সেরেজিং-ওয়ালজান গীতিনাট্যের সংক্ষিপ্ত কাহিনীঃ হিমেল রিছিল
সেরেজিং-সেরানি দুই বোন। বড়বোন- সেরেজিং আর ছোটবোন- সেরানি। অল্প বয়স্ক অনাথ দুই বালিকা। কিছুদিন হলো তাদের বাবা-মা গত হয়েছেন। দুর্গম পাহাড়ের গভীর অরণ্যে ছিল তাদের বাস। বাবা-মা মারা যাবার পর দুঃখে-কষ্টে দুই বোন মিলে মাচাং ঘরে দিনযাপন করছিল। ছোটবেলাতেই মা-বাবা হারিয়ে অঝর ধারায় কেঁদে-কেটে অর্ধাহারে-অনাহারে সময় চলে যাচ্ছিল তাদের। এমন সময় এক কাঠুরিয়া সে অরণ্যে কাঠ সংগ্রহ করতে এসে এই দুই বোনের দেখা পেল। তাদের অবস্থা দেখে কাঠুরিয়ার মায়া হলো। দুই বোনকে তাদের দূরসম্পর্কীয় মাসি-মেসোর কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করল সে। সেরেজিং-সেরানি এতে সানন্দে রাজি হলো। বাপ-মা না থাকলেও মাসি-মেসো তো পাওয়া যাবে- এই ভেবে তারা কাঠুরিয়ার সাথে রওয়ানা দিল। তারপর যেতে যেতে একসময় সে দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়দের বাড়িতে এসে পৌঁছল।
নতুন জায়গায় দুই বোন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে লাগল। তারা বুঝতে পারল – তারা যে সুখের আশায় এসেছিল সেটি তাদের জন্য ছিল না। মা-বাবার মতো কেউ হয় না। দুঃখে-কষ্টে দুই বোন সে বাড়িতে বড় হতে থাকল।
এক সময় ওয়ালজান শিকার করতে এসে গভীর অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলল। বনের ফলমূল, লতাপাতা খেয়ে সে দিন পার করতে লাগল। সে সময় ঐ দরদী কাঠুরিয়াটি সে জঙ্গল দিয়ে কাঠ সংগ্রহ করতে যাচ্ছিল। পথে ওয়ালজানের সাথে তার দেখা হলো। ওয়ালজানের সব কথা শুনে তার মায়া পড়ে গেল। সে ওয়ালজানকে সেরেজিং-সেরানির দূরসম্পর্কীয় মাসি-মেসোর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করলো। ওয়ালজান কাঠুরিয়ার কথায় রাজি হয়ে গেল। কাঠুরিয়ার সাথে সে রওয়ানা দিল। আঁকাবাঁকা লম্বা পথ পেরিয়ে তবে শেষে বাড়িতে এসে তারা পৌঁছল।
সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে সেরেজিং। কৈশোর পেরিয়ে নানা ভাবনা তার মনে এসে ভর করছিল। এমন সময় বাড়িতে ওয়ালজানের আগমন ঘটল। ওয়ালজানের আচার-ব্যবহার ও রূপ দেখে সে মোহিত হয়ে গেল। একই বাড়িতে থাকার দরুণ ভালোলাগা এক সময় ভালোবাসায় পরিণত হলো। কিন্তু এক সময় ওয়ালজানের বংশ পরিচয় জিজ্ঞাস করে জানা গেল, সেরেজিং যে মাহারির সন্তান ছিল ওয়ালজানও সে একই মাহারির সন্তান। ওয়ালজান গাবিল নংমিন মাহারির হওয়ার দরুণ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তাদের সামনে এসে দেখা দিল। কিন্তু তাদের বাঁধভাঙা ভালোবাসাকে কোন কিছুই আটকিয়ে রাখতে পারল না। এমনভাবে চলতে থাকলে এক সময় তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় হতে হবে – এই ভেবে গোপনে তাদের প্রণয় অভিসার চলতে থাকল। কিন্তু এক সময় ঠিক ঠিকই সেরেজিং-এর মাসি-মেসো সেটা টের পেয়ে গেল। পরিণামে দুজনের উপরেই লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নেমে এল। ওয়ালজানকে ঘর থেকে বিতাড়ন করা হলো। পৃথিবীর সবটুকু হতাশা এসে যেন সেরেজিং-এর ওপর ভর করল।
বেচারা ওয়ালজান বিরহে কাতর হয়ে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সেরেজিং-এর বিরহে ওয়ালজান পাগলপ্রায় হয়ে গেল।
ওদিকে সেরেজিং-এর মেসোর মানসিক প্রতিবন্দ্বী ভাগ্না থোরার সাথে সেরেজিং-এর বিবাহের খবর পাওয়া গেল। কিন্তু সেরেজিং বুদ্ধিমতি হওয়ায় স্বামীর সাথে সহবাস এড়িয়ে যেতে লাগল। সে তার সতীত্ব রক্ষা করে চলল চতুরতার সাথে। কিন্তু বেশিদিন যে এভাবে নিজেকে রক্ষা করা যাবে না সে কথা ভেবে সেরেজিং কান্নায় ভেঙে পড়তে লাগল।
এমন দুর্যোগের সময় ওয়ালজানের এক বন্ধু সেরেজিং-এর কাছে এসে হাজির হলো। সে সব কথা শুনে সেরেজিংকে প্রকৃত ঘটনাগুলো বলল। ওয়ানজান আসলে ছোটবেলায় অনাথ ছিল। পরে সে গাবিল নংমিন মাহারির লোকেদর দ্বারা পালিত হয়েছে। এ কারণে ওয়ালজান নিজেকে গাবিল নংমিন মাহারির বলে উল্লেখ করেছিল। ওয়ালজানের বন্ধুর কথা শুনে সেরেজিং আশ্বস্ত হলো। সে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সে প্রস্তুত হতে লাগল।
ঘর থেকে পালিয়ে ওয়ালজানের খুঁজে বেরিয়ে পড়ল সেরেজিং। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় ওয়ালজানের সাথে তার দেখা হলো। ওয়ালজানকে যেন চেনাই যাচ্ছিল না। অনেকদিন ধরে অভুক্ত থাকায় শরীর ভেঙে পড়েছিল ওয়ালজানের। কিন্তু ওয়ালজানকে দেখার পর তার ভাবলেশহীন মনোভাব দেখে কেমন যেন মনোপীড়ায় আক্রান্ত হলো সেরেজিং। এমন প্রত্যাখানের কারণ সে ওয়ালজানের কাছে জানতে চাইল। ওয়ালজান তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল। স্বামী-সংসার ফেলে এখানে কেন এসেছে তার কারণ জানতে চাইল সে। সেরেজিং, ওয়ালজানকে তার বন্ধুর কথা সব বুঝিয়ে বলল। বলল, তার বিয়ে হলেও নিজের সতীত্ব সে বিসর্জন দেয় নি। এতদিন ওয়ালজানের ভরসাতেই এমনটা করেছে সে। আরো জানাল, প্রয়োজনে সতীত্ব পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত আছে সে।
তারপর ওয়ালজান মনমরা হয়ে সতীত্ব পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে লাগল। আগুনে ঝাপ দিতে সেরেজিংও প্রস্তুত হলো। আগুনে ঝাপ দিতে যাবে এমন সময় ওয়ালজান সেরেজিংকে জড়িয়ে ধরে ফেলল। সে তার ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা প্রার্থনা করল। পরক্ষণেই পরস্পর আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ল।
সেরেজিং-ওয়ালজানের এ ঘটনা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। এক সময় সেরেজিং-এর মাসি-মেসো এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারল। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে সেরেজিং-ওয়ালজানকে পুনরায় ঘরে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করল। এরপর সুখে-শান্তিতে একসাথে তারা বসবাস করতে লাগল।
(ছবিঃ ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত)
হিমেল রিছিল; লেখক ও ভাষা গবেষক