সুমেধ চাকমা, ডেস্ক রিপোর্টার (আইপিনিউজ): নেত্রকোনার দুর্গাপুরে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তথা টংক আন্দোলনের মহিয়সী নারী নেত্রী হাজংমাতা রাশিমণি’র ৭৭তম প্রয়াণ দিবস পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে গত ৩০ জানুয়ারি (সোমবার) রাত ৭টায় বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠন (বাহাছাস) একটি অনলাইন আলোচনার আয়োজন করে। উক্ত আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল “হাজংমাতা রাশি মণির ঐতিহাসিক সংগ্রামের অবদান এবং আজকের প্রজন্ম”। আলোচনা সভায় সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আশীষ হাজং।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য ও লেখক সোহেল চন্দ্র হাজং বলেন, “রাশিমণি হাজং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। জমিদারদের বিরুদ্ধে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সাধারণ মানুষের টংক উচ্ছেদ আন্দোলনের শুরু থেকেই শহীদ রাশিমনি হাজং এ লড়াইয়ে সাহসের সাথে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছিলেন। রাশিমণির আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ব্রিটিশ তাড়িয়ে, জমিদারতন্ত্র উচ্ছেদ করে শহীদ রাশিমণি হাজং চেয়েছিলেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন সমাজ। তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনও দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।”
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পল্টন হাজং। হাজং মাতা রাশিমণির বীরত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করে তিনি বলেন, “১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী দ্বারা দলবল নিয়ে সুরেন্দ্র হাজংসহ রাশিমণি হাজং সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। সেসময় হাজংদের মাঝে জমিদারদের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় টংক নীতির বিরুদ্ধে হাজংদের আন্দোলন জেরালোভাবে গড়ে ওঠেছিল। ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী সেদিন আন্দোলনকারী হাজংদের ধরতে গ্রামে গ্রামে হানা দিলে কাউকে না পেয়ে বহেরাতলি গ্রামের সদ্য বিবাহিতা যুবতি কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যেতে চাইলে তাঁকে রক্ষার জন্য এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। তার এই বীরত্বের কারণে হাজংরা তাকে মাতার আসনে অধিষ্ঠিত করেন।”
এছাড়াও বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠন (বাহাছাস) সভাপতি জিতেন্দ্র হাজং তার বক্তব্যে বলেন, “মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠন করে এলাকার নারীদের রক্ষার শপথ রাশিমণি হাজং নিয়েছিলেন। হাজং যুবতী কুমুদিনীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে সে শপথ তিনি রক্ষা করে গেছেন। সেসময়ের জোতদার, মহাজনদের ঋণের অত্যাচার থেকে এলাকার গরিব মানুষকে বাঁচাতে তিনি ‘ধর্মগোলা’ তৈরি করেন। ধানের মৌসুমে সকলের কাছ থেকে অল্প অল্প ধান সংগ্রহ করে রাখা ধান ধর্মগোলায় রেখে দিতেন এবং নানা বিপদের সময় বিনা সুদে সেই ‘ধর্মগোলায়’ থেকে ঋণ দিয়ে মানুষকে সহায়তা করতেন।”
ছাত্রনেতা লিটন হাজং বলেন, “টঙ্ক আন্দোলন চলাকালে ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বহেরাতলি গ্রামের লংকেশ্বর হাজংয়ের স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যেতে চাইলে হাজং নেত্রী রাশিমণি হাজং ও কৃষক নেতা সুরেন্দ্র হাজংয়ের নেতৃত্বে শতাধিক নারী-পুরুষ দা, খুন্তি, কুড়াল নিয়ে পথরোধ করেন। এক পর্যায়ে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। সে যুদ্ধে পুলিশের গুলিতে রাশিমণি হাজং ও সুরেন্দ্র হাজং শহীদ হন। শহীদ রাশিমনি হাজং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।”
এছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের উদ্যোগে আরো একটি অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এ সভায় সঞ্চালনা করেন দীপা রানী হাজং। রাশিমনির জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে আলোকপাত করেন সোহেল চন্দ্র হাজং।
উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি বর্তমানের নেত্রকোণা জেলার সুসঙ্গ দূর্গাপুরের বহেরাতলী গ্রামে হাজং গ্রামে তল্লাশি চালিয়ে ব্রিটিশ সেনারা নববধু কুমুদিনী হাজংকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় রাশিমনি হাজং-এর নেতৃত্বে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র সদস্যরা বাধা দেন। এসময় ব্রিটিশ সেনাদের গুলিতে রাশিমনি হাজং শহীদ হন। রাশিমনিকে বাঁচাতে সুরেন্দ্র হাজং নামে আরও একজন আন্দোলনকারী এগিয়ে এলে তাকেও সেনারা গুলি করে হত্যা করে। টংক আন্দোলনের প্রথম শহীদ হন শহীদ রাশিমনি হাজং ও সুরেন্দ্র হাজং।