১৪ দলের লংগদু সফরকালে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভা আ:লীগের সেটেলার সম্মেলনে পরিণত
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2017/06/5-1.jpg)
গত ৭ জুন ২০১৭ লংগদুতে জুম্মদের ঘরবাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা তদন্তে আসা ১৪ দলের প্রতিনিধিদলের সরেজমিন পরিদর্শন উপলক্ষ্যে আয়োজিত মতবিনিময় সভাকে আওয়ামীলীগের উদ্যোগে সেটেলার বাঙালিদের সভায় পরিণত করে সম্পন্ন হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ও আটারকছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমা ব্যতীত সেনা-পুলিশের সহায়তায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ক্ষতিগ্রস্ত জুম্ম গ্রামবাসীদের কাউকে কথা বলতে সুযোগ দেয়া হয়নি।
গত ৭ জুন ২০১৭ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ১৪ দলের সমন্বয়ক মো: নাসিমের নেতৃত্বের এক প্রতিনিধিদল লংগদুতে জুম্মদের ঘরবাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা পরিদর্শনের আসেন। প্রতিনিধিদলে ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশাহ এমপি, বাংলাদেশ গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেন, জাসদের আহ্বায়ক রেজাউল রশীদ খান, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এজাজ আহমেদ মুক্তার প্রমুখ রাজনৈতিদলের প্রতিনিধিরা সঙ্গে ছিলেন। এছাড়া পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, খাগড়াছড়ি খাগড়াছছড়ি থেকে নির্বাচিত এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, আওয়ামীলীগের রাঙ্গামাটি জেলা সভাপতি দীপঙ্কর তালুকদার, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, সংরক্ষিত মহিলা এমপি ফিরোজা বেগম চিনু, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান, পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান ১৪ দলের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দিকে ১৪ দলের প্রতিনিধিদল লংগদুতে পৌঁছেন। পৌঁছে গাড়ি যোগে সরাসরি বাত্যা পাড়ায় ভস্মীভূত ঘরবাড়ি দেখতে যান। সেখানে অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত কোন জুম্ম গ্রামবাসী ছিল না। চাঁদের গাড়ি যোগে একদল সেটেলার বাঙালিও প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাত্যা পাড়া গিয়েছিল। এ সময় সেখানে আওয়ামীলীগ, সেনা কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের উদ্যোগে শত শত সেটেলার বাঙালিদেরকে বাত্যা পাড়ায় উপস্থিত রাখা হয়। সেসময় সেটেলার বাঙালিরা উল্টো জুম্মদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে বলে জানা যায়। সেখানে তিনি নিহত মোটর সাইকেল চালক নুরুল ইসলাম নয়নের স্ত্রীর সাথে দেখা করেন। বাত্যা পাড়া পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে তিনটিলা বৌদ্ধ বিহারের গেইটে নামেন। সেখানে সুখময় চাকমাসহ দুয়েকজন জুম্ম গ্রামবাসীর পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পরিদর্শন করেন। এ সময় আটারকছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমা, জনসংহতি সমিতির লংগদু শাখার সাধারণ সম্পাদক মণি শঙ্কর চাকমা, বিত্র রঞ্জন চাকমা, আগুনে পুড়ে নিহত গুণমালা চাকমার কন্যা মিসেস কালাসোনা চাকমা প্রমুখ ক্ষতিগ্রস্ত জুম্ম গ্রামবাসীরা হামলার ঘটনা তুলতে যৎসামাস্য সুযোগ পান। কালাসোনা চাকমা তার মাকে আগুনে পুড়ে মেরে ফেলার বিচার দাবি করেন।
এ সময় ‘ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত কিনা’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মো: নাসিম বলেন, যেভাবে আলামত দেখা গেছে তাতে পূর্ব পরিকল্পিত না হলে এ ধরনের এত বড় ব্যাপক ঘটনা ঘটানো সম্ভব হতো না বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি আরো বলেন, ঘটনা যারাই ঘটাক না কেন, তাদেরকে ছাড় দেয়া হবে না। তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের চিরস্থায়ী পুনর্বাসন করা হবে। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে তিনি এ সময় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন বলে জানা গেছে।
এরপর ক্ষতিগ্রস্তরা তিনটিলা এলাকায় আরো কয়েকটি পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি দেখাতে চাইলে সময়ের অভাবে ও হাঁটতে না পারার কারণে পরিদর্শন না করে উপজেলা সম্মেলন কক্ষে আহুত সভায় যোগদান করতে যান। অন্যদিকে তিনটিলা বনবিহারে ফজলে হোসেন বাদশাহ ও বীর বাহাদুর আলাদাভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের সাথে কথা বলার কারণে তারা উপজেলা সম্মেলনে কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় দেরিতে অংশগ্রহণ করেন বলে জানা যায়।
অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত মণিশংকর চাকমা জানান, আগে থেকে শত শত সেটেলার বাঙালি এনে সভা কক্ষ দখল করে রাখা হয়। আওয়ামীলীগের উদ্যোগে পূূর্ব পরিকল্পিতভাবে সেটেলার বাঙালিদেরকে বিভিন্ন এলাকা আনা হয় বলে তিনি জানান। সেটেলার বাঙালিদের ভিড় ঠেলে কোন রকমে মঙ্গল কান্তি চাকমা, মণিশঙ্কর চাকমাসহ ৮/৯ জন ক্ষতিগ্রস্ত জুম্ম গ্রামবাসী হলরুমে ঢুকতে সক্ষম হলেও মঙ্গল কান্তি চাকমা ছাড়া তাদেরকে কাউকে তেমন কথা বলতে দেয়া হয়নি।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের সঞ্চালনায় সভা শুরু হলে প্রথমে দীপংকর তালুকদারকে বক্তব্য প্রদান করতে সুযোগ দেয়া হয়। ২ জুনের লংগদু ঘটনাসহ জুম্মদের উপর একের পর এক বর্বরোচিত সাম্প্রদায়িক হামলা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া ও লুটপাট করা, নারী ধর্ষন, ভূমি বেদখল ইত্যাদি বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ না করে তিনি মোটরসাইকেল চালক নুরুল ইসলাম নয়নকে হত্যার ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নয়ন একজন শ্রমজীবী মানুষ। তার মতো একজন শ্রমজীবী মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু নয়নকে হত্যা নয়, এধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটানো হয়েছে। যাদের অবৈধ অস্ত্র আছে তারাই এধরনের হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ব্যতীত এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না। অবৈধ অস্ত্রধারীদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যারা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলেন তারাই অবৈধ অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকান্ড চালিয়ে আসছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র। নয়নের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আমরা (আওয়ামীলীগ) রাঙ্গামাটিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছি। রাঙ্গামাটিতে আমাদের পার্টি অফিসে সেই প্রতিবাদের ব্যানার এখনো ঝুলছে।
দীপঙ্কর তালুকদার আরো বলেন, গত ৫ জুন রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার জাতীয় সংসদে বলেছেন, আওয়ামীলীগের ভাবমুর্তি নষ্ট করার জন্য এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আমি তাদেরকে বলবো, নয়নের হত্যার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে লংগদুতে যে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তাতে আওয়ামীলীগ-যুবলীগকে জড়ানো হচ্ছে তা ঠিক নয়। অগ্নিসংযোগের ঘটনায় যারা আওয়ামীলীগ-যুবলীগকে জড়াচ্ছে তারা ১ জুন থেকে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করছিল। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের দ্রুত বিচার করতে হবে, বিচারের আওতায় আনতে হবে (সেটেলারদের সমর্থক সূচক চিৎকার!)। অন্যদিকে নিরীহ মানুষ যারা ধরপাকড়ের শিকার হচ্ছে, যে অভিযান চলছে সেই অভিযানে যেন আসল কালপ্রিটরা রেহাই না পায়, নিরীহ মানুষরা ধরপাকড়ের শিকার না হয় (না হলে খবর আছে বলে সেটেলারদের সমর্থক সূচক চিৎকার!) সেটিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একই সঙ্গে যে ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছে এটাও অন্যায়, এটাও আমি নিন্দা জানাই। এ বিষয়ে আমাদের প্রধান অতিথি মাননীয় মন্ত্রী নাসিম ভাই বলবেন। আমি শুধু একটি কথায় বলবো, আমাদের শান্তি বজায় রাখতে হবে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ আমরা বার বার বলে আসছি, এখান থেকে কাউকে চলে যেতে হবে না। পাহাড়ি-বাঙালি সকলেই সহাবস্থান নিয়ে থাকতে পারি, বাঁচতে পারি তার জন্য আমি অনুরোধ করবো শান্ত থাকার, পরিবেশ যতখানি প্রয়োজন ততখানি সুষ্ঠু রাখার জন্য। সবাইকে ধন্যবাদ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
এরপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো: নাসিম বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আজকে আমি খুবই মর্মাহত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ দেখতে এসেছিলাম। আজকে আমি নিজে নুরুল ইসলাম নয়নের বাড়িতে গিয়েছি। তার পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছি। একজন শ্রমজীবী মানুষ তিনি কিভাবে প্রতিহিংসার শিকার হলো, এটা আমরা খুবই দুঃখিত হয়েছি। এই প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আবার কিছু অশুভ শক্তি যারা কোন ধর্মেরও নয়, বর্ণেরও নয়, এক ধরনের দুষ্কৃতিকারী কর্তৃক পাহাড়ি বাড়িতে আগুন দেয়া হলো, তাদের সম্পদ ধ্বংস করা হলো, গৃহআবাস ক্ষতি করা হলো, তা দেখতে গিয়েছি। যেহেতু রোজার মাসে সবখানে যেতে পারেনি। কিন্তু আমাদের দীপংকর তালুকদার, বীর বাহাদুরসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সবাই বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। তবে আমি যে কষ্ট পেলাম, একজন শ্রমজীবী মানুষকে কিভাবে নির্মমভাবে হত্যা হলো। সাথে সাথে কিছু মানুষ অতি উৎসাহী হওয়া অশুভ শক্তি নিরীহ পাহাড়িদের বাড়িতে আগুন দিলো, তাদের দোকানপাট ধ্বংস করলো এটা তো সমর্থনযোগ্য নয়। আমি আপনাদের বলতে চাই, এরা কারো বন্ধু নয়, যারা খাগড়াছড়ির মধ্যে নিরীহ নয়নকে হত্যা করলো, আবার যারা নিরীহ পাহাড়িদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিলো। আমি সাবেক বাহিনীর একজন কর্মচারী এখানে চাকরি করে তার বর্ণনা শুনলাম কিভাবে তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এরা কোন ধর্মের নয়, বর্ণের নয়, পাহাড়ি নয় বাঙালি নয়, এটা দুষ্কৃতকারী, ক্রিমিনাল (সেটেলারদের সমস্বরে চিৎকার!)। এই ক্রিমিনালদের অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। যারা খুন করেছে নয়নকে, যারা বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে তাদের সবাইকে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করে আইনে সোপর্দ করা হবে। এইজন্যেই আমরা আজকে এসেছি।
১৪ দলের সমন্বয়ক মো: নাসিম আরো বলেন, আমি অপনাদের বলবো, পাহাড়ি এই অঞ্চল পাহাড়ি বাঙালি সবাই দীর্ঘ দিন যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। কেন এই ঘটনা ঘটবে? যেখানে সরকারও অসাম্প্রদায়িক, সম্প্রীতি বজায় রাখার সরকার, যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে সংঘাত অবসান ঘটিয়ে অস্ত্র সমর্পন করে শান্তি চুক্তিশান্তি স্থাপন করেছে। কিছু মহল অস্ত্র দিয়ে হুমকি দিয়ে এ ধরনের সম্প্রীতি নষ্ট করতে চাচ্ছে। এখানে আমরা সবাই বসে আছি। কেউ পাহাড়ি বসে আছি, কেউ বাঙালি বসে আছি, একই পরিবারের সন্তানের মতো। এই বাংলাদেশ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছে, যাতে বাঙালি মুসলমানের রক্ত গেছে, হিন্দুর রক্ত গেছে, বৌদ্ধের রক্ত গেছে, খ্রীস্টানের রক্ত গেছে, পাহাড়ির রক্ত গেছে, বাঙালির রক্ত গেছে, সবারই রক্তে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। তবে কেন এই অশান্তির বাতাববণ বলেন? এখানে আমার সেনাবাহিনী ভাইয়েরা আছেন, পুলিশ বাহিনীর ভাইয়েরা আছেন, তারা কষ্ট করে দিনকে দিন রাত পরিশ্রম করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার চেষ্টা করেন। বিচ্ছিন্ন ঘটনার মাধ্যমে এগুলো করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মনোবল ভাঙার জন্য এগুলো করা হয়। জনগণের মনোবন ভাঙার জন্য এগুলো করা হয়। আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আপনারা সবাই এখানে আছেন। আপনারা এখানে থাকবেন, জমিজমা নিয়ে কাজ করবেন। কেউ আপনাদেরকে কিছু করতে পারে না (সেটেলারদের সমস্বরে চিৎকার)। পাহাড়ি হোন, বাঙালি হোন কেউ কোন কিছু করতে পারবে না।
তিনি আরো বলেন, এখানে আমাদের দীপংকার তালুকদার, বীর বাহাদুর দিনরাত পরিশ্রম করেন। এখানে আমাদের উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা আছেন, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা আছেন, আমার পাহাড়ি নেতৃবৃন্দরা এখানে আছেন, আমাদের আওয়ামীলীগ অন্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা এখানে আছেন, কেন এই সম্প্রীতি নষ্ট করা হবে? আমরা ইনসাাল্লাহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি বলবো যেখানে বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রতিটি মানুষের বাড়িঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে ইনসাল্লাহ। …পাহাড়ি ভাইদের আমি বলবো, যাদের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে তাদেরকে সাহায্য দেয়া হবে, ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে। এগুলো প্রশাসন দিচ্ছে। রাষ্ট্র দিচ্ছে আপনাদেরকে। আপনারা গ্রহণ করবেন। মানুষকে শান্ত রাখবেন। পাহাড়ি বাঙালি ভাইদের আমি বলবো, আপনারা তাদের পাশে দাঁড়ান। এখন দু:সময়। সবাই মিলেমিশে কাজ করতে হবে। সবাই পাহাড়ি বাঙালি ভুলে গিয়ে কাজ করতে হবে একসাথে। এই মাটি তো আপনাদের সবারই। টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরো দেয়া হবে। আমি বলেছি স্থায়ীভাবে বাড়িঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে। এখানে জেলা প্রশাসন যে কাগজটা করেছে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে, পুলিশের মাধ্যমে, আমাদের দলগুলোর মাধ্যমে। তালিকা অনুসারে ৩০০ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপনারা তালিকা দেন। নিরাপত্তা ব্যাপারে নিশ্চিত করা হবে। কোনভাবে নিরাপত্তা বিঘিœত হবে না। এটা আপনারা নিশ্চিত করবেন। এখানে যারা সেনাবাহিনীরা ভাইয়েরা আছেন, আমাদের পুলিশের ভাইয়েরা আছেন, তাদেরকে আমি অনুরোধ করবো, তারা যাতে তাদের স্ব স্ব ভিটায় আসতে পারেন তা নিশ্চিত করুন। আপনারা ফিরে আসুন। ফিরে এসে আপনার কাজ আপনারা করুন। আপনাদের পাশে প্রশাসন যেমনি আছে, তেমনি বলতে চাই, কারো যদি গাফিলতি থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো (সেটেলারদের চিৎকার!)।
মো: নাসিম আরো বলেন, আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, বাঙালি পাহাড়ি যারা আছেন আপনারা সবাই মিলে এখানে থাকবেন। পরিবারের মতো আপনারা থাকবেন। কেন আমরা একজন আরেককে হিংসা করবো? নয়নের হত্যাকারী একজন দোষী, ক্রিমিনাল, এর কোন ধর্ম নাই, এর কোন বর্ণ নাই। আপনারা দেখবেন, দ্রুত খুনীকে বের করে তাদেরকে শাস্তি বিধান হবে ইনসাল্লাহ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেছেন। ৭১-এর যারা হত্যাকারী তাদের বিচার করেছেন। নয়ন হত্যাকারীর বিচার হবে। ঘরবাড়ি যারা হামলা করেছে তাদেরও বিচার হবে ইনসাল্লাহ। আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই। আপনারা কষ্ট করে এসেছেন। আপনাদের সবাইকে অনুরোধ করবো, এখানে দীপংকর তালুকদার ভাই আছেন, বীর বাহাদুর আছেন, এখানে পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ আছেন, অনেকে আছেন, বলতে গেলে সবাইকে চিনি। আপনারা সবাই মিলেমিশে থেকে এলাকায় শান্তি স্থাপন করুন। বাড়িঘরে ফিরিয়ে আনুন। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা সাহায্য নেয়া ব্যবস্থা করুন। তারা সাহায্য নিক। আপনারা কাজ করে যান। এটা আমরা চাই। আর বেশি সময় দিতে পারবো না। রোজার দিন। আমি আবার চিটাগাং-এর ফ্লাইট ধরে চলে যাবো। এখানে জেলা প্রশাসক দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। পুলিশ ভাইয়েরা কাজ করছেন। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা কাজ করছেন। সবাই মিলে আপনারা থাকেন এটা আমরা চাই। নেতৃবৃন্দকে পরিচয় করে দিচ্ছি, আমার পাশে ফজলে হোসেন বাদশাহ। তিনি সংসদ সদস্য। ওয়ার্কার্স পার্টি জেনারেল সেক্রেটারী। ….গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক। ….জাতীয় পার্টির নেতা। ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ সবাই আছেন। এই বীর বাহাদুর কিছু বলবা? (তিনি না উত্তর দিলেন)। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। (তারপর শ্লোগান ধরেন) পাহাড়ি বাঙালি ভাই ভাই। পাহাড়ি বাঙালি ভাই ভাই। পাহাড়ি বাঙালি ভাই ভাই।
এরপর মঙ্গল কান্তি চাকমা ফ্লোর চাইলে তাকে কিছু বলার সুযোগ দেন। তিনি বলেন, আমি মঙ্গল কান্তি চাকমা, ১নং আটারকছড়া ইউপি চেয়ারম্যান (সেটেলাররা গ-গোল করতে থাকে)। আমাকে কথা বলার সুযোগ দিন। আমি একজন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য। আমি মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম স্যারকে ও ১৪ দলের নেতৃবৃন্দকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নয়নের লাশ ১ জুন খাগড়াছড়িতে পাওয়া গেছে। আমরা নয়নের জন্য দু:খ প্রকাশ করেছি। কে বা কারা হত্যা করেছে, নয়নের হত্যার সাথে কারা যুক্ত ছিল, তাদেরকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার কথা আমরা বলেছি। ১ তারিখ যখন লাশ পাওয়া যায় হামলার ঘটনা ঘটতে পারে তাই তার আশঙ্কার কথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানিয়েছিলাম। কে বা কারা হত্যা করেছিল, ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করবে। সুতরাং দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সজাগ থাকতে বলেছি, যাতে তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে না পারে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, নয়ন হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত প্রকৃত ব্যক্তিদের চিহ্নিত না করে নিরীহ পাহাড়িদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করা হলো। এটা কি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কার্যক্রম হতে পারে? এ ধরনের ঘটনা ঘটানো কি উচিত? নিরীহ পাহাড়িরা কি অপরাধ করলো স্যার? নিরীহ পাহাড়িরা নয়ন হত্যার সাথে জড়িত নয়। নিরীহ পাহাড়িদেরকে কেন জবাই করে দেয়া হলো স্যার? আজকে দেখেন, নিরীহ মানুষের কান্না কিভাবে থামাবেন? এই চোখের পানি কিভাবে থামাবেন স্যার? আমরা নয়নের হত্যাকারীর বিচার চাই, আগেও আমরা বলেছি। কিন্তু নয়নের হত্যাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের শত শত নিরীহ পাহাড়িদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হলো। এটা আপনি স্বচক্ষে দেখলেন, এ বিষয়ে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করে, নিরপেক্ষ তদন্ত করে, দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে, আইনের আওতায় আনা হোক, আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আপনি ত্রাণের কথা বলছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা ত্রাণ নিয়ে কি করবো? একজনের বাড়িতে দশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি ক্ষতি হয়েছে, সেখানে ৫ হাজার, ১০ হাজার, ২০ কেজি চাল নিয়ে কি করবো স্যার? ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের দাবি হচ্ছে, আমরা চাই জীবনের নিরাপত্তা। আমরা চাই আইনের শাসন। আমরা চাই লুটপাট ও অগ্নিসংযোগকারী প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আমরা ত্রাণ চাই না। আমরা চাই স্থায়ী একটি সমাধান, স্থায়ী নিরাপত্তা। দুষ্কৃতকারী চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। পাহাড়ি বাঙালি কিভাবে সম্প্রীতি করবো স্যার? ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি ১৪ দলকে দেয়া হচ্ছে স্যার, আপনি ১৪ দলের প্রধান, আপনি দয়া করে দেখবেন।
এ সময় সেলেটাররা সমস্বরে চিৎকার করতে থাকে। একপর্যায়ে মাইনী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফয়েজ আজিম ফয়েজ উত্তেজিত ভাষায় বক্তব্য দিতে থাকে। নিজেকে একজন আওয়ামীলীগের কর্মী দাবি করে বলতে থাকেন, এখানে এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করছে আমরা তাদের বিচার চাচ্ছি। এখানে দলীয়ভাবে কোন কাজ করা হয় নাই। যদিও দলীয়ভাবে বিভিন্নভাবে অভিযোগ করা হচ্ছে। এখানে নৃশংসভাবে নির্মমভাবে নয়নকে হত্যা করা হয়েছে (সেটেলারদের সমস্বরে চিৎকার), তারা মানুষকে হত্যা করছে। রশিদ সাহেবকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ১৯৯৬-তে ৩৬ জন বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল (চিৎকার)। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনার সূত্রপাত হচ্ছে (সমস্বরে গলা ফাটানো চিৎকার)। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা না হলে এখানে আমরা সম্প্রীতি রক্ষা করতে পারবো না (সমস্বরে আবার সেটেলারদের গলা ফাটানো চিৎকার)। পাহাড়িদের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হোক আমরা চাই না। পাহাড়িদের ঘরে আগুন দেয়াকে আমরা নিন্দা জানাই। আমি একজন মুসলমান হিসেবে বলতে চাই, আমি মিছিল করেছি। তার জন্য আমি দোষী হবো না। যারা আগুন দিয়েছে তার প্রতিবাদ করবো। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
এ সময় মণিশংকর চাকমা কিছু বলতে চাইলে তাকে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। সেটেলাররা হট্টগোল করতে থাকে। এ অবস্থায় সভা সমাপ্তি করা হয়।
সভায় ১৪ দলের প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যদের কাউকে বক্তব্য দিতে সুযোগ দেয়া হয়নি। এটা সেটেলার বাঙালিদের নিয়ে আওয়ামীলীগের দলীয় সমাবেশের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেনা-পুলিশের সহায়তায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মদের ঘরবাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা সরেজমিন পরিদর্শনে আসলেও উপজেলা সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের তেমন কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ও প্রশাসনের ষড়যন্ত্রে এভাবে ১৪ দলের প্রতিনিধিদলের সরেজমিন পরিদর্র্শনকে আওয়ামীলীগের উদ্যোগে সেটেলার বাঙালিদের জনসভায় রূপান্তর করা হয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।