তী সময়ে কাজ করে গেছেন সমাজের জন্য । রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি স্থানীয় উন্নয়নের জন্য এবং বিশেষ করে রাখাইন সম্প্রদায়ের সার্বিক কল্যাণে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার । এ জন্য তিনি রাখাইন সমাজকল্যাণ সমিতি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। আমৃত্যু তিনি এ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। রাখাইন ছেলে মেয়েরা যাতে নিজের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তার জন্য কাজ করে গেছেন । নিজ অঞ্চলের কলাপাড়া, কুয়াকাটা, আমখোলা, মিশ্রীপাড়া, কালাচানপাড়া, তালতলিপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, কবিরাজপাড়া, সদাগরপাড়া ইত্যাদি রাখাইন অধ্যুষিত কিয়াঙগুলোতে রাখাইনভাষার স্কুল চালু করেছিলেন। ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও প্রগতিবাদী রাজনৈতিক আদিবাসী রাখাইন নেতা উসুয়ে হাওলাদার ২০১৫ সালের ১ জুলাই কলাপাড়া পৌরশহরের বৌদ্ধবিহার সংলগ্ন নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন ।

Back to top button