জাতীয়
১৩ জানুয়ারিকে ‘রামনাথ দিবস’ ঘোষণাঃ রামনাথ চর্চা বাড়ানোর আহ্বান
আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): বিখ্যাত ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার করে সেখানে ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের বিশেষায়িত পাঠাগার, বাইসাইকেল জাদুঘর এবং অতিথিশালা নির্মাণের দাবি জানানোর পাশাপাশি ১৩ জানুয়ারি রামনাথের জন্মদিনকে ‘রামনাথ দিবস’ ঘোষণা করেছে ‘ভূর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি’। রামনাথ বিশ্বাসের মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক সেমিনারে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
কমিটির পক্ষে স্বাগত বক্তব্যে শাহেদ কায়েস বলেন, “রামনাথ শুধু দুই চাকায় ঘোরাঘুরি করেননি, জনপদের পর জনপদকে জানার চেষ্টা করেছেন গভীর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে। তাই ১৩ জানুয়ারি সারা দেশের সব সাইক্লিস্ট গ্রুপ রামনাথকে স্মরণ করে, কীর্তিমানের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে বাইসাইকেল শোভাযাত্রা আয়োজন করবে বলে আমরা চাই। যাঁরা পাহাড়ে চড়তে ভালোবাসেন তাঁদের অনুরোধ করব, রামনাথের নামে কোনো একটি পাহাড় চূড়ায় যান সেদিন। ভ্রমণপিপাসুদের বলব দেশটাকে জানতে বেরিয়ে পড়ুন। বিশ্বকে দেখুন। সেই সাথে সরকারের কাছে আহবান থাকবে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে যেন রামনাথের জীবনী পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
” ‘রামনাথ বিশ্বাস: বিশ্বজোড়া পাঠশালা তাঁর’ শীর্ষক ওই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর। লিখিত ওই প্রবন্ধে তিনি বলেন, “সর্বকালের সেরা বিশ্ব ভূপর্যটকদের নাম লিখলে রামনাথ বিশ্বাসের নাম আসবে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বাঙালি জাতি ঘরকুনো, তারা ভ্রমণ করতে জানে না বিশ্বদরবারে এ অপবাদ ঘুচিয়েছেন রামনাথ।” “পৃথিবী বিখ্যাত ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস, যিনি সাইকেলে ৫৩ হাজার, পায়ে হেঁটে সাত হাজার, রেলগাড়িতে দুই হাজার, জাহাজে ২৫ হাজার, মোট ৮৭ হাজার মাইল এবং ১ লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছিলেন। রামনাথকে পাঠ করতে হবে। তাঁর জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।” বলে দাবি করেন প্রাবন্ধিক।
রামনাথকে বিশ্ব পাঠশালার একনিষ্ঠ ছাত্র উল্লেখ করে আহসানুল কবীর বলেন, “তিনি অর্জন করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, দেখেছেন ভিন্নভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা, পরিচিত হয়েছেন বিপরীত সব রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে। রামনাথ বিশ্বাস দুচোখ ভরে উপভোগ করেছেন পৃথিবীর নানা রং, রূপ, রস। নবীন শিক্ষার্থীর মতোই আগ্রহ ভরে শিক্ষার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছেন। সঞ্চয় করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার ঝুলি। ফলে গোটা জগৎ জুড়েই সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর পাঠশালা। আর এই পাঠশালার একনিষ্ঠ ছাত্র রামনাথ বিশ্বাস।” তিনি বলেন, “ভিনদেশী ইবনে বতুতাকে চিনি, স্বদেশী রামনাথকে জানি না, ভিনদেশী সিরাজউদ্দৌলার জন্য অশ্রুপাত করি, ভূমিপুত্র সমশের গাজীকে ডাকাত বলি, রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায় সম্পর্কে জানি, এই মাটির সন্তান ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের সংগ্রামমুখর সাধনার কথা বলি না, হাজী মুহম্মদ মহসীনের দানশীলতার কথা বলি মহেশ ভট্টচার্য্যরে নামও উচ্চারণ করি না। এই দায় কার? রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থা, আপনি, আমি, আমরা সবাই কমবেশি এর জন্য দায়ী।”
প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও লেখক মফিদুল হক বলেন, “রামনাথ বিশ্বাসের বই যারা পাঠ করবেন, তারা কখনোই ভুলতে পারবেন না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্কুলে পড়ার সময় ষাটের দশকে প্রথম রামনাথকে পড়েছিলাম। আর ভুলিনি। মৌলভীবাজারেও নীলা রায়ের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। বানিয়াচংয়ে রামনাথের স্মৃতিও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস যে মুছে ফেলা যায় না। সেটি রামনাথের ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার স্পষ্ট হলো। মৌলভীবাজারে নীলা রায়ের বসতভিটা, বানিয়াচংয়ে রামনাথের বসতভিটা এবং মানিকগঞ্জে বিদ্রোহী কবি নজরুলের স্ত্রী প্রমীলার বাড়িও পুনরুদ্ধার করা হোক।”
রামনাথকে উপনিবেশবাদ বিরোধী বলে উল্লেখ করে মফিদুল হক আরো বলেন, “রামনাথ বিশ্ব ঘুরেছেন এবং চেয়েছিলেন কালো মানুষেরা যেন জেগে উঠে। আফ্রিকায় গিয়ে একেবারে মানুষের ভেতরে থেকে জীবন দেখেছেন। সেই দেখার অভিজ্ঞতা থেকেই রামনাথ উপনিবেশবাদ বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন।”
উক্ত সেমিনোরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “বাংলা সাহিত্যে অনেক ভ্রমণকাহিনীর লেখককে আমরা চিনি, আমার নিজেরও বেশকিছু ভ্রমণবিষয়ক বই আছে। কিন্তু রামনাথ বিশ্বাস যেখানে আলাদা সেটি হলো তিনি ছিলেন একেবারেই সাধারণ একজন পর্যটক। যার কাছে ছিল না আড়ম্বরপূর্ণ উচ্চশিক্ষা, প্রয়োজনের চেয়ে খুব বেশি অর্থও তিনি ভ্রমণের সময় সাথে নিতেন না। তার যেটি ছিল সেটি হচ্ছে অসম্ভব সাহস আর অসীম কৌতূহল।” “রামনাথ বিশ্বাসের ভ্রমণকাহিনী লেখার অসাধারণ হাতকে আমি আবিষ্কার করতে পারি, তার ‘তরুণ তুর্কী’ বইটি পড়ে। ততদিনে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে কামাল আতাতুর্ক সেখানে বিপ্লব করে ফেলেছেন। রামনাথ বিশ্বাসের ওই ভ্রমণকাহিনী পড়ে আমার মনে হয়েছে আমি যেন এক নতুন তুরস্ককে দেখছি।” বললেন শাহরিয়ার কবির।
রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা আল বদর পরিবারের দখলে রয়েছে, যেটি লজ্জার বলে উল্লেখ করে শাহরিয়ার কবির বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশে এটা খুবই লজ্জার, আল বদর পরিবারের দখলে রয়েছে রামনাথের বসতভিটা। এই বসতভিটার পুরো জায়গাটিই পুনরুদ্ধার করার এই আন্দোলনে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পাশে থাকবে এবং যেখানে বলা লাগে বলবে। রামনাথের জায়গা পুনরুদ্ধার করতে হবে।”
নির্ধারিত আরেক আলোচক সাবেক অতিরিক্ত সচিব জালাল আহমেদ বলেন, “বানিয়াচংকে কেন্দ্র করে পর্যটন পরিকল্পনা করার প্রতিশ্রুতি আছে সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের। রামনাথের নামে সেখানে মিউজিয়াম করার উদ্যেগ নিতে পারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।”
ভূর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন যুগ্ম আহ্বায়ক শাহেদ কায়েস। সঞ্চালনা করেন আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক রুমা মোদক। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সাংবাদিক দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু ও ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু চৌধুরী। রামনাথ বিশ্বাসের প্রয়াণ দিবস স্মরণে আয়োজিত হয় এই সেমিনার ও একক বইমেলা। রামনাথ বিশ্বাসকে নিয়ে নিজের লেখা গান গেয়ে শোনান বাউল বশিরউদ্দিন সরকার। একক বইমেলার ব্যবস্থাপনায় ছিল অনলাইন বই বিপণন প্রতিষ্ঠান ‘জলপড়ে ডটকম’। সেমিনারের সভাপতির বক্তব্যে আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা উদ্ধারে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও বানিয়াচংয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তৎপরতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে রামনাথ বিশ্বাসের বেদখল হওয়া বসতভিটা’র ১ একর ১৬ শতাংশ ভূমি উদ্ধারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়ে এসেছে। রামনাথ ছিলেন অকৃতদার। তাঁর স্বজনদের কেউ আর নেই। তিনি বাংলাদেশের গৌরব। তাই তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।” পরে মুক্ত আলোাচনায় আরো অংশ নেন এ আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা সাংবাদিক রাজীব নুর ও বানিয়াংচং প্রেসক্লাবের সভাপতি মোশাহেদ মিয়া।