মতামত ও বিশ্লেষণ

‘হামে’ নিহত ত্রিপুরা শিশুরা কী প্রমাণ করল? – পাভেল পার্থ

ঢাকা শহরের চিকুনগুনিয়া জ্বর আর চট্টগ্রাম-রাঙামাটির পাহাড় ধসের ভেতরেই অন্য এক অসুখ ও পাহাড়ের জনগণকে নিদারুণভাবে ‘জাতীয় খবরে’ পরিণত হতে হল। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের কুিমরা, পৌরসদর, বারৈয়াঢালা, বাড়বকুন্ড, সোনাইছড়ি ও সলিমপুর পাহাড়ে দশটি ত্রিপুরা পাড়া আছে। সীতাকুন্ড পাহাড়ে ত্রিপুরাদের সংখ্যা প্রায় ৪০০। ২০১৭ সনের ৮ থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত সোনাইছড়ি ত্রিপুরা গ্রামের ৯ জন শিশু এক রাষ্ট্রকথিত এক ‘অজ্ঞাত’ রোগে নিহত হয়। যদিও রাষ্ট্র এর ভেতরেই প্রমাণ করেছে রোগটির নাম বহুল পরিচিত ‘হাম’। ৮ থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ার রূপালী ত্রিপুরা (৩), কসম রায় ত্রিপুরা (১০), কানাই ত্রিপুরা (৫), জানাইয়া ত্রিপুরা (৭), হৃদয় ত্রিপুরা (৮), তাকিপতি ত্রিপুরা (১২), রমাপতি ত্রিপুরা (৮), ফকতি ত্রিপুরা (৭), শিমূল ত্রিপুরা (২) হাম নামের এক ‘অজ্ঞাত’ রোগে নিহত হয়। ৮ জুলাই মারা যায় ১ জন, ৯ জুলাই ২ জন, ১১ জুলাই ১ জন, ১২ জুলাই ৫ জন। এ ঘটনায় স্থানীয় সবুজ শিক্ষায়তন উচ্চ বিদ্যালয়, বার আউলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মছজিদ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৩ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের জন্য ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের ছুটি দিয়েছে যাতে রোগটি ছড়িয়ে না পড়ে। সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ার ৮৬ জন রোগীর ভেতর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫১ জন এবং ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস হাসপাতালে ৩৫ জন ভর্তি হয়েছে। একজন অন্ত:স্বত্তা নারী বাদে সবাই শিশু। সোনাইছড়ি ত্রিপুরা গ্রাম থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের বগুলাবাজার ত্রিপুরা গ্রামের ১৩ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয় ১৫ জুলাই। পরবর্তীতে আট কিলোমিটার দূরের ছোট কুমিরা ত্রিপুরা পাড়াতেও ছড়িয়ে পড়ে রোগ এবং ১৬ জুলাই এক শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এ ঘটনায় মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল মালেককে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিকে ৭২ ঘন্টার ভেতর প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। ১৯৭৯ সন থেকে দেশব্যাপি সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলেও তদন্তে প্রমাণ হয়েছে উল্লিখিত ত্রিপুরা বসতিগুলো দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরেই জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির বাইরে ছিল। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘গাফিলতি ও দায়িত্বে অবহেলা চিহ্নিত করে’ শাস্তি হিসেবে কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মীকে সন্দীপের উড়কির চরে পাঠানো হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে কেবল মাঠপর্যায় নয় জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার সকল স্তরের দায়িত্বই এখানে অবহেলিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নয় ত্রিপুরা শিশু জীবন দিয়ে সীতাকুন্ড পাহাড়ে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিকে প্রবেশ করিয়েছে। হয়তো হামের পাশাপাশি যক্ষা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইসিস বি, পোলিও, রুবেলা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা বি এই নয়টি রোগের মৃত্যুঝুঁকি থেকে এখন বাঁচবে এই ত্রিপুরা জনপদ। প্রথমে ‘অজ্ঞাত’ বললেও রাষ্ট্র ‘হাম’ হিসেবেই রোগটিকে প্রমাণ করেছে। নয় জন ত্রিপুরা শিশুর এই নিদারুণ মৃত্যু তীব্রভাবে জাতীয় জনস্বাস্থ্য ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্ন করেছে। এ ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য থেকে চলমান বৈষম্য, ক্ষমতার রাজনীতি ও বিভাজনের নানা সূত্রও স্পষ্ট হয়েছে। চলতি আলাপখানি সেইসব বৈষম্য ও বিভাজনের মনস্তত্বকে ঘিরে। যার আমূল বদল না ঘটলে জাতীয় জনস্বাস্থ্য দেশের সকলের জনস্বাস্থ্যের ময়দান ছুঁতে ব্যর্থ হবে।

কত অজানা প্রশ্ন

হামে আক্রান্ত ত্রিপুরা জনপদের সাম্প্রতিক ঘটনার উপস্থাপন ও বিশ্লেষণে ব্যবহৃত বেশকিছু শব্দ ও প্রত্যয় থেকেই আমাদের বৈষম্য ও বিভাজনের সূত্র গুলোকে প্রশ্ন করা জরুরি। প্রথমেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল রোগটিকে আখ্যায়িত করেছেন ‘অজ্ঞাত’। তারপর বলা হয়েছে ‘অপুষ্টি’, যার সাথে কেউ জড়িয়েছেন চরম দারিদ্র্য অবস্থাকেও। আক্রান্তদের বসতি অ লকে ‘দূর্গম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো স্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ ও ‘অসচেতন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ত্রিপুরা জাতির নিজস্ব চিকিৎসারীতিকে এক ধাক্কায় উড়িয়ে দিয়ে ‘আধুনিক’ চিকিৎসার ক্ষমতাকে একতরফাভাবে বৈধ করার বাহাদুরি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গণমাধ্যম পুরো বিষয়টিকে দুটো জায়গা থেকে উপস্থাপন করেছে, প্রথমত এক বুনো আদিম বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর এক অজ্ঞাত অসুখ আবিষ্কার এবং দ্বিতীয়ত নানা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানিক গাফিলতি ও অবহেলা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অধিকাংশ আলোকচিত্রই বাঙালি ক্যামেরার বাহাদুরি প্রমাণ করেছে। করুণ চাহনি, দীর্ণ শরীর কী জীর্ণ পোশাক উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য থেকে গেছে এক ‘অজ্ঞাত’ রোগের সাথে জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ের শক্তি ও তাদের প্রতি রাষ্ট্রের প্রশ্নহীন অবেহেলা।

৩৮ বছর ধরেই হাম ‘অজ্ঞাত’ রোগ

আক্রান্ত শিশুদের যেসব শারিরীক লক্ষণ গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে সেসব হলো জ্বর, শরীরে লাল ফুসকুড়ি ও গুটি, বমি, গলার গ্রন্থি ফোলা, পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া ও শ্বাসকষ্ট। দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যারা নিজেদের চিকিৎসারীতিকে বলছেন ‘আধুনিক’ তাঁরা প্রথম সণাক্ত করেন রোগটি ‘অজ্ঞাত’। যে ঘরের শিশু আক্রান্ত হচ্ছে সে ঘরের বয়স্ক কেউ এ রোগে আক্রন্ত না হওয়াতে প্রথমদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা হিসেব মেলাতে পারেননি এবং রোগটি সণাক্ত করতে পারেননি বলে জানান (সূত্র: বিডিনিউজ২৪ডটকম, ১৩/৭/২০১৭)। সীতাকুন্ডের ত্রিপুরা শিশুদের ‘অজ্ঞাত’ রোগে মৃত্যু নিয়ে ‘রোগতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক’ তদন্ত শেষে ১৭ জুলাই রাষ্ট্রীয় সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২২ জুন ত্রিপুরা পাড়ায় হামের সংক্রমণ ঘটে, মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ৮ জুলাই এবং ১০ জুলাই সর্বোচ্চ সংখ্যক শিশুর ভেতর জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যথাসময়ে আধুনিক চিকিৎসা পেলে শিশু মৃত্যু ঠেকানো যেত (দেখান: দৈনিক সমকাল, ১৮ জুলাই ২০১৭)। ত্রিপুরাদের ভেতর আরাঙ্গা ও লুটিসা খুব পরিচিত শিশু রোগ। আরাঙ্গা মানে জলবন্ত আর লুটিসা হলো হাম। এসব রোগ নিরাময়ে রয়েছে নানাবিধ ত্রিপুরা কবিরাজি। যদিও ত্রিপুরা বৈদ্যদের ব্যবহৃত অধিকাংশ ভেষজ এখন সীতাকুন্ড পাহাড়ে বিরল। এটা ঠিক যে, আক্রন্ত শিশুরা অপুষ্টি নয় তারা তীব্র খাদ্যহীনতায় ভুগছে। এর কারণ কী? সীতাকুন্ড পাহাড়ে ত্রিপুরাদের নিজস্ব জায়গা জমিন সবই তো দখল হয়েছে, দখল হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের বাস্তুসংস্থান ও প্রতিবেশ জুম-কৃষির জন্য এখন যথেষ্ট নয়। কিছুটা জুমআবাদ, দিনমজুরি আর খেয়ে না খেয়েই দিন চলছে এখানকার ত্রিপুরাদের। এসব প্রশ্ন তো কেউ করছে না। বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত আধুনিক চিকিৎসকেরা ত্রিপুরাদের নিজস্ব খাদ্য-সংস্কৃতিকে বৈষম্যমূলকভাবে চিহ্নিত করেছেন। সীতাকুন্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নূরুল করিম রাশেদ দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, পুষ্টিহীনতার কারণেই ত্রিপুরাদের এমন হয়েছে। তাদের খাদ্য ঠিক নেই। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকেন। দূষিত পানি পান, পঁচা শুকরের মত খাবার খাওয়ায় তাদেরকে নানা ধরণের জীবাণু আক্রমণ করছে (সূত্র: ১৬/৭/১৭)। ত্রিপুরা পাড়ায় পানি সংকটের প্রসঙ্গ টেনেছেন এলাকার জনপ্রতিনিধিও। সীতাকুন্ড-৪ আসনের সাংসদ দিদারুল আলমের পূর্বপশ্চিম নামের এক ওয়েবপোর্টালকে জানান, ত্রিপুরা পাড়ার বাসিন্দারা ঝুম চাষ করে খায়। তারা ঝাড়ফুঁক ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা তাদের পছন্দ না। পাহাড়ের নীচে একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করে দিয়েছি। কিন্তু তারা সেখানকার পানি না খেয়ে ঝর্ণার পানি খায়। অনেকবার এ এলাকাতে গিয়ে আদিবাসীদের গভীর নলকূপের পানি পান করতে বলা হলেও তারা তা শোনেনি (সূত্র: ১৩/৭/২০১৭)। তবে এ ঘটনার ভেতর দিয়ে ‘পুষ্টিকর ও উন্নত’ খাবারের সাথেও সীতাকুন্ডের ত্রিপুরাদের সাক্ষাৎ ঘটিয়েছে রাষ্ট্র। হাসপাতালে ভর্তি অসুস্থ শিশুদের দুই বেলা দুধ, ডিম, আম এবং আরো ভাল ভাল খাবার দেয়া হয়েছে (দেখুন: সীতাকুন্ড টাইমস, ১৫/৭/১৭)।

রাষ্ট্র যেখানে যেতে পারে না, তাই দুর্গম

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী ‘বিবিসি-বাংলাকে’ জানান, তারা রোগটি সম্পর্কে কোনো পরিস্কার ধারণা করতে পারছেন না। যে এলাকায় রোগটি হানা দিয়েছে সেটি খুব দুর্গম ও প্রত্যন্ত, গাড়ি থেকে নেমে অন্তত দেড়-দু’মাইল হেঁটে সেখানে পৌঁছতে হয় (সূত্র: বিবিসি-বাংলা, ১২ জুলাই ২০১৭)। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদগণমাধ্যমকে জানান, সীতাকুন্ডে কয়েক গোষ্ঠীর মানুষ বিচ্ছিন্ন এলাকায় বসবাস করত। এ কারণে তারা আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে ছিল। বাচ্চাদের রোগবালাই ও চিকিৎসার বিষয়ে কোনও তথ্য জানতো না। এ কারণে ৮ জুলাই প্রথম একটি শিশু মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু গণমাধ্যমে ঘটনাগুলো প্রকাশের পর আইইডিসিআর এর ৫ সদস্যের একটি দল সেখানে যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ধারে এবং জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পা লের কাছাকাছি সীতাকুন্ডের ত্রিপুরা পাড়া গুলি কী আসলেই ‘দুর্গম’ অঞ্চল? এই দুর্গমতা কার চোখে কার চিন্তায় মাপা হয়? রাষ্ট্রের সুরক্ষাবলয় যেখানে যেতে পারে না সেটিই কী ‘দুর্গম অঞ্চল’? কর্পোরেট বিশ্বায়নের এই যুগে রাষ্ট্র না পৌঁছালেও কোক-পেপসি কী সিনজেনটা-মনস্যান্টো কোম্পানির বাণিজ্য সেখানে পৌঁছে গেছে অবলীলায়! রাষ্ট্রের কাছে দুর্গম ও প্রত্যন্ত হলেও বরাবরই সীতাকুন্ডের এই ত্রিপুরা বসতি গুলো বাঙালিদের আক্রমণের নিশানা। বাঙালি কর্তৃক জমি দখল ও নিপীড়ন এখানের নিত্যদিনের ঘটনা। ২০১৩ সনের ১৬ এপ্রিল সালাউদ্দিন, নরুদ্দিন, মো. রফিক, মো. জসিম ও আবছার কুমিরা ত্রিপুরা পাড়ায় হামলা চালায়। হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ বাঁশিরাম ত্রিপুরা বাদী হয়ে সীতাকুন্ড থানায় একটি মামলা করেন (মামলা নং-১৪৩/৪৪৭/৪৪৮/৩২৩/৩২৫/৩০৭/৩৭৯/৩৮০/৪২৭/৫০৬)।

‘কুসংস্কার’ ও ‘আধুনিকতার’ তর্ক

‘অজ্ঞাত’, ‘দুর্গম’, ‘অপুষ্টির’ মত সকল ডাকসাইটে তর্ককে পেছনে ফেলে হামে আক্রান্ত সীতাকুন্ডের ত্রিপুরাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হলো ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ ও ‘অসেচতন’ হিসেবে। প্রথম দিকে কেউ কেউ ঘটনাটিকে আমাজনের কোনো বর্ষারণ্যে আদিবাসী আবিষ্কারের মত করেই উপস্থাপন করে। এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে দৈনিক আমাদের সময় জানিয়েছে, ১ জুলাই শনিবার রাতে স্থানীয় কয়েকজন ত্রিপুরা যুবক পাহাড়ে জাল দিয়ে ফাঁদ পাতে। ফাঁদে একটি বুনো ছাগল মারা যায়। পরদিন ঐ ছাগলের মাংস যেসব পরিবার খেয়েছে সেসব পরিবারের শিশুরাই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ত্রিপুরারা বিষয়টি গোপন করে এবং মৃতদেহ মাটিচাপা দেয়। তারা স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়। বন থেকে ছাগল শিকার করায় বনদেবতা ক্ষুব্ধ হতে পারেন এ বিশ্বাসে ত্রিপুরা আগুন দিয়ে পাড়া পবিত্র করতে গেলে অন্যদের নজরে আসে এবং ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায় (দেখুন: দৈনিক আমাদের সময়, ১২ জুলাই ২০১৭)। বৈষম্যমূলক এ উপস্থাপন মনস্তত্ত্ব প্রায় সকল কর্তৃপক্ষকেই যেন বুঁদ করে দেয়। স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক এএম মুজিবুল হক বিডিনিউজ২৪ডটকমকে জানান, …আমরা যখন গেলাম, তখন তারা আমাদের কাছ থেকে মৃতদের ব্যাপার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আক্রান্তদের ঘরের ভেতর রেখে নানা ধরণের তাবিজকবজ আর বৈদ্য দিয়ে জিন ভূত তাড়ানোর মাধ্যমে বাচ্চাদের সুস্থ করার চেষ্টায় ছিল (সূত্র: ১৩/৭/২০১৭)। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন বিবিসি-বাংলাকে জানান, ত্রিপুরা বাসিন্দাদের অসচেনতার কারণেই ঘটনাটি এত বড় হয়ে গেছে। তারা এত অসচেতন যে, ৯ শিশুর মৃত্যু ও আরো ২৫/৩০জন অসুস্থ থাকার পরও কাউকে হাসপাতালে নেয়নি (সূত্র: ১২ জুলাই ২০১৭)। সোনাইছড়ির নিরুবালা ত্রিপুরা তিন সন্তান ও নন্দ কুমারের ভাগ্নে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের বক্তব্য উল্লেখ করে বিডিনিউজ২৪ডটকম জানিয়েছে, নিরুবালা ও নন্দ কুমারেরা নিজেদের বৈদ্য কবিরাজের ঝাড়ফুক ও তাবিজ কবচেই এ রোগ সেরে যাবে বলে বিশ্বাস করেছিলেন (সূত্র: ১৩ জুলাই ২০১৭)। এমনকি সংবেদনশীল হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যমও এই কুসংস্কারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দৈনিক প্রথম আলো তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে, …ত্রিপুরা উপজাতির ওই মানুষগুলো এবং তাদের শিশুরা শুধু দারিদ্র্য ও অপুষ্টির শিকারই নয়, গভীর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তারা অসুস্থ হলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিংবা হাসপাতালে যায় না, ঝাড়ফুঁক ও তাবিচকবচের আশ্রয় নেয়। সুতরাং এই জনগোষ্ঠীর প্রকট দারিদ্র্য ও গভীর কুসংস্কার দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে (দেখুন: ১৫ জুলাই ২০১৭)।

প্রতিবেশ ও জনস্বাস্থ্য

লুটিসা হোক আর হাম হোক, এমনকি কোনো অজ্ঞাত অসুখই হোক শেষ অবধি নয়টি শিশুর জীবন গেছে। এখনো আক্রান্ত অনেকেই। আদিবাসী জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক মনস্তত্ব আবারো প্রবলভাবে প্রমাণিত হল। চলমান আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাহাদুরি আর জনস্বাস্থ্যের বিভাজিত তলগুলিও উসকে ওঠল। প্রমাণিত হল সীতাকুন্ড পাহাড়ে হামের সংক্রমণ ঘটেছে। কিন্তু কেন ঘটল? তার মানে স্থানীয় প্রতিবেশব্যবস্থায় কোনো বিশৃংখলা তৈরি হয়েছে। সোনাইছড়ি খালের নামে সোনাইছড়ি ইউনিয়ন। পাহাড়ি এ অ লে বার আউলিয়া, ঘোড়ামারা, নাপিতছড়া, হাড়িবাড়ী ও ইছামতি এরকম আরো নানা খাল আছে। খুব কাছেই কুমিরাতে জাহাজভাঙ্গা শিল্প। সীতাকুন্ড পাহাড়ও নানাভাবে বদলে ফেলা হচ্ছে। সীতাকুন্ড পাহাড়ের ত্রিপুরা গ্রামের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতকরণে এরকম সকল প্রতিবেশগত দিকগুলিও নজরে রাখা জরুরি। বিশিষ্ট চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এমএ ফয়েজ দৈনিক ইত্তেফাককে জানান, …এরা যেকোন সংক্রমণে অতি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী। তারা দীর্ঘদিন যাবত রোগের জীবাণু বহন করছে। এটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক ব্যাধি। এসব শিশুরা মারাত্মক অপুষ্টি ও রক্তশূণ্যতায় ভুগছে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে (সূত্র: ১৪ জুলাই ২০১৭)। যদি তাই হয়, কেন সীতাকুন্ড পাহাড়ের ত্রিপুরাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এ প্রশ্নের উত্তরও তো রাষ্ট্রকে খুঁজতে হবে। এখন থেকেই ত্রিপুরা জাতির জনগণ ও তাদের ঐতিহ্যগত চিকিসারীতিকে দূরে ঠেলে নয়, বরং সকল চিন্তার চর্চা থেকেই গড়ে তুলতে হবে জনস্বাস্থ্যের বৈষম্যহীন সুরক্ষাবলয়।

……………………………………………………………..

গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ। [email protected]

Back to top button