জাতীয়

হয়নি পুনবার্সনঃ অনাহারে অর্ধাহারে কাটছে লংগদুবাসীর জীবন

রাঙামাটি প্রতিনিধিঃ ‘ঘরে যে চাল ছিল সেগুলো দুপুরে রান্না হয়েছে। রাতে রান্নার জন্য চাল নেই। ছেলে যদি আয় করে চাল কিনে আনে তাহলে রান্না হবে। না হলে না খেয়ে থাকতে হবে।’ গত মঙ্গলবার লংগদু-নানিয়াচর সড়কের পাশে বাইট্ট্যা ঝুপড়ি ঘরে বসে জীবনের অনিশ্চয়তা এভাবে বর্ণনা করেন অগ্নিসংযোগে সর্বস্ব হারা নিগিরি সোনা চাকমা (৬০)। তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ কি হবে চোখে অন্ধকার দেখছি। পরের ঘরে কাজ করে যে, কিছু আয় করব তার পরিবেশও নেই। সবার ঘর পুড়েছে। কোথাও কাজ নেই।

আগুনে সব হারানোর পর থেকে এই ঝুপড়ি ঘরে ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। যেখানে আছি সেটি আমার জমি নয়। নিরাপত্তা না থাকায় পোড়া ভিটায় ফিরতে পারছি না। আমার পোড়া ঘরের চারদিকে বাঙালিদের বসবাস। সেখানে আমার বাগান আছে। ভয়ে যাচ্ছি না।

সরেজমিনে তিন টিলাপাড়া, বাইট্ট্যাপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, বাইট্ট্যাপাড়া কয়েকটি পরিবার পোড়া ভিটার পাশে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে বসবাস করছে। অন্যদিকে তিন টিলাপাড়ায় ঝুপড়ি ঘর চোখে পড়েছে দুটি। এর মধ্যে একটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। অন্য ঝুপড়ি ঘরে বাঁশের বেড়া খুটছেন মিনাকি চাকমা (৩৫)। বলেন, চার মাস গেল ঘরবাড়ি নেই। কীভাবে দিন পার করছি তা শুধু ভগবান জানেন।

তিন টিলাপাড়ার দয়াল চন্দ্র কার্বারী বলেন, গত ১২ জুলাই ডিসির ত্রাণ গ্রহণ যেন আমাদের জন্য অভিশাপ হয়েছে। ২ বান ঢেউটিন, ৬ হাজার টাকা, ২টি কম্বল এবং ৩০ কেজি চাল গ্রহণ করে প্রচার করা হয়েছে সরকার আমাদের ত্রাণ দিচ্ছে। পুনর্বাসন শুরু করেছে। এ খবরে বেসরকারি ত্রাণ বন্ধ হয়ে যায়। সবার ঘরে খাবার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোসাদ্দেক মেহ্দী ইমাম বলেন, সেই ৩০ কেজি চাল দেয়ার পর কোনো কিছু দেয়া হয়নি। যাদের ঘরে চাল নেই শিগগিরই তাদের তালিকা তৈরি করব।

তিন টিলা গ্রামের মিনু চাকমা (৩২), ননিবালা চাকমা (৪৫) বলেন, তারা কেউ দূরের আত্মীয়, কেউ বিদ্যালয়ে, কেউ ঝুপড়ি ঘরে দিন কাটাচ্ছেন।

লংগদু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও লংগদু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মোট ১১ পরিবার এখনো সেখানে অবস্থান করছে। তারা বলেন, তাদের যা আছে তা খেয়ে দিন পার করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে না বিদ্যালয়ে। এ ব্যাপারে ইউএনও বলেন, যারা বিদ্যালয়ে অবস্থান করছে তারা নিজেদের উদ্যোগে খায়।

বাইট্ট্যাপাড়ার গ্রাম প্রধান শান্তিময় চাকমা (৬২) বলেন, ডিসির ত্রাণ আমরা নিতে চাইনি। ডিসি এসে আমাদের অনুরোধ করেছিলেন এগুলো নেন। এরপর ধাপে ধাপে সব আসবে। কিন্তু কই? ডিসি যে চলে গেলেন এরপর আমরা কীভাবে আছি, কি খাচ্ছি, কোনো খবর নেয়া হয়নি। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।

পেটে ভাত নেই। শোনা যাচ্ছে আমাদের এখানে নাকি রোহিঙ্গা আনা হবে। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না। গত শনিবার দিঘীনালায় এক নারীকে মেরে ফেলার খবর শুনে আবার হামলার ভয়ে আমরা সবাই জঙ্গলে পালিয়ে যাই।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোসাদ্দেক মেহ্দী ইমাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারপ্রতি ৩০ কেজি চাল দেয়ার পর তাদের আর কিছু দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে। এগুলো চলমান। এ ছাড়া সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংক থেকে টাকাগুলো উত্তোলন করা গেলে ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করা যাবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি থেকেও সহায়তা দেয়া হবে শুনেছি।

ইউএনও আরো বলেন, আমরা সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত ১৭৬ ঘরের মালিক পেয়েছি। তাদের ঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে। এটি চূড়ান্ত। যারা ভাড়া ঘরে ছিলেন তাদের সব জিনিসপত্র পুড়ে গেছে। অন্যদিকে ঘরের মালিকের শুধু ঘর পুড়েছে। ভাড়াটিয়াদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

লংগদু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দ্রুত ঘর নির্মাণ করা হলে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তারা খুব কষ্টে আছেন।

উল্লেখ্য, গত ১ মে দিঘীনালা-খাগড়াছড়ি সড়কের ৪ মাইল এলাকায় রাঙ্গামাটির লংগদু ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা নয়নের লাশ পাওয়াকে কেন্দ্র করে পরদিন লংগদু সদের লাশ বের করা মিছিল থেকে একদল বাঙালি তিন টিলা, বাইট্ট্যাপাড়া এবং মানিকজোর ছড়া তিন পাহাড়ি গ্রামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এতে পুড়ে যায় ২১৪টি বাড়ি। আগুনে পুড়ে মারা যান গুণমালা চাকমা (৭০)।

Back to top button