১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বাতিলের ষড়যন্ত্র বন্ধের দাবিতে ঢাবিতে মানববন্ধন
আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বাতিলের ষড়যন্ত্র বন্ধ এবং উক্ত শাসনবিধি বহাল রাখার দাবিতে আজ বুধবার (১০ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটিতে রাজুভাস্কর্যে ঢাকাস্থ জুম্ম শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের আয়োজনে এক মানববন্ধন আয়োজন করা হয়।
উক্ত মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকাস্থ জুম্ম নাগরিক সমাজের সিনিয়র প্রতিনিধি ও অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডাক্তার অজয় চাকমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ঢাকাস্থ জুম্ম নাগরিক সমাজের তরুণ প্রতিনিধি সতেজ চাকমার সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন সাবেক প্রকৌশলী ক্যাসাচিং মারমা, কুবলেশ্বর ত্রিপুরা, উৎপল দেওয়ান, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সুলভ চাকমা, বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন এর ঢাকা’র সভাপতি ও ঢাবি শিক্ষার্থী দনওয়াই ম্রো, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের প্রতিনিধি লিটন ত্রিপুরা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক অং সুয়ে সিং মারমা। এছাড়া লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জ্যাকি হ্লা মারমা।
প্রকৌশলী ক্যসাচিং মারমা বলেন, আদিবাসীদের জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সিডিউল ট্রাইব, সিডিউল কাস্ট ও ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটি নামে প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা রেখেছে। তাছাড়া আমরা জানি পার্বত্য চুক্তির পেছনে সিএইচটি রেগুলেশনের ১৯০০ এর স্পিরিট রয়েছে। আমরা আশা রাখি সরকার আমাদের ন্যায্য চাহিদা ও সুবিধার কথা ভেবে এই বিষয়ে উপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
ডাক্তার অজয় চাকমা তার সভাপতির বক্তব্যে বলেন, আমরা এখানে প্রতিবাদের কথা, বেদনার কথা বলতে এসেছি। পাহাড়ের ইতিহাস বেদনার ইতিহাস, পাহাড়ের ইতিহাস শোষনের ইতিহাস। ব্রিটিশ কলোনিস্ট সরকার এই অঞ্চলের জাতিসমূহের অস্তিত্ত্বের প্রতি সম্মান রেখে ১৯০০ সালের শাসনবিধি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এই শাসনবিধির বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র সেটাতো এই সরকারের জন্যই লজ্জাজনক। তিনি তাঁর বক্তব্যে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বহাল রাখাসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান তিনি। এছাড়া আদিবাসী কোটা পুনবর্হালের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এই চিকিৎসক।
ঢাকাস্থ জুম্ম নাগরিক সমাজের তরুণ প্রতিনিধি সুলভ চাকমা তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, সিএইচটি রেগুলেশন কোন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নই। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলকে শাসনবহির্ভুত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং এই অধিকারের প্রতি সম্মান রেখে ব্রিটিশ সরকার শাসনবিধি প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু আজ রাস্তায় দাড়িয়ে এই শাসনবিধি বাতিলের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়। এটি সরকারের জন্য লজ্জাজনক। আমরা ভারতেও দেখতে পাই সংবিধানেও সেখানকার আদিবাসীদের অস্তিত্বকে সম্মান করতে ওদের জন্য বিশেষ তফসিল রাখা হয়েছে। আমরা বলতে চাই এই শাসনবিধি নিয়ে কোন ষড়যন্ত্র চলবে না। জুম্ম জনগনের অস্তিত্ব নিযে কোন তালবাহানা চলবে না।
মানবাধিকার কর্মী পল্লব চাকমা বলেন, বিশ্বব্যাপী যেখানে যেখানে আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করছে, ঠিক সে সময়ে আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে নানান ষড়যন্ত্র করে চলেছে। আমাদেরকে প্রায় সময় শুনতে হয় আমরা নাকি বিচ্ছিন্নবাদী। কিন্তু আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হতে চাওয়াটা কি বিচ্ছিন্নতাবাদী? বর্তমানে আমাদের অস্তিত্বের হাতিয়ার পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে বাতিল করার যে ষড়যন্ত্র এটি আমাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়নের ষড়যন্ত্র করছে। এবং সরকার যদি এই ভুলটা করে তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিপর্যয় ঘটবে।
উৎপল দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বাতিলের যে ষড়যন্ত্র সেটা আমরা মানি না। আমরা সেই শাসনবিধি বাতিল বা সংশোধন কোনটিই চাই না। কেননা সেটি পাহাড়ীদের সংস্কৃতি , প্রথা ও ঐতিহ্য রক্ষার দলিল। পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থায় খাস জমি নেই। পাহাড়ের সকল জমির মালিকানা আমাদের প্রথাগত হেডম্যান ও রাজাদের উপর নির্ভরশীল, যা ১৯৯০ সালের রেগুলেশনে নিশ্চিত করা হয়েছে।
দনওয়াই ম্রো বলেন, চিটাগং হিল ট্র্যাক্স হচ্ছে নানা জাতির সমাবেশ। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, প্রশাসন, আইন সবকিছু এই রেগুলেশনের মধ্যে আছে। কিন্তু বর্তমানে কিছু গোষ্ঠী এই রেগুলেশন বাতিল করার ষড়যন্ত্র করছে। এবং সরকার সেটাকে সায় দিচ্ছে । যদি এটি বাতিল হয় তাহলে বাংলাদেশ সরকারের সাথে জুম্ম জনগনের করা চুক্তিটাও অবৈধ হবে। আমরা চাই অনতিবিলম্বে এই ষড়যন্ত্র বন্ধ করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান।
অংশৈসিং বলেন, সেই বিধি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসমূহকে স্বীকৃতি এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে একটি শাসনবহির্ভুত এলাকা ছিলো। কিন্তু পাকিস্তান আমলে সেটাকে ট্রাইবাল এরিয়া বলে ঘোষণা করেছে। এবং আমরা দেখেছি জুম্ম জনগনের অনুমতি ছাড়া কাপ্তাই বাধ করে লক্ষ জনগণকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করেছ। রাষ্ট্র পরিবর্তন হয় কিন্তু জুম্ম জনগনের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ কেউ বন্ধ করে না।
সাবেক প্রকৌশলী কুবলেশ্বর ত্রিপুরা বলেন, সেখানে যারা থাকে তাদের ভূমি মালিকানা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। আমাদের মানুষজন প্রতিদিন উচ্ছেদ হচ্ছে । আজকে যে মানুষ যে জায়গায় আছে সে কালকে সেখানে নাই। প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ হচ্ছে। আমাদের যে প্রথাগত আইন এবং শাসনবিধি বহাল না থাকলে একসময় আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না।
ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, যদি এই শাসনবিধি বাতিল হয়ে যায় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকবে না। আপনার অনেকেই বাইরে গিয়ে বলে থাকেন বাংলাদেশ একটি বৈচিত্রপূর্ণ বহুজাতির দেশ। কিন্তু এই আইন বাতিল হলে আপনারা সেটাও দাবি করতে পারবেন না।
উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালে সাম্প্রদায়িক ও জুম্ম বিদ্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী সেটেলার আব্দুল আজিজ আকন্দ Rangamati Food Product Ltd. V. Commissioner of Customs and others মামলার রায়ের বিরুদ্ধে সিভিল পিটিশন নং-৫৪/২০১৮ মূলে এবং একইভাবে খাগড়াছড়ি নিবাসী সেটেলার আব্দুল মালেক Wagachara Tea Estate Ltd. V. Muhammad Abu Taher and Others মামলার রায়ের বিরুদ্ধে সিভিল পিটিশন নং-১৯২/২০১৮ মূলে রিভিউ মামলা দায়ের করেন। রিভিউ পিটিশনে ২০১৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রদত্ত রায়ে উল্লেখিত ৫৭টি ব্যাখ্যার মধ্যে প্রথাগত আইনের ২৭টি দফা বিলুপ্ত করার জন্য আবেদন করা হয়।
বস্তুত রিভিউ পিটিশন রায়ে উক্ত ২৭টি দফা বিলুপ্ত হলে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি নয়, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং এর অধীনে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক আইনের বিধানাবলী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার এবং সামাজিক রীতি-প্রথা।